রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে দুই ভাগ করার যে সুপারিশ অর্থনৈতিক কৌশল পুনঃনির্ধারণে গঠিত সরকারের টাস্কফোর্স কমিটি করেছে, সেটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি এই সুপারিশ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনাও করেননি মন্ত্রণালয় বা বিমান বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।
৩ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিমানকে দুই ভাগে বিভক্ত করে একটি অংশ বিদেশি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ বিমান আধুনিক অ্যাভিয়েশনের মান ও পারদর্শিতার (পারফরম্যান্স) মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ। দুর্বল ও অপর্যাপ্ত পরিষেবা নিয়ে চলা বাংলাদেশ বিমান মূলত অভিবাসী শ্রমিকদের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। তাই বিমানকে দুই ভাগ করে নতুন একটি এয়ারলাইনস তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে টাস্কফোর্স। নতুন এ প্রতিষ্ঠানের নাম হবে বাংলাদেশ এয়ারওয়েজ। তারা বাংলাদেশ বিমানের বিদ্যমান সম্পদের অর্ধেক ব্যবহার করবে। আর পরিচালিত হবে স্বাধীন ও বিশ্বমানের একটি পরিচালনা সংস্থার মাধ্যমে।
চলতি মাসের শুরুতে টাস্কফোর্সের এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে টাস্কফোর্সের সুপারিশ থেকে অন্তত একটি করে সুপারিশ প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে বিমানের সংস্কার নিয়ে করা সুপারিশের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, টাস্কফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে এখনই সুনির্দিষ্ট কিছু বলা যাবে না। কারণ, এটির পক্ষে-বিপক্ষে শক্তিশালী মত আছে। ফলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও আলোচনা করতে হবে।
ভাগ করা নিয়ে টাস্কফোর্সের ব্যাখ্যা
টাস্কফোর্সের প্রধান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সময় চেষ্টার পরও বিমানের কোনো সংস্কার হয়নি। এটা এমন এক ব্যর্থ অবস্থায় চলে গেছে যে শুধু সংস্কার করলে আর কাজ হবে না। এ জন্য বিমানকে ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কে এ এস মুরশিদ আরও বলেন, ‘বিমানকে নিয়ে আমরা দুটি উপায় ভেবেছিলাম। প্রথমটি ছিল প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে নতুন প্রতিষ্ঠান করা, তবে সহজে সেটি করা যাবে না। তাই এ চিন্তা থেকে সরে এসে বিমানকে দুই ভাগ করার দ্বিতীয় চিন্তাটি এসেছে। নতুন প্রতিষ্ঠান করে সেটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পেশাগত কোনো কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিমানের সম্পদগুলো (অ্যাসেট) শেয়ার করা হবে। আর উভয় প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যমাত্রা ধরে কাজ করবে; যে ভালো করবে, সে এগিয়ে যাবে। এটি ছিল আমাদের মূল চিন্তা।’
বিমানকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত লাভজনক ও টেকসই হবে বলে মনে করেন কে এ এস মুরশিদ। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু করা উচিত। আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্ত হলে দুটি উপকার হবে। প্রথমত, কিছু কাজ এগিয়ে থাকবে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে সেটি এগিয়ে নিয়ে পারবে। দ্বিতীয়ত, নতুন এই উদ্যোগের ফলে অবস্থার উন্নতির একটা চাপ তৈরি হবে বিমানের ওপর।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ৫৪ বছরের পুরোনো সরকারি এই সংস্থা আমলাদের মাধ্যমে পরিচালিত। একটি বাণিজ্যিক সংস্থা এভাবে চলতে পারে না। তাই অতীতে বিমানকে লাভজনক করার নানা উদ্যোগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।
ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ খাত ক্রমেই বড় হচ্ছে। তাই এ সম্ভাবনাকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহার করতে চাইলে রাষ্ট্রমালিকানায় আরেকটি এয়ারলাইনস করা প্রয়োজন। টাস্কফোর্স যে সুপারিশ করেছে, সেটি অত্যন্ত বিবেচনাপ্রসূত। এটিকে আমাদের সমর্থন করা উচিত।’
অ্যাভিয়েশন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রমালিকানায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় এয়ারলাইনস চালু রয়েছে। ভারতে এয়ার ইন্ডিয়ার পাশাপাশি এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস রয়েছে। একইভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) এমিরেটস ও ফ্লাই দুবাই; সিঙ্গাপুরে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস ও স্কুট এয়ারলাইনস; মালয়েশিয়ায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস ও এয়ার এশিয়া নামে আলাদা আলাদা বিমান পরিবহন সেবা আছে। বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশন খাতের ৭৫ শতাংশ বাজার বিদেশি উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলোর দখলে। চাহিদা আছে বলেই তারা এ দেশে ব্যবসা করছে।
এখন বাংলাদেশ দ্বিতীয় একটি এয়ারলাইনস চালু করলে সেটিকে বাজেট ক্যারিয়ার (সাশ্রয়ী ভাড়ায়) হিসেবে তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে সারা বিশ্বে বাজেট ক্যারিয়ার বেশ জনপ্রিয় ধারণা। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা বিদেশে যান, তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিক। ফলে স্বাভাবিকভাবে তাঁরা যেখানে কম ভাড়া পাবেন, সে এয়ারলাইনসে যাবেন। এ কারণে বিদেশি বাজেট ক্যারিয়ারগুলো ভালো ব্যবসা করছে।
খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও জানান, মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিনিয়ত যাত্রী বাড়ছে। ২০৩৪ সালে সৌদি আরবে যে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে, এর আগে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শ্রমিক যাবেন সেখানে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিমান থেকে আলাদা করে একটা রাষ্ট্রীয় বাজেট ক্যারিয়ার করার এখনই সময়।