হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে করতে ২০২৬ সাল লাগতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রকল্পটির ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হলেও বাকি ২ শতাংশ শেষ করার প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি বললেই চলে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে তাড়াহুড়ো করে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সফট ওপেনিং (একাংশের উদ্বোধন) করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কথা ছিল ২০২৩ সালের শেষে পরীক্ষামূলকভাবে আর ২০২৪ সালের শেষভাগে পুরোপুরি চলবে টার্মিনালের কার্যক্রম। তবে কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কাজও এখনও শুরু হয়নি।
বেবিচক সূত্র জানায়, প্রকল্পের নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী ২০২৪ সালের অক্টোবরে টার্মিনাল চালুর কথা ছিল। কিন্তু এটি সময়মতো শেষ করা যাবে না।
এ প্রকল্প নিয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) সঙ্গে একটি চুক্তি করে। আইএফসি টার্মিনালটি পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিস ও ভেন্ডরের নাম সুপারিশ করার কথা ছিল। এছাড়াও টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণে যেই প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হবে সেই চুক্তির শর্ত নির্ধারণের দায়িত্ব তাদের। পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল তাদের। তবে সবশেষ সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখেও তারা প্রতিবেদন জমা দেয়নি। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরেও আরও দীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে।
বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, থার্ড টার্মিনালের অপারেশন ও মেইন্টেনেন্স কে করবে, আমরা এ সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি। অপারেশন ও মেইন্টেনেন্স করা সম্ভাব্য ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলে চালুর একটা তারিখ বলা যাবে। সুনির্দিষ্ট তারিখ বলতে না পারলেও অপারেশন শুরু করতে করতে সামনের বছরটা (২০২৫) চলে যাবে।
বেবিচক জানায়, পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর জনবল নিয়োগ করতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এরপর ট্রায়াল শুরু হবে, প্রণয়ন করা হবে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)। সবমিলিয়ে প্রক্রিয়াটা অনেক দীর্ঘ। টার্মিনালে ছয় ঘণ্টা করে চার শিফটে মোট ৬ হাজার লোক কাজ করবেন। এর মধ্যে র্যাব-পুলিশ, এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক), এপিবিএন, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ নিরাপত্তা রক্ষাতেই কাজ করবেন প্রায় চার হাজার সদস্য। তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও কাজের জন্য প্রস্তুত করতে এক বছর লেগে যেতে পারে।
২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনাল দিয়ে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রী বহনের ধারণক্ষমতা রয়েছে। পাঁচ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের তৃতীয় টার্মিনালটি যুক্ত হলে বছরে ২ কোটি পর্যন্ত যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। টার্মিনালটিতে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে। ১৬টি ব্যাগেজ বেল্টসহ অত্যাধুনিক সব সুবিধা রয়েছে নতুন এ টার্মিনালে।
কী থাকছে থার্ড টার্মিনালে?
টার্মিনালে একটি মডার্ন টার্মিনাল ভবন রয়েছে, যার আয়তন দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। এ ভবনের ভেতরে থাকবে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ও অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ছোঁয়া। এতে থাকবে বেশ কয়েকটি স্ট্রেইট এস্কেলেটর। যারা বিমানবন্দরের দীর্ঘপথ হাঁটতে পারবেন না, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ বিশ্বের অত্যাধুনিক ও বেশি যাত্রী প্রবাহের বিমানবন্দরগুলোতে এ ধরনের এস্কেলেটর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি যাত্রীদের শান্ত ও মসৃণ যাত্রার অভিজ্ঞতা দেয়।
নতুন এ টার্মিনালে যাত্রীদের ব্যাগের জন্য সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি ও ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের মতো অত্যাধুনিক তিনটি আলাদা স্টোরেজ এরিয়া করা হয়েছে। এগুলো হলো– রেগুলার ব্যাগেজ স্টোরেজ, লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড এবং ওড সাইজ (অতিরিক্ত ওজনের) ব্যাগেজ স্টোরেজ। যাত্রীদের স্বাভাবিক ওজনের ব্যাগেজের ১৬টি রেগুলার ব্যাগেজ বেল্ট থাকবে টার্মিনালটিতে। অতিরিক্ত ওজনের (ওড সাইজ) ব্যাগেজের জন্য স্থাপন করা হয়েছে আরও চারটি পৃথক বেল্ট।
টার্মিনালের প্রতিটি ওয়াশরুমের সামনে থাকবে একটি করে দৃষ্টিনন্দন বেবি কেয়ার লাউঞ্জ। এ লাউঞ্জের ভেতর মায়েদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং বুথ, ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা এবং একটি বড় পরিসরে ফ্যামিলি বাথরুম করা হয়েছে। এ ছাড়া বাচ্চাদের স্লিপার-দোলনাসহ একটি চিলড্রেন প্লে এরিয়াও রাখা হয়েছে এখানে। ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে হেলথ ইন্সপেকশন রুম, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট-এইড রুম, করোনাসহ নানা রোগের টেস্টিং সেন্টার ও আইসোলেশন এরিয়া।
অত্যাধুনিক এ টার্মিনাল ভবনে থাকবে ১০টি সেলফ চেক-ইন কিওস্ক (মেশিন)। এগুলোতে পাসপোর্ট ও টিকিটের তথ্য প্রবেশ করালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে বোর্ডিং পাস ও সিট নম্বর। এরপর নির্ধারিত জায়গায় যাত্রী তার লাগেজ রাখবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাগেজগুলো উড়োজাহাজের নির্ধারিত স্থানে চলে যাবে। তবে নির্ধারিত ৩০ কেজির বেশি ওজনের ব্যাগেজ নিয়ে এখানে চেক-ইন করা যাবে না। যাত্রীদের জন্য আরও ১০০টি চেক-ইন কাউন্টার থাকবে এ টার্মিনালে।
অবসরে যাত্রীদের সময় কাটানোর জন্য নতুন এ টার্মিনালে শিগগিরই করা হচ্ছে মুভি লাউঞ্জ, এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ। এ দুই লাউঞ্জ বাদে অন্যান্য স্থাপনাগুলো ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে। তবে পরীক্ষামূলকভাবে এখনও এগুলো চালানো হয়নি।