সিঙ্গাপুর দেশটির সবচেয়ে বড় অর্থপাচারের ঘটনায় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে বলে সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে। একই সাথে ইঙ্গিত দিয়েছে, অবৈধ অর্থের প্রবাহ রোধ করতে এ ঘটনার পর অভিবাসন বিষয়ক নিয়মনীতি আরো কঠোর করা হতে পারে।
গত মঙ্গলবার দেশটির পার্লামেন্টে এক বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ড মিনিস্টার জোসেফিন টেও জব্দকৃত সম্পদের এই পরিমাণের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, এই তদন্ত চলমান থাকবে এবং একই সাথে অভিবাসন বিষয়ক যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আরো কিভাবে কঠোর করা যায় তা মূল্যায়ন করে দেখবে।
তিনি বলেন, “সিঙ্গাপুর অর্থপাচারের ঘটনা খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখছে। অর্থপাচারের বিষয়ে এবারই আমরা প্রথম কোন আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি তা নয়। আর এটা শেষ ঘটনাও হবে না।”
সিঙ্গাপুর দীর্ঘদিন ধরে স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থা এবং অপরাধের বিষয়ে জিরো টলারেন্সের কারণে সুনাম অর্জন করে এসেছে। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টও হয়েছে।
এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই দেশটি ধনী এশিয়ানদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশটির নিম্ন কর হারের নীতি একে বিশ্বের ধনীদের কাছে বিনিয়োগের জন্য আদর্শ স্থানে পরিণত করেছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার সরকারের বহুল আলোচিত ওয়ানএমবিডি কেলেঙ্কারির সাথে সিঙ্গাপুরের বেশি কিছু ব্যাংক জড়িত থাকার খবর আসে। সে সময় সিঙ্গাপুরের দিকে নজর দেন অনেকে।
ওই ঘটনার পর অর্থপাচারের এই ঘটনাই সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে বিশ্বজুড়ে। এটা মানুষের দৃষ্টি আরো বেশি আকর্ষণ করেছে কারণ যে সম্পদ জব্দ করা হয়েছে তার মধ্যে শতাধিক বাড়ি এবং এর সাথে চীন সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সিঙ্গাপুর একদিকে যেমন অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, একই সাথে অবৈধ অর্থের কেন্দ্র হয়ে উঠার শঙ্কাও বেড়েছে।
আমেরিকা-ভিত্তিক কনসাল্টিং ফার্ম বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ এর তথ্য অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরে গত বছর ক্রস-বর্ডার বা বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এর ফলে সুইজারল্যান্ড ও হংকংয়ের পর সিঙ্গাপুর তৃতীয় বৃহত্তম অফশোর বিনিয়োগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে যেখানে ধনীরা তাদের সম্পদ রাখছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী ক্ল্যান্সি মুর গত অগাস্টে অস্ট্রেলিয়ার এবিসি সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আইনের শাসন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের সুনাম থাকলেও এটা আসলে অর্থপাচারকারীদের ব্যবসা স্থাপনের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছিল।
“সিঙ্গাপুর অপরাধী, প্রতারক এবং চোর শাসকগোষ্ঠীকে তাদের অবৈধ অর্থ রাখার স্থান এবং অপরাধ থেকে পালানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।”
“এটা অনেক আঞ্চলিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর হয়ে উঠেছিল যেখানে খুব কম কর্পোরেট কর দিতে হয় এবং কম্পিউটারের মাউসের মাত্র এক ক্লিকেই মানুষ একটি কোম্পানি গঠন করে ফেলতে পারতো।”
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমরা জানি অনেক সুসংগঠিত অপরাধী গ্যাং এবং মিয়ানমারের জান্তাদের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী সিঙ্গাপুরকে তাদের কালো টাকা সাদা করার কাজে আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতো।”
নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, সিঙ্গাপুরের বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আলভিন ট্যান মঙ্গলবার দেশটির পার্লামেন্টে বলেন, “শক্তিশালী আইনের শাসনসহ একটি বিশ্বস্ত এবং সু-শাসিত আন্তর্জাতিক আর্থিক ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে সিঙ্গাপুরের কষ্টার্জিত সুনাম ঝুঁকির মুখে পড়েছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য দুটি। একটি হচ্ছে একটি বহুমাত্রিক, সমৃদ্ধ, অর্থনৈতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা। আরেকটি হচ্ছে একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থা ধরে রাখা। এই দুটি বিষয় পাশাপাশি পরিচালিত হবে। কোনোটির জন্য আমরা কোনোটি ত্যাগ করবো না।”
সিঙ্গাপুরে থাকা বাংলাদেশি সাংবাদিক এ কে এম মহসীন বলেন, তিনি মনে করেন, অর্থনৈতিকভাবে সিঙ্গাপুর এখন একটি ভাল অবস্থানে পৌঁছে গেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি ছাড়াও বেশি কিছু বিষয়ে সুনাম অর্জন করেছে দেশটি।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কোভিড মহামারির সময় অভিবাসী শ্রমিকদের ভালভাবে ব্যবস্থাপনার কারণে বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে।
তিনি মনে করেন, অভিবাসন ইস্যুটা সামলানোর পর এখন তারা অর্থপাচারের দিকে নজর দিয়েছে।
এছাড়া সারা বিশ্বে সিঙ্গাপুরে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসেবে যে পরিচিতি রয়েছে সেখান থেকেও দেশটি বেরিয়ে আসতে চাইছে বলে মনে করেন তিনি।
“ওয়ার্ল্ডে একটা ব্যাড ইম্প্রেশন আছে যে সিঙ্গাপুরে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ ও লেনদেন হয়। ওই দুর্নামটা স্খলনের জন্য তারা কিছুটা কাজ করতেছে,” বলেন তিনি।
সিঙ্গাপুরে অর্থপাচারের অভিযোগে এ পর্যন্ত পুলিশ যে ১০ জন বিদেশীকে গ্রেফতার করেছে তাদের কাছে বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট থাকলেও তারা সবাই চীনা বংশোদ্ভূত বলে জানা যাচ্ছে।
এক নারীসহ গ্রেফতারকৃত ১০ জনের মধ্যে তিন জন চীনের, তিন জন কম্বোডিয়ার, একজন ভানুয়াতুর, একজন তুরস্কের এবং দুই জন সাইপ্রাসের নাগরিক।
তবে এবিসি নিউজের প্রিবেদনে বলা হয়, এরা সবাই আসলে চীনের ফুজিয়ান প্রদেশ থেকে এসেছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এবং সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, চীন সরকারের পক্ষ হয়ে সম্পদ জব্দের এই অভিযান পরিচালনা করেছে সিঙ্গাপুর।
সিঙ্গাপুরের সরকার অবশ্য বলেছে, সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে যে বেশ কয়েক জন চীন বংশোদ্ভূতকে আটক করেছে সে বিষয়ে চীনের কোন চাপ ছিল না।
এবিষয়ে মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ড মিনিস্টার জোসেফিন টেও পার্লামেন্টে বলেন: “আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় অনেক সংবাদ মাধ্যমে কিছু ‘ধারণা’ প্রকাশ করা হয়েছে যে, সিঙ্গাপুর হয়তো চীনের পক্ষ থেকে এই অভিযান পরিচালনা করেছে। এটা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা।”
মিজ টেও বলেন, দুই বছরের ধরে তদন্ত চালানোর পর তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ মনে করে, এসব অর্থ তারা সিঙ্গাপুরের বাইরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেমন জুয়া, অবৈধ অনলাইন গেম, অবৈধভাবে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে আয় করেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে জালিয়াতিরও অভিযোগ আনা হয়েছে।
নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, মিজ টেও সম্প্রতি পার্লামেন্টে বলেন, “সিঙ্গাপুরকে অন্য কোন দেশের বলার দরকার হয় না যে আমাদের আইন প্রয়োগ করতে হলে কী করতে হবে, আর আমাদের নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট না হলে আমরাও সেটা করি না। এখানে আমরা তদন্ত শুরু করি কারণ আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে, অপরাধগুলো সিঙ্গাপুরেই সংগঠিত হয়েছে।”
তবে অর্থ পাচারের তদন্তে চীনের সহায়তা নেয়া হয়েছিল কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাননি বলে সিঙ্গাপুরের সংবাদ মাধ্যম গাটজি এশিয়ার একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বিদেশি কোন আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়টি জানানোর অনুমোদন নেই তার। তবে একাধিক বিচারব্যবস্থার সহযোগিতা রয়েছে এবং চীন ছাড়াও অন্য কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছ থেকে সহায়তা নেয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গত অগাস্টে প্রাথমিক অবস্থায় যেসব সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল সেগুলোর মূল্য ছিল আনুমানিক এক বিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ড মিনিস্টার জোসেফিন টেও মঙ্গলবার পার্লামেন্টে বলেন, এই সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে এবং এখন সেগুলোর মূল্য প্রায় ২.৮ বিলিয়ন ডলার।
এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১৫২টি স্থাপনা, ৬২টি যানবাহন যাদের আর্থিক মূল্য প্রায় ১.২৪ বিলিয়ন ডলার। মদ এবং ওয়াইনের হাজার হাজার বোতল, ব্যাংকে জমা রাখা অর্থ যার পরিমাণ প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার। ৩৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্রিপ্টোকারেন্সি, ৬৮টি স্বর্ণের বার, ২৯৪টি ল্যাক্সারি ব্যাগসহ আরো অনেক কিছু।
সিঙ্গাপুর সরকার বলছে, সন্দেহভাজনদের মধ্যে অনেকে যে উচ্চ মূল্যের সম্পদ যেমন গাড়ি, মদ বা গহনা কিনেছে সেগুলো সিঙ্গাপুরের আইনের আওতায় পড়ে না। কারণ সেগুলো মূল্যবান পাথর নয়।
এমন অবস্থায় দরকার পড়লে অর্থপাচার বিরোধী নিয়ম-নীতিতে পরিবর্তন আনা দরকার কী না সেটিও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে সরকার।
সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ড মিনিস্টার জোসেফিন টেও দেশটির পার্লামেন্টে অর্থ পাচার সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেন।
সেখানে তিনি বলেন, ২০২১ সালেই দেশটির কর্তৃপক্ষ নানা ধরণের সংকেত পায়। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থের উৎস প্রমাণ করতে নকল নথি বানানো হয়েছে বলে সন্দেহ ছিল।
বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানি সন্দেহজনক অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে অভিযোগ করেছিল। আর এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশ।
বিবিসি বাংলা