গন্তব্যস্থল সম্পর্কে যতো বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করি। কোনো প্যাকেজের অধীনে যাওয়ার চেয়ে নিজের মতো করে পারিকল্পনা করাকেই বেশি প্রাধান্য দেই। যদিও ব্যাপারটা প্যাকেজে ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ভালোভাবে তথ্য সংগ্রহ করে, সুন্দর পরিকল্পনা করে বের হলে ভ্রমণের আনন্দ অনেক বেড়ে যায়।
বিদেশ যাওয়ার সময় সেই দেশ বা শহর সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ভ্রমণকে অনেক সহজ করে তোলে এবং সর্বোপরি প্যাকেজের ওপর নির্ভর না করে নিজ পরিকল্পনায় ঘুরতে গেলে অনেক আত্মবিশ্বাসী থাকা যায়।
আমার এবারের ট্রিপের সঙ্গী ছিল দু’জন। সুমন ও রবিন। আমরা তিন জন মালিন্দো এয়ারে রাত সাড়ে ৯টার ফ্লাইটে চড়ে বসলাম। বালিতে সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ৬ ঘণ্টার ট্রানজিট বিরতিতে অপেক্ষা করতে হলো।
কুয়ালালামপুর থেকে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা ওড়ার পর আমরা নিচে দেখতে পেলাম গাঢ় নীল পানি ঘেরা অসম্ভব সুন্দর দ্বীপ, বালি।
রাজধানী জাকার্তাকে ধারণ করা ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ জাভার ঠিক দক্ষিণেই বালির অবস্থান। বালি ইন্দোনেশিয়ার ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ক্ষুদ্রতম প্রদেশ, যার আয়তন মাত্র ৫ হাজার ৭৮০ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা ৪২.২ লাখ। বালির রাজধানীর নাম ডেনপাসার (Denpasar)।
তিন দশক আগেও বালি পুরোপুরি কৃষি নির্ভর ছিল। কিন্তু বর্তমানে বালির মোট অর্থনীতির ৮০ শতাংশ পর্যটন শিল্পের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং একে ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম ধনী প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম বসবাসকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া হলেও বালির চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। বালিতে বসবাসকারীদের মধ্যে ৮৪.৫ শতাংশই হিন্দু এবং মন্দিরের আধিক্যের কারণে বালিকে বলা হয় দেবতাদের দ্বীপ, শান্তির দ্বীপ।
বালিতে অবস্থানকালে প্রতি মুহূর্তেই আমাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। এয়ারপোর্টের রানওয়েতে রোমাঞ্চকর ল্যান্ডিং দিয়েই আমাদের চমৎকার অভিজ্ঞতার শুরু হলো। এয়ারপোর্টের রানওয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে সাগরের মাঝে চলে আসায় আমাদের মনে হচ্ছিল বিমান বুঝি সাগরেই অবতরণ করছে। এটা ছিল আমার সেরা ল্যান্ডিং অভিজ্ঞতা।
ইমিগ্রেশন, কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এয়ারপোর্টের বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটি বালিনিজ মেয়ে ফুল দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো, ‘welcome to Bali প্রত্যেক পর্যটককে বালিনিজরা এভাবেই স্বাগতম জানায়।
এয়ারপোর্টেই সরকারিভাবে ট্যাক্সির ব্যবস্থা আছে। যদিও বাইরে থেকে অনেকেই ট্যাক্সিই আসে আপনাকে স্বাগত জানাবে বলে। তবে তাদের আহ্বানে সাড়া দিলে ৩ গুণ বেশি ভাড়া গুণতে হতে পারে।
আমি আগেই হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের হোটেলের নাম The Oasis। এটি বালির সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এলাকা কুটায় (kuta) অবস্থিত। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দূরত্ব সাড়ে ৩ কি.মি.। আমাদের ট্যাক্সি ভাড়া আসল ৮০,০০০ রুপিয়া। প্রতি ডলারের বিনিময়ে আমরা ১১ হাজার ২৫০ রুপিয়া পেয়েছিলাম। ইন্দোনেশিয়ায় সর্বোচ্চ ১ লাখ রুপিয়ার নোট পাওয়া যায়। পরবর্তী তিন দিন এই লাখ লাখ রুপিয়ার হিসেব-নিকেশ করতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে।
দুপুর ২টায় আমরা হোটেলে চেক-ইন করলাম। আমার দুই সফরসঙ্গী আমার ওপর পুরো ভ্রমণ পরিকল্পনার দায়িত্ব দেওয়ায় হোটেল বুকিং দেওয়ার আগে আমাকে অনেক ভাবতে হয়েছে। হোটেলে ঢুকেই মনে হলো, হোটেল নির্বাচন সঠিক হয়েছে। তিন বেডের একটি রুমের জন্য প্রতি রাতের ভাড়া ৬৫ ডলার দিতে হয়েছে। ৮০ ফুট লম্বা সুইমিংপুল এবং অন্যান্য চমৎকার সুবিধাসম্বলিত থ্রি-স্টার মানের হোটেলের ভাড়া আমাদের কাছে কমই মনে হলো।
সর্বমোট সাড়ে সাত ঘণ্টার ফ্লাইট এবং মধ্যে ৬ ঘণ্টার ট্রানজিট বিরতির কারণে আমরা তখন খুবই ক্লান্ত। খাবারের অর্ডার দিয়ে রুমেই পাঠাতে বললাম। অর্ডার মতো ৩ জনের জন্য ভিন্ন ধরনের খাবার আসলো। প্রথমবারের মতো ইন্দোনেশিয়ার খাবারের স্বাদ নিলাম। সমগ্র ইন্দোনেশিয়া তথা বালিতে আমাদের দেশের মতো ভাতই হচ্ছে প্রধান খাবার। তবে ইন্দোনেশিয়ানরা তরকারিতে প্রচুর মসলা এবং খাবার পরিবেশনে এক ধরনের সস ব্যবহার করে। তবে তা খেতে মন্দ নয়, বেশ ভালোই লাগে।
মুরগি, মাছ, কাবাব ইত্যাদি আলাদা আইটেম দিয়ে খেয়ে আমাদের বিল হলো ১ লাখ ৪৭ হাজার রুপিয়া যা আমাদের টাকার হিসেবে ১ হাজার ৫০ টাকার মতো। বালি তার নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ভালো থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে বলেই পৃথিবীর নামকরা একটি পর্যটনবান্ধব দ্বীপ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুরে একই মানের থাকা, খাওয়ার জন্য প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়।
খাওয়ার পর ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে বিকেল পাঁচটার দিকে সূর্যাস্ত দেখার উদ্দেশ্যে সমুদ্র সৈকতের দিকে পা বাড়ালাম। অক্টোবরের ৩য় সপ্তাহে বালিতে সোয়া ছয়টায় সূর্যাস্ত হয়। বালির বিশ্ববিখ্যাত কুটা সমুদ্রসৈকত আমাদের হোটেল থেকে মাত্র ৩/৪ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম চারদিকে প্রচুর বিদেশির আনাগোনা। বালিতে এক চতুর্থাংশের বেশি ভ্রমণকারী অস্ট্রেলিয়ান। ভৌগোলিক কারণে অস্ট্রেলিয়া বালির খুব কাছাকাছি অঞ্চল হওয়ায় এমনটা হতে পারে। সমুদ্র সৈকতে পৌঁছে দেখলাম অনেকেই সূর্যাস্ত দেখতে এসেছে।
বালির কুটা সমুদ্র সৈকতের পানির রং গাঢ় নীল। দেখতে দেখতে মনে হলো কুটা সমুদ্র সৈকত সুন্দর হলেও আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য কোনো অংশেই এর চেয়ে কম নয়।
সাগরে নামার ব্যাপারটা সেই সময়ের জন্য স্থগিত রেখে সূর্যাস্তের পর আমরা কুটা শহর দেখার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। কুটার রাস্তা খুব বেশি প্রশস্ত নয় এবং রাস্তায় প্রচুর মোটরসাইকেল দেখতে পাওয়া যায়। এখানে আরেকটা মজার বিষয় হলো, চালকদের অনকেই নারী। আমাদের দেশে যা বলতে গেল কল্পনাই করা যায় না।
আমরা ২ ঘণ্টার মতো হেঁটে শহর দেখে বার্গার কিং থেকে বার্গার খেয়ে রাত প্রায় দশটায় হোটেলে ফিরলাম। হোটেলে ফিরেই সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে সুইমিং পুলে নেমে শরীর এলিয়ে দিলাম।
পরদিন সকালে ১০টায় নাস্তা করতে করতেই আমাদের গাড়ি হাজির। আগের রাতেই হোটেল ম্যানেজার রামাকে সারাদিনের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম। বালিতে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ রুপিয়া হলে সারাদিনের জন্য Toyota avaûa ধরনের ৭ জন বসার মতো গাড়ি পাওয়া যায়। আমরা অন্যন্য সুন্দর একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ এবং দু’টি দর্শনীয় স্থানের প্রবেশ মূল্যসহ সারাদিনের জন্য ৯ লাখ রুপিয়াতে গাড়ি নিয়ে নিলাম। আমাদের গাড়ি কুটার রাস্তা পার হয়ে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত রাস্তা ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকল।
রাস্তায় দু’ধারে বালিনিজদের অত্যন্ত দৃঢ় সংস্কৃতির ছাপ চোখে পড়ল। বালিনিজরা ঐতিহ্যে খুব বিশ্বাসী। বাড়ির মূল ফটকে ওরা এমন স্থাপত্য শিল্প ব্যবহার করে যা দেখলে একশ’ বছরের পুরোনো মনে হয়। ফুল এবং বাঁশের ব্যবহার সর্বত্র চোখে পড়ার মতো। বাঁশকে নানাভাবে সাজিয়ে বিভিন্ন বাড়ি, মন্দির, দোকান ইত্যাদিতে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
রাস্তার দু’পাশে কাঠের, মাটির, পাথরের তৈরি অবাক করা বিভিন্ন কারুকাজখচিত শিল্প বারবার নজর কাড়ছিল। বালিতে তেমন কোনো সুউচ্চ ঘর-বাড়ি আমাদের চোখে পড়েনি।
শহরের কেন্দ্র ছাড়া অন্যান্য সকল এলাকার প্রায় সব বাড়ি-ঘরই ২/৩ তলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের গাড়ি Sari dewi নামে একটি সোনা-রূপার অলঙ্কার বানানোর কারখানা কাম শো-রুমে এসে থামলো।
আগ্রহ না থাকায় সেখানে আমরা বেশি সময় দিলাম না। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কুটা থেকে ৬৪ কি.মি. উত্তর-পূর্বের একটি অঞ্চল যার নাম কিন্তামানি (kintamani)। এটি একটি পাহাড়ি এলাকা এবং উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৪ হাজার ৫০০ ফুট।
কিন্তামানি অঞ্চলের বাতুর (mount batur) নামের জীবন্ত আগ্নেয়গিরি এবং সেই পাহাড় ঘেষা বাতুর হৃদ (lake batur) দেখতেই সেখানে গেলাম আমরা। গন্তব্যে পৌঁছেই আমার মনে হলো এতো সুন্দর জায়গা হয়তো খুব কম আছে। আরও মনে হলো, বালি আসা পুরোপুরি সার্থক।
দুপুর হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে বসে চারপাশের অপূর্ব সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম যে, এটা আমার জীবনের সেরা সুস্বাদু লাঞ্চ না হলেও একে most beautiful lunch হিসেবে অবশ্যই গণ্য করা যায়। তবে সেই ব্যুফে লাঞ্চের খাবারের স্বাদও বেশ ভালো ছিল। আমরা চমৎকার সেই জায়গায় বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা।
বাতুর পাহাড় ও হৃদকে পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কুটা এবং কিন্তামানির মাঝামাঝি এলাকা ‘উবুদ (Ubud)’।
রাস্তায় একটি কফি তৈরির কারখানায় ঢুকলাম কফির আদ্যোপান্ত জানার জন্য। সেখানে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের ৮ রকমের কফি পরিবেশন করা হলো। বিচিত্র সব স্বাদের কফির স্বাদ নিলাম আমরা। সেখানে দেখলাম পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কফি কিভাবে তৈরি হয়।
লুয়াক (Luwak) নামের বিড়ালসদৃশ একটি প্রাণীকে কফিবেরি খাওয়ানো হয় এবং তাদের মলের সঙ্গে আস্ত কফিবেরি বেরিয়ে আসে। এ পক্রিয়ায় কফিবেরির তিতা ভাবটা কমে এবং সুঘ্রাণযুক্ত হয়। এভাবে প্রাপ্ত কফিবেরি থেকে যে কফি তৈরি হয়, তা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কফি। প্রতি কাপ কফির দাম বাংলাদেশি টাকার হিসাবে ২ হাজার ৫০০ টাকা। আমরা ৮ রকম কফির স্বাদ নিলেও এতো দামি কফি খাওয়ার সাহস করলাম না।
এই ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার পর আমরা উবুদ এর দিকে এগুতে থাকলাম। উবুদে আমাদের মূল দেখার বিষয় ছিল পাহাড়ের গায়ে জুম চাষের আকারের অপূর্ব সুন্দর ধানক্ষেত। পর্যটন বালির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি হলেও বেশি সংখ্যক মানুষ এখনও কৃষি কাজের ওপর নির্ভশীল। বালির কৃষিকাজের সিংহভাগ দখল করে আছে ধানচাষ। ধানচাষটা সুন্দরভাবে করায় এটাও একটা উল্লেখ্যযোগ্য পর্যটক আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে যেন সৃষ্টিকর্তার নিজের হাতে সযত্নে আঁকা কোনো ছবি। ছবি সদৃশ সেই জায়গা থেকে অনেক ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে চললাম। তখনও সন্ধ্যা হতে কিছু সময় বাকি থাকায় হোটেলে ফেরার আগে বালির পূর্বপ্রান্তের অন্য একটি সমুদ্র সৈকতে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম।
সাগরে সাঁতার কাটা দিয়ে বালিতে আমাদের তৃতীয় দিনের কার্যক্রম শুরু হলো। বেলা ১১টায় আমরা কুটা সমুদ্র সৈকতে নামলাম। এখানে ঢেউয়ের উচ্চতা বেশ ভাল। অস্ট্রেলিয়ান সার্ফারদের স্বর্গ হচ্ছে বালির এই সমুদ্র সৈকত। আমি এবং সুমন সাগরে সাঁতার কেটে সামনের দিকে এগুতে থাকলাম। আমাদের অপর সঙ্গী রবিন অবাক চোখে আমাদের এগিয়ে যাওয়া দেখতে থাকলো।
তীর থেকে প্রায় ২০০ গজের মতো দূরে ২ জন অস্ট্রেলিয়ান পুরুষ ও নারী ভাসছিলেন। আমরা ওদের অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে এগোলাম এবং কাছে গিয়ে দেখি ওদের ২ জনের সঙ্গেই সার্ফবোর্ড রয়েছে। ওরা অবাক হয়ে সাগরের মাঝে আমাদের সাঁতার কাটা দেখছেন। আমরা বুঝলাম যে, না বুঝে বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেছে। মুখ, নাক, কান দিয়ে পানি প্রবেশ করিয়ে তীরে ফিরে আসতে আমাদের বেশ কষ্টই হলো।
সাগরে নামার উদ্দেশে যাওয়া বলে আমরা মোবাইল, ক্যামেরা কিছুই নেইনি। অনেক খোঁজাখুজি করেও আমাদের ছবি তোলার মতো ক্যামেরাওয়ালা পাওয়া গেল না। বেলা ১টায় আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আগের কথা মতো গাড়ির চালক মেডি তার গাড়ি নিয়ে হোটেলে অপেক্ষা করছিল। আমরা হোটেলে লাঞ্চ সেরে ২টার দিকে আবারও বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য কুটা থেকে ২০ কি. মি. উত্তর পশ্চিমে তানাহ্ লট (Tanah Lot) নামের মন্দির।
বালিতে পর্যটকদের দেখার যে সমস্ত স্থাপনা আছে তার বড় অংশ জুড়ে আছে বিভিন্ন মন্দির। যেহেতু মন্দিরের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম তাই শুধু এই একটি মন্দিরকেই আমাদের তালিকায় রেখেছিলাম। এটি দেখতে যাওয়ার কারণ হচ্ছে এর অবস্থান। মন্দিরটি সাগরতীরে একটি বড় পাথর খণ্ডের ওপর অবস্থিত এবং জোয়ারের সময় মন্দিরটিকে একটি ছোট দ্বীপের মতোই দেখায়। তিনজনের জন্য ৯০ হাজার রুপিয়া দিয়ে টিকিট কেটে আমরা মন্দির এলাকায় প্রবেশ করলাম। মূল মন্দিরের ভেতরে ঢোকার অনুমতি না থাকলেও মন্দিরের স্তম্ভে¢র অর্থাৎ পাথর খণ্ডের একটি উচ্চতা পর্যন্ত ওঠা যায়। তবে পবিত্র পানি দিয়ে হাত, মুখ ধুয়ে কিছু রুপিয়া দান করার পরই সেটা সম্ভব।
পবিত্র পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পর মন্দিরের সেবকরা আমাদের কানে ফুল ও কপালে কয়েকটি চাল লাগিয়ে ওপরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। আমরা কিছু ছবি তুলে তানাহ্ লট থেকে বিদায় নিলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য তানাহ লট থেকে ৪০ কি. মি. দক্ষিণের উলুওয়াটু (uluwatu)। এটি বালির সর্ব দক্ষিণের একটি এলাকা। আমাদের উদ্দেশ্য বিখ্যাত উলুওয়াটু সানসেট পয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত দেখা।
আমরা ৩ জন ৬০ হাজার রুপিয়া দিয়ে টিকিট কেটে উলুওয়াটু সানসেট পয়েন্ট এলাকায় প্রবেশ করলাম। এ এলাকায় বানরের উপদ্রব খুব বেশি। আমরা যখন ছবি তোলায় ব্যস্ত, তখন এক দুষ্টু বানর আমাদের সঙ্গী রবিনের সানগ্লাস কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। রবিন তার গালে একটু ব্যথাও পেল। আমরা সূর্যাস্ত দেখার জন্য যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেটা সাগরের পাশেই অনেক উঁচু একটি পাহাড়। নিচে সাগরের পানি এসে পাথরে আছড়ে পড়ছে। ওপর থেকে নিচে তাকালে রীতিমতো ভয় লাগে। সাগর, পাহাড়, সবুজ বননী এবং সূর্যাস্ত সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে।
উলুওয়াটুর এই জায়গাটি বালি সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নাচ কেকাক (kecak) পরিবেশনার জন্য বিখ্যাত। সূর্যাস্তের পর পরই কেকাক এবং আগুন নাচ শুরু হয়। আমরা ২ লাখ ১০ হাজার রুপিয়া দিয়ে তিনটি টিকিট কেটে বালির এই ভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক নাচ উপভোগ করতে বসে গেলাম। এটি মুক্তমঞ্চে পরিবেশিত হয় এবং দর্শক গ্যালারিতে পর্যটকদের এতো ভিড় যে সূচ ধারণের জায়গা নেই। কেকাক’র বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ পরিবেশনায় কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না।
এ সময় ৬০ জনের মতো বালিনিজ পুরুষ তাদের মুখ দিয়ে একই তালে আওয়াজ করতে থাকে। আর মঞ্চে মূলত সংলাপহীন সংক্ষিপ্ত রামায়ণ মঞ্চস্থ হয়। কেকাকের শুরুটায় একঘেয়েমি থাকলেও আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে এলো । আমরা সবাই বেশ উপভোগ করলাম।
রাত ৮টার দিকে আমরা উলুওয়াটু থেকে জিমবারানের (Jimbaran) উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমাদের এবারের উদ্দেশ্য রসনা বিলাস। সি-ফুড না খেয়ে বালি ত্যাগ করলে ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে। উলুওয়াটু থেকে কুটা আসার পথেই জিমবারান এলাকার অবস্থান এবং কুটা থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। সাগরতীরে সি ফুড রেস্টুরেন্টের জন্য জিমবারান বিখ্যাত। এখানে খোলা আকাশের নিচে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
সাগরের গর্জন ও লাইভ মিউজিক শুনতে শুনতে সি-ফুড খাওয়ার মজা নেওয়ার জন্য অবশ্য চড়া মূল্য দিতে হয়। ১০/১২ আইটেমের সি-ফুড খেয়ে আমাদের প্রায় ১৪ লাখ রুপিয়া বিল দিতে হলো।
বালিতে আমাদের শেষ রাত। তাই কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে রাত প্রায় ১১টার দিকে কৃষ্ণা (Krishna) নামে একটি সুপার শপে প্রবেশ করলাম। আমাদের ড্রাইভার মেডি আগেই জানিয়েছিল যে, এই সুপার সপ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এক দরের দোকান হওয়ায় অতিরিক্ত মূল্য দেওয়ার ঝুঁকিও কম থাকে। আমরা কিছু গিফট আইটেম কিনে রাত প্রায় ১২টায় হোটেলে ফিরে গেলাম।
বালিতে আমাদের শেষ দিনের পরিকল্পনায় কোনো ঘোরাঘুরির কর্মকাণ্ড রাখা হয়নি। সকালটা হোটেলেই কাটালাম। হোটেলের রিসিপশনে চেকআউট আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা সাড়ে ১০টার দিকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। বোর্ডিং পাস নিতে গিয়ে বালিতে প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশিকে দেখলাম।
বালিতে বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এমনকি কাজ করতে আসা কোনো বাংলাদেশিও আমরা দেখতে পাইনি। বাংলাদেশি পরিবারটিও আমাদের অন্য বাংলাদেশি না দেখার একই তথ্য দিল।
যাই হোক, এয়ারপোর্ট আনুষ্ঠানিকতার শেষ মুহূর্তে এসে জানতে পারলাম যে, প্রত্যেক পর্যটককে ভ্রমণ শেষে ১ লাখ ৫০ হাজার রুপিয়া ট্যাক্স দিতে হয়। ভ্রমণ পরিকল্পনাকারী হিসেবে এই তথ্যটি আমার জানা উচিত ছিল। কিন্তু তথ্যটি আমার চোখ এড়িয়ে যাওয়ায় শেষ মুহূর্তে একটা উটকো ঝামেলায় পড়লাম।
সেসময় আমাদের সঙ্গে রুপিয়া নেই বললেই চলে। কাস্টমস কর্মকর্তা জানালেন, ডলারেরও পরিশোধ করা যাবে। কিন্তু ভদ্রলোক ডলারের যে পরিমাণ বললেন, তাতে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি প্রদান করতে হবে। আমরা তাতে রাজি না হয়ে ডলার চেঞ্জের জন্য দিলাম ছুট। অবশেষে মোট ৪ লাখ ৫০ হাজার রুপিয়া ট্যাক্স প্রদান করে আমাদের ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
দুপুর সাড়ে ১২টায় আমাদের বিমান চলতে শুরু করল। সাগরকে দু’ভাগ করা রানওয়ে ধরে বোয়িং-৭৩৭ বিমানটির গতি বাড়তে থাকল। আমি মনে মনে বললাম ‘বিদায় বালি’। বালির অনন্যসুন্দর মুহূর্তগুলোর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
আমাদের বিমান আকাশে উড়ল। মেঘের নিচে আড়াল হওয়া বালিকে পেছনে ফেলে আমরা উড়ে চললাম কুয়ালালামপুরের দিকে।
লেখা : মো. সালাউদ্দিন স্বপন