সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পূর্বাহ্ন

বিদেশে ভবিষ্যৎ গড়তে পাকিস্তানি অভিবাসীদের ভয়ংকর ‘গেইম’

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩

সম্প্রতি লিবিয়া থেকে ইটালি পৌঁছতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে নিহত হয়েছেন মুহাম্মদ নাদিম এবং আলী হাসনাইন নামের দুই পাকিস্তানি অভিবাসী। নিহত দুই ব্যক্তির এলাকা সফর করে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেন এএফপির সাংবাদিকেরা। ইউরোপের পথে পাকিস্তানি অভিবাসীদের ভয়ংকর ‘গেইম’ এর পেছনের কারণ পড়ুন প্রতিবেদনে।

‘গেইম’ ইউরোপের পথে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশী ও আশ্রয়প্রার্থীদের কাছে দৈনন্দিন ব্যবহৃত একটি শব্দ। লিবিয়া থেকে ইটালিরর রুট, বলকান রুট কিংবা গ্রিক তুর্কি-সীমান্ত সর্বত্র আলোচিত এই’ গেইম’ শব্দটি।

মূলত ‘গেইম’ মানে অনিয়মিত উপায়ে ইউরোপের পথে স্থল কিংবা নৌ সীমান্ত পাড়ি দেয়া। এক্ষেত্রে অভিবাসীরা অনেক সময় নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করলেও প্রায়শই পাচারকারীদের সহায়তা নিতে বাধ্য হন।

তেমনই একজন পাকিস্তানি নাগরিক আলী হাসনাইন। একটি উন্নত জীবনের জন্য পশ্চিমে দীর্ঘ যাত্রার পথে নিহত হওয়া এই অভিবাসীর পোশাকসহ নানা ব্যক্তিগত জিনিস বার্তা সংস্থা এএফপির সাংবাদিকদের দেখালেন তার পরিবারের সদস্যরা।

অপরদিকে, আরেক পাকিস্তানি মুহাম্মদ নাদিম পূর্ব পাকিস্তানে নিজ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তার মায়ের কাছে ইউরোপের পথে নিরাপদ ভ্রমণের জন্য দোয়া চেয়েছিলেন। তারপর তার মা আপত্তি করার আগেই বাড়ি ছেলে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

মুহাম্মদ নাদিম এবং আলী হাসনাইন উভয় ব্যক্তিই পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরাট থেকে যাত্রা করেছিলেন। যদিও তারা একে অপরকে আগে থেকে চিনতেন না। পাকিস্তানের দ্রুত অবনতিশীল অর্থনীতি থেকে পালিয়ে মানবপাচারের পথে সহযাত্রী হয়ে ওঠেন তারা।

তারা দুইজনই গত মাসে ইউরোপ মহাদেশের দোরগোড়ায় এসে মারা গেছেন। তাদের আত্মীয়রা বলছেন, লিবিয়া থেকে একটি নৌকায় চড়ে ইটালির পথে যাত্রা করেছিলেন। যাত্রার পর বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক অভিবাসী রুট ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবে মারা যান তারা।

নাদিমের মা কাউসার বিবি বলেন,

আমরা যখন প্রথম খবরটা শুনি তখন যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তখন তার স্ত্রী অন্য ঘরে ছিল।

তিনি তাদের পারিবারিক বাড়িতে এএফপিকে বলেন, “আমি আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।”

পাকিস্তানের নাজুক অর্থনীতি

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান অর্থনৈতিক অস্বস্তিতে পড়েছে। কয়েক দশকের অব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটি এক ভয়াবহ মন্দা পার করছে। ডলারের রিজার্ভ কমে যাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গিয়েছে। যার ফলে ব্যাপকভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

পাকিস্তানের এই মরিয়া পরিস্থিতি দেশটির নাগরিকদের ইউরোপের বিপজ্জনক ও ভয়ংকর পথে অবৈধ ‘গেইমের’ দিকে যেতে উদ্দীপনা তৈরি করছে।

৪০ বছর বয়সি নাদিম কয়েক সপ্তাহ আগে দুবাই, মিশর এবং লিবিয়া হয়ে ইটালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। এর আগে তিনি দেশে তার স্ত্রী এবং তিন ছেলের ভরণপোষণ যোগাতে একটি আসবাবপত্রের দোকানে প্রতিদিন মাত্র ৫০০ থেকে ১০০০ পাকিস্তানি রূপি ($১.৮০ থেকে $৩.৬০) বেতনে কাজ করতেন৷

তার ভাই ২০ বছর বয়সি মুহাম্মদ উসমান বলেন, “আমি খুশি ছিলাম কারণ তিনি তার সন্তানদের জন্য যাচ্ছেন, এটি তাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করবে।”

দালালদের পরিশোধ করার জন্য ২২ লাখ পাকিস্তানি রুপি বা ৮ হাজার ইউরোর অর্থ বিভিন্ন উপায়ে যোগাড় করে নাদিম তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের প্রত্যাশা করছেন।

লিবিয়া থেকে তিনি জানিয়েছিলেন, “সমুদ্র শান্ত এবং কোন সমস্যা নেই। আমি গেইমের মধ্যে আছি।”

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর নৌকাডুবির প্রায় দুই সপ্তাহ পর তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এদিকে, হাসনাইনের পরিবার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর আগেই তাদের মৃত ছেলের ছবি দেখে ২২ বছর বয়সি এই যুবকের মৃত্যুর কথা জানতে পেরেছিল।

শোকের হাহাকার কাটিয়ে তার দাদা ৭২ বছর বয়সি মুহাম্মদ ইনায়াত বলেন,

আমরাও বিশ্বাস করে তাকে পাঠাতে সম্মত হয়েছিলাম। কারণ এখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এজেন্টদের হটস্পট

পাকিস্তানের গুজরাট অঞ্চল বাংলাদেশ সিলেট বিভাগের ন্যায় দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপগামী অভিবাসীদের জন্য একটি আলোচিত অঞ্চল।

৬০-এর দশকে একটি ব্রিটিশ ফার্ম গুজরাটে একটি বিশাল জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করেছিল। যা ১০ হাজারেও বেশি লোককে বাস্তুচ্যুত করেছিল। পরবর্তীতে এসব নাগরিকেরা শ্রমিক হিসাবে যুক্তরাজ্যে আমন্ত্রিত হয়েছিল।

সেই সময় পাকিস্তানি অভিবাসীদের অর্জিত সম্পদ পরিবারগুলিকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল। পাকিস্তান প্রবাসীরা ইউরোপে নিজস্ব কমিউনিটি স্থাপন করে আত্মীয়স্বজনদের জন্য বৈধ অভিবাসনের দ্বার খুলে দিয়েছিল।

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর সারা বিশ্বে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে মানবপাচারকারীর সংখ্যা ও ক্ষমতা বাড়তে শুরু করে।

বর্তমানে গুজরাট শহর এবং এর শহরতলীগুলো মানবপাচারে জড়িত এজেন্টদের জন্য একটি হটস্পট হিসাবে পরিচিত। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথে গ্রাহকদের পাচার করে বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নেয়।

নাদিম এবং হাসনাইনের চূড়ান্ত যোগাযোগ ইঙ্গিত করে যে তারা হয়ত একই নৌকায় ছিলেন না। তবে তাদের একটি ভিডিওতে একসঙ্গে দেখা গেছে।

দালারদের ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রায় ডজন খানেক অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় পুরুষের সাথে একটি সাদা ঘরে কম্বল গায়ে দিয়ে তারা বসে আছেন৷

এ সময় ভিডিওতে দালালরা জিজ্ঞেস করে, “আমরা আপনাদের একটি ছোট নৌকায় পাঠাচ্ছি। আপনি কি নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছেন নাকি কেউ আপনাকে জোর করে পাঠাচ্ছে?’’

উপস্থিত পুরুষরা অস্বস্তিতে উত্তর দেয়, “কেউ আমাদের জোর করেনি। ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমরা ইটালি পৌঁছাব।”

নাদিমের ভাই উসমান বলেন, “মানবপাচারকারীরা পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যার সুযোগ নিচ্ছেন।”

কিন্তু গুজরাটের একজন এজেন্ট পরিচয় গোপনের শর্তে এএফপিকে বলেন, তাদের কর্মকান্ড ‘ইতিবাচক প্রভাব’ তৈরি করছে।

তিনি বলেন, “আপনার কাছে কি অন্য কোন বিকল্প আছে যা এত দ্রুত স্থানীয়দের জীবনকে উন্নত করতে পারে? তারা আমাদের কাছে স্বপ্ন নিয়ে আসে এবং আমরা সেগুলি পূরণ করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করি। তবে এর সাথে অন্তর্নিহিত ঝুঁকি জড়িত।”

‘রাজকীয় জীবনধারা’

ইউরোপ-ভিত্তিক গবেষণা গোষ্ঠী মিক্সড মাইগ্রেশন সেন্টারের ২০২২ সালের জরিপ অনুসারে, সম্প্রতি ইটালিতে আসা প্রায় ৯০ শতাংশ পাকিস্তানি মানবপাচার চক্র ব্যবহার করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিস্তানের ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছর পাকিস্তান থেকে আনুমানিক ৪০ হাজার অবৈধ ভ্রমণের চেষ্টা করা হয়।

স্পেন সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, দুই বছর ধরে দেশটিতে বসবাসকারীরা অস্থায়ীভাবে বসবাস এবং আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রম বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।

অন্যদিকে ইটালি অনথিভুক্ত অভিবাসীদের কর্মসংস্থানকে ‘নিয়মিত’ করার জন্য একটি স্কিম চালু করেছে।

গুজরাটের স্থানীয় রাজনীতিবিদ ফারুক আফগান বলেন,

এটি আমাদের হতাশ করে এবং এটা লজ্জাজনক। কেউ তার দেশ ছেড়ে যেতে চায় না। কিন্তু দারিদ্র্য, অনাচার এবং ক্ষুধা মানুষকে দেশান্তর করতে বাধ্য করে।

বিদেশে বসবাসকারীরা স্বদেশে ফিরে আত্মীয়দের জন্য অনেকসময় একটি ‘রাজকীয় জীবনধারা’ তৈরি করতে সক্ষম হন। যা নতুন অভিবাসীদের তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য প্রলুব্ধ করে।

গুজরাটের বাইরে ভাক্রেভালি গ্রামটি অনেকটা সাদা এবং প্যাস্টেল রঙের প্রাসাদে ভরা। যা অনেকটা দেখতে বিয়ের সাদা কেকের মতো। গ্রামটিতে রয়েছে অনেক গমের ক্ষেত।

একজন স্থানীয় মন্তব্য করেন,

এই গ্রামে আপনি এমন একটি বাড়িও পাবেন না যেখানে তারা তাদের পরিবারের একজন যুবককে ইউরোপে পাঠানোর চেষ্টা করেনি।

স্থানীয় বাসিন্দা মালিক হক নওয়াজ একসময় একজন কৃষক ছিলেন। কিন্তু তিন ছেলেকে স্পেনের বার্সেলোনায় পাঠানোর পর এখন তার বাড়ির সামনে একটি নতুন চার চাকার উঁচু জিপ গাড়ি পার্ক করা আছে। পাশাপাশি তৈরি করেছেন নিজস্ব ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং সেটি সোনালি রংয়ের আসবাবপত্র দিয়ে সাজিয়েছেন।

তার তিন সন্তানের একজন বৈধভাবে ইউরোপে গিয়ে অভিবাসী হয়েছিলেন। কিন্তু বাকি দুইজন ২০০৬ ও ২০২০ সালে এজেন্টদের মাধ্যমে অনিয়মিত উপায়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছিলেন।

নওয়াজ বলেন, ‘‘এখন তার সব সন্তানের বার্সেলোনায় কাজের অনুমতি রয়েছে।’’

তার সন্তানেরা সেখানে অত্যন্ত মিতব্যয়ী জীবনযাপন করে প্রতি মাসে দেশে চার হাজার তিনশ ইউরো বা ১২ লাখ পাকিস্তানি রুপি রেমিট্যান্স পাঠান।

নওয়াজের প্রতিবেশী ফাইজান সেলিম স্পেনে অভিবাসনের চেষ্টা করলেও তাকে তুরস্ক থেকে একাধিকবার পুশব্যাক করা হয়েছিল। ব্যর্থ হয়ে কয়েক হাজার ডলার আর্থিক ক্ষতিতে পড়েন তিনি।

এই ২০ বছর বয়সি তরুণ বলেন,

ভূমধ্যসাগরের সাম্প্রতিক নৌকাডুবির খবর শুনে আমি অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলাম। তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা তাদের সেই পথে যেতে বাধ্য করেছিল।

এএফপি, ফ্রান্স২৪

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com