শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৩ অপরাহ্ন

বারো মাসে তেরো পার্বণ

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৩

বাঙালির অনেক দুর্নাম – অলস, ঘরকুনো, আবেগী আরও কত কি। কিন্তু সবার উপরে বাঙালি উৎসব প্রিয় – বার মাসে তার তেরো পার্বণ।উৎসব ঘরকুনো বাঙালিকে ঘরের বাইরে এনে অলসতার খোলশ ভেঙে দেয়। উৎসবের ডামাডোলে সব নেতিবাচক অপবাদ ঘুচে গিয়ে ধরা পরে অতিথীপরায়ণ বাঙালির স্বরূপ। উৎসব মানেই আত্মীয়, বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশী এক হয়ে আনন্দ উদযাপন। নানা স্বাদের খাবারের সুঘ্রাণে রসনা বিলাস। নাচ, গান, নাটক, কবিতার মুর্চ্ছনায় অভিভূত করা দিন।

যুগ যুগ ধরেই উৎসবের সঙ্গে খাদ্যের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন থেকে শুরু করে চৈত্র সংক্রান্তিতে বর্ষ বিদায় – সর্বত্রই বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু খাবারের উপস্থিতি। খাবারের বৈচিত্রও নজর কাড়া – নাড়ু, লুচি, পায়েস, পিঠা, মোরগ পোলাও, বুরহানি, মোগলাই, কাচ্চি বিরিয়ানি, শুটকি, মাছের কালিয়া, ছানার ডালনা, পাচন, মুড়িঘন্ট, ভর্তা, ভাজি, শাক, ডাল, চাটনি, আচার – লিখতে থাকলে পাতা ভরে যাবে, খাবারের নাম শেষ হবে না। বহু উৎসবের আবার বিশেষ বিশেষ খাবার। নাড়ু- লুচি না হলে যেমন দূর্গা পুজা জমে না, মাংস – পোলাও – সেমাই না খেলে তেমন ঈদ হয় না। হরেক রকম পিঠা পায়েস না হলে কি পৌষ পার্বণ হয়!

বাঙালির উৎসবের সঙ্গে খাদ্য ছাড়াও আরও একটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত – সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ, গান, কবিতা, নাটিকা না হলে উৎসব পূর্ণতা পায় না। বহু অনুষ্ঠানের সঙ্গে আবার শিল্প – সাহিত্য চর্চাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। একুশের বইমেলা, স্বাধীনতা দিবসে বানান প্রতিযোগিতা, বিজয় দিবসে দেয়াল পত্রিকা, সরস্বতী পূজায় স্মরণিকা, লক্ষ্মী পূজায় আলপনা – সৃষ্টিশীল মনন চর্চার অবারিত ক্ষেত্র। স্থান কাল পাত্র ভেদে উপস্থাপনায় ভিন্নতা থাকলেও মননে সবই বাঙালি সংস্কৃতি।

বার মাসে তেরো পার্বনের প্রসঙ্গ এলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে এই উৎসবগুলো কি কি।অনুসন্ধান করতে গিয়ে নানা ধরণের উৎসবের তথ্য মেলে। এদের একটির সঙ্গে অন্যটির একশভাগ মিল খুঁজে পাওয়া ভার। আবার প্রকৃতিগতভাবেও এসব উৎসবের মধ্যে শ্রেনীবিভাগ রয়েছে। বাংলায় মূলত ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এ তিন ধরণের উৎসবের প্রচলন রয়েছে। বাংলার আদি পার্বণগুলো মূলত হিন্দু ধর্মীয় ও উপজাতিদের উৎসব। এসব উৎসবের অনেকগুলোই সময়ের বিবর্তনে পুরোদস্তুর সামাজিক রূপ নিয়ে বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে তেরো পার্বনের একটি তালিকা করার চেষ্টা করেছি। তবে কাজটি করতে গিয়ে মনে হয়েছে বাঙালির উৎসবের সংখ্যা আসলে তেরোর চেয়ে অনেক বেশি। অঞ্চলভেদে এসব উৎসবের মধ্যে কিছু পার্থক্যও রয়েছে। কাজেই আমার করা এই তালিকা নিয়ে মতদ্বৈততা থাকতেই পারে।

বৈশাখ মাসে নববর্ষ ও হালখাতা, জ্যৈষ্ঠমাসে জামাই ষষ্ঠী, আষাঢ় মাসে রথযাত্রা, শ্রাবণ মাসে মনসা পূজা, ভাদ্র মাসে জন্মাষ্টমী, আশ্বিনে দুর্গা পূজা, কার্তিকে কালি পূজা ও ভাতৃদ্বিতীয়া, অঘ্রানে নবান্ন, পৌষ মাসে পৌষ পার্বণ, মাঘ মাসে সরস্বতী পূজা ও হাতেখড়ি, ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা আর চৈত্রমাসে চড়ক পূজা। এই হলো মোটমুটি আদি তের পার্বণ। তবে এগুলো ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি উৎসব বাংলায় প্রচলিত আছে – গাস্বি, লক্ষ্মী পূজা, কার্তিক পূজা, বিশ্বকর্মা পূজা, ভাদু উৎসব ইত্যাদি। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম আগমনের মধ্য দিয়ে ঈদ উল ফিতর, ঈদ উল আযহা, মহরম শবে বরাত, ঈদে মিলাদুন্নবির মত উৎসবগুলো বাঙালি সমাজে জায়গা করে নিয়েছে। এর বাইরেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ও মৃত্যু দিবসগুলো শিক্ষিত সমাজে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়ে থাকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের বাঙালিদেরকে আরও বেশ কয়েকটি জাতীয় উৎসব উদযাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস, ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবস এখন বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোর উদযাপনের আড়ম্বর অন্য যেকোন উৎসবের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে আরও বেশি।

বাংলা নববর্ষ
বাংলা নববর্ষ এখন বাঙালির অন্যতম জাতীয় উৎসব – সরকারি ছুটির দিন। অতীতে বর্ষবরনের আনুষ্ঠানিকতা মূলত গ্রামাঞ্চলে পালিত হলেও বহু বছর ধরে এ উৎসব নগরকেন্দ্রিক ‍গ্রহনযোগ্যতা লাভ করেছে। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। পহেলা বৈশাখের সকাল শুরু হয় রমনার বটমূলে গানে গানে বর্ষ বরণের মধ্য দিয়ে। সারাদিন জুড়ে চলে মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলাসহ নানা আয়োজন। রাজধানীর জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের অনুকরণে সারা দেশে সকল জেলা শহরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়। সরকারি বেসরকারি টিভি চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে । দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়।

গ্রামবাংলার কৃষক পরিবারে চৈত্রসংক্রান্তির রাতে গৃহিণীরা আমানি তৈরি করে। একটি বড় হাঁড়িতে অনেকটা জলের মধ্যে আম আর কিছু চাল ভেজানো হয়। আর ওই হাঁড়ির ভেতর রাখা হয় একটি সপত্র আমের ডাল। ভোরবেলা বাড়ির সবাই ওই ভেজানো চাল খায়, আর আমের ডাল দিয়ে সবার গায়ে জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এতে শরীর ঠান্ডা থাকে বলে তাদের বিশ্বাস। এদিন সবাই সাধ্যমত ভাল ভাল খাবারের আয়োজন করে। বছরের প্রথম দিন ভাল খাবার খেলে সারা বছরই ভাল খাবার পাওয়া যাবে – এমন বিশ্বাস সকলের। পয়লা বৈশাখে গ্রাম-বাংলায় গমের ছাতু, দই, পাকা বেল দিয়ে তৈরি বিশেষ শরবত খাওয়ার প্রচলন বহুকাল থেকে।

বাংলা নববর্ষ কেন্দ্রিক একটি পরিচিত উৎসব হালখাতা । জমিদারির খাজনার হিসাব-নিকাশ হতো চৈত্র সংক্রান্তির দিনে। সারাবছর কে কত খাজনা জমা করেছে, কার কত খাজনা বাকি রয়েছে তা চৈত্র সংক্রান্তির মধ্যে চূড়ান্ত হতো। এরপর বৈশাখের প্রথম দিনে, বাংলা নববর্ষের দিনে নতুন খাতায় সেই হিসাব তোলা হত। এই প্রথা হালখাতা নামে পরিচিত। অনেক অঞ্চলে এ প্রথা পুণ্যাহ নামেও পরিচিত। পরবর্তীকালে এই হালখাতার চল দোকানে-দোকানে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দোকান মালিকরাও তাদের ক্রেতাদের হিসাব-নিকেশ নতুন খাতায় তুলে রাখতে শুরু করেন নববর্ষের দিনে। যার ফলে হালখাতা উৎসব এক ব্যাপক আকার নেয়। হালখাতার এই উৎসব আজ অনেকটা ম্লান হলেও আনন্দের ঘনঘটা এখনও রয়েছে। ব্যবসায়ীরা এদিন তাদের ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান।

নববর্ষে উদযাপিত আদিবাসীদের একটি উৎসব সাগ্রাই । পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা পুরাতন বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে জাঁকজমকের সঙ্গে এটি পালন করে থাকে। এ উৎসব চলে চারদিনব্যাপী – পুরোন বছরের শেষ তিনদিন আর নতুন বছরের প্রথম দিন। বছরের প্রথম দিন মারমা ও রাখাইন সম্প্রদায় পানি খেলায় মেতে ওঠে। চৈত্রের শেষ দুদিন এবং পয়লা বৈশাখ এই তিনদিন ব্যাপী চাকমাদের ভেতর মহাসমারোহে পালিত হয় বিজু উৎসব। প্রথম দিন ফুল বিজু, দ্বিতীয় দিন’ মূল বিজু এবং পয়লা বৈশাখ গোজ্যাই পোজ্যার দিন। একই বর্ষবরণ উৎসব ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কাছে বৈসাবি নামে পরিচিত।

জামাই ষষ্ঠী
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠী পুজো করা হয়। ষষ্ঠীকে সন্তান দেবী মনে করা হয়। ঘর বা মন্দিরের বাইরে বট, করমচার ডাল পুঁতে প্রতীকী অরণ্য রচনা করে এই পুজো করা হয়। তাই এই তিথিকে অরণ্য ষষ্ঠীও বলা হয়ে থাকে। জামাইয়ের দীর্ঘায়ুর সঙ্গে মেয়ের মঙ্গল কামনার বিষয়টি জড়িয়ে আছে।শাশুড়ি নিজের জামাইয়ে সুখ ও দীর্ঘায়ু কামনা করার মধ্য দিয়ে নিজের মেয়ের মঙ্গল কামনা করে থাকেন। জামাইকে আদর-আপায়্যন করার মধ্যে দিয়ে এই লোকায়ত প্রথা পালন করা হয়ে থাকে।

রথযাত্রা
রথযাত্রা কেন করা হয় এ নিয়ে বেশ কিছু প্রচলিত মতভেদ রয়েছে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। আবার কথিত আছে, জ্যৈষ্ঠ মাসের দেবস্নানা পূর্ণিমাতে স্নানের পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন জগন্নাথদেব। পনের দিন পরে সুস্থ হয়ে বলভদ্র এবং সুভদ্রার সঙ্গে তার মাসি বাড়ি যাত্রার উৎসবই রথযাত্রা।আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় রথযাত্রা উৎসব। এই পূণ্য তিথিতে কাঠের তৈরি রথে করে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহকে পরিভ্রমন করানো হয়।

মনসা পূজা
মনসা পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য সাপের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া। এজন্য অন্যান্য পূজার মত সাধারণ পূজা বিধি অনুসরণ করতে হয় ৷ গোত্র ও অঞ্চল ভেদে প্রথার ওপর ভিত্তি করে মনসা দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে তার ভক্তদের দ্বারা পূজিত হয়ে থাকেন। ভারতবর্ষে সর্প পূজা একটি প্রাচীন অনুষ্ঠান। মনসা সাপের দেবী। তিনি মূলত লৌকিক দেবী। পরবর্তীকালে পৌরাণিক দেবী রূপে স্বীকৃত হন। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতিটি ঘরে ঘরে মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

জন্মাষ্টমী
জন্মাষ্টমী বা কৃষ্ণজন্মাষ্টমী একটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। এটি বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথীতে জন্মাষ্টমী পালিত হয়। কৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড গান বা কীর্তন, গীতিনাট্য, নাট্য, যাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। রাস লীলায় কৃষ্ণের ছোট বয়সের কর্ম-কাণ্ড দেখানো হয়, দহি হান্ডি প্রথায় কৃষ্ণের দুষ্টু স্বভাব প্রতিফলিত করা হয় যেখানে কয়েকজন শিশু মিলে উচ্চস্থানে বেঁধে রাখা মাখনের হাড়ি ভাঙতে চেষ্টা করে। এই পরম্পরাকে তামিলনাডুতে উরিয়াদি নামে পালন করা হয়। কংসবধ, রাধা-কৃষ্ণ পালা প্রভৃতির মাধ্যমে কৃষ্ণের জীবনী তুলে ধরা হয়ে থাকে।

বেরাভাসান উৎসব
বেরাভাসান উৎসবটি নদ-নদী ও হাওর-বাঁওড় অঞ্চলে জলের সব রকম অকল্যাণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে পালিত হয়। ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার খোয়াজ-খিজিরের (জলের দেবতা বরুণের স্থলাভিষিক্ত) উদ্দেশে উৎসবটি নিবেদিত হয়। মূলত ফকির সম্প্রদায়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। মুগল আমলে মুর্শিদাবাদ, রাজমহল ও ঢাকায় নবাবদের উদ্যোগে মহা সমারোহে এ উৎসব পালিত হতো। এই লৌকিক উৎসবটি তখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। লোক-জীবনে এর প্রভাব এত গভীর যে, এটা এখনও নদীবহুল অঞ্চলে টিকে আছে। এ উৎসবে এক নিঃশ্বাসে কলাগাছ কেটে ভেলা বানানো হয় এবং তাতে নানা রকমের শির্নী সাজিয়ে গান গাইতে গাইতে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

ভাদু উৎসব
ভাদু পশ্চিমবঙ্গের একটি কৃষিভিত্তিক উৎসব। বহুকাল আগে থেকেই এটি চলে আসছে এবং এখনও বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়। পুরো ভাদ্রমাস ব্যাপী পুরুলিয়া জেলার হিন্দু মেয়েরা ভাদুর পূজা করে। জনশ্রুতি আছে যে, কাশীপুর রাজের অবিবাহিতা কন্যার ভাদ্র মাসে মূত্যু হওয়ায় তাকে স্মরণ করার জন্য এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। একজন বর্ষীয়ান মহিলা ভাদ্রেশ্বর্যৈ নমঃ’ বলে ভাদুমূর্তির দিকে ফুল ছুঁড়ে দেয়। এ সময় ভাদুর গান গাওয়া হয়। শেষ দিনে তারা সাশ্রুনয়নে ভাদুকে বিসর্জন দেয়।

দুর্গা পূজা
দুর্গা পূজা বা দুর্গোৎসব হল দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি সার্বজনীন উৎসব। দুর্গাপূজা সমগ্র ভারতে প্রচলিত। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গা পূজা করা হয় যা শারদীয় পূজা নামে পরিচিত। দুর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল সহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রে প্রবাসিদের মাধ্যমে পালিত হয়ে থাকে। তবে হিন্দু বাঙালীর প্রধান উৎসব হওয়ার দরুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড এবং বাংলাদেশে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় “দেবীপক্ষ”। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে দুর্গাসপ্তমী থেকে বিজয়াদশমী পর্যন্ত চার দিন সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশে বিজয়াদশমীতে সর্বসাধারণের জন্য এক দিন সরকারি ছুটি থাকে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই পূজায় সাগ্রহে অংশগ্রহন করে থাকে।

কালী পূজা, দীপাবলি
কালীপূজা একটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসব উপলক্ষে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। কালীপূজা ও দীপাবলী অনুষ্ঠিত হয় কার্তিক মাসে অমাবস্যার সন্ধ্যায়। কার্তিক মাসটি মৃতের মাস বলে পরিগণিত। এই মাসে মৃত পিতৃপুরুষদের গতিপথ আলোকিত করতে আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হয়। আবার ভগবান শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধ করে অযোধ্যায় আসলে প্রজারা তাঁকে স্বাগত জাননোর জন্য রাতব্যাপী অযোধ্যায় আলোকসজ্জা করে। মন্দ শক্তির পতনের এই উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে আজও বিশ্বব্যাপী হিন্দুরা আলোর উৎসব করে থাকে। এভাবেই দীপাবলি ও কালিপূজা বাংলায় একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু ভারতের অন্য প্রান্তে কালীপূজা ছাড়াই আলোর উৎসব হয়। দীপাবলি নামটির অর্থ প্রদীপের সমষ্টি ও আলোর উৎসব। এটি দেওয়ালী, দীপান্বিতা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়। এই দিন হিন্দুরা ঘরে ঘরে ছোটো মাটির প্রদীপ জ্বালেন যা অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক।

ভাই ফোঁটা
ভাইফোঁটা হিন্দুদের একটি লোকজ উৎসব। এই উৎসবের পোষাকি নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে (কালীপূজার দুই দিন পরে) এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। এই উৎসবের আরও একটি নাম হল যমদ্বিতীয়া। ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে-
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥

নবান্ন উৎসব
নবান্ন একটি বিশেষ লোকউৎসব। নতুন ফসল ওঠার পর অগ্রহায়ণ মাসে এ উৎসবটি এক সময় হিন্দুদের মধ্যে ধুমধামের সঙ্গে পালিত হতো। উৎসবের দিন ভোর না হতেই ছেলেমেয়েরা ঘরের বাইরে এসে ছড়া কেটে দাঁড়কাকদের নেমন্তন্ন করতো। এদিন নতুন চাল ঢেঁকিতে কোটা হয়। বেলা দশটার দিকে বাড়ির প্রবীণগণ পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেন এবং ছেলেমেয়েরা নতুন জামা-কাপড় পরে। এরপর বাড়ির উঠোনে গর্ত করে জ্যান্ত কৈ মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। একে বলে বীর বাঁশ’। বীর বাঁশের চারপাশে চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। বীর বাঁশের প্রতিটি কঞ্চিতে নতুন ধানের ছড়া বাঁধা হয়। বীর বাঁশ পোঁতার পরে একটি কলার খোলে চালমাখা কলা ও নারকেল নাড়ু কাককে খেতে দেয়া হয়। কলাটি মুখে নিয়ে কাক কোন দিকে যায় তা লক্ষ করা হয়; কারণ তাদের বিশ্বাস, বছরের শুভাশুভ অনেকটা এর ওপর নির্ভর করে। কাককে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত এই পর্বটির নাম কাকবলি। শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে পূজা এবং নবান্ন দিয়ে পরে সকলে খাবার গ্রহণ করে। এদিন প্রত্যেক পরিবারেই উন্নত মানের খাবার তৈরি হয়। দিনের বেলা অন্যের বাড়িতে নবান্ন গ্রহণ করলেও রাতে নিজ বাড়িতেই খেতে হয়। নবান্নের শেষ হয় পরের দিন বাসি নবান্ন’ দিয়ে। একসময় মুসলিম পরিবারেও নবান্নের প্রচলন ছিল। সংস্কারবশত তারাও লক্ষ্মীর শির্নী দিত। একে তারা বলত নয়াখাওয়া। উৎসবের আমেজ এদের মধ্যে থাকলেও হিন্দুদের মতো এত আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।

গাস্বি উৎসব
গাস্বি আশ্বিনের শেষ রাত থেকে শুরু হয়। ফসল যাতে ভাল হয় সে উদ্দেশ্যে পরের দিন পয়লা কার্তিক সূর্যোদয়ের আগে কাঁচা হলুদ এবং নিমপাতা একসাথে বেটে সরিষার তেলসহ ধানগাছে মাখিয়ে দেওয়া হয়। অফলা গাছে ফল ফলানোর উদ্দেশ্যে গাছের ডালে শামুকের মালা ঝুলিয়ে দেওয়া বা গাছটি কেটে ফেলার অভিনয়ও করা হয়। এসময় মশা-মাছি ও পোকা-মাকড়ের প্রাদুর্ভাব রোধ করার জন্য পূর্বরাতে প্যাকাটি জ্বালিয়ে ছেলেরা ছড়া কাটে। নীরোগ স্বাস্থ্যের জন্য লোকেরা এ রাতে তেলাকুচার পাতা, হলদি, পান, নিম ইত্যাদি বেটে গায়ে মেখে স্নান করে। আশ্বিনের শেষদিন রান্না করে পরের দিন খায়। তাই জনশ্রুতি আছে, আশ্বিনে রান্ধে-বাড়ে কার্তিকে খায়, যে যেই বর মাগে সেই বর পায়।সময়ের পরিবর্তনে বর্তমানে অবশ্য এ উৎসবের তেমন প্রচলন নেই।

পৌষ পার্বণ
পৌষপার্বণ বা পোষলা একটি শস্যউৎসব। এ উপলক্ষে মুসলিম রাখাল ছেলেরা মানিক পীরের গান গেয়ে, আর হিন্দু রাখালেরা লক্ষ্মীর নামে ছড়া কেটে সারা পৌষ মাস সন্ধ্যার পর বাড়ি বাড়ি মাগন করত। মাগনশেষে তারা পৌষ সংক্রান্তির সকালে মাঠ বা বনের ধারে রান্না করত; পিঠা বা শির্নী বানিয়ে পীর বা দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করত এবং পরে নিজেরা খেত। একে পিঠাপর্বও বলা হতো। বর্তমানে পৌষপার্বণ উৎসবটি গ্রামবাংলার পাশাপাশি শহরাঞ্চলেও লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ব্যাপকভাবে পালিত হয়।

সরস্বতী পূজা ও হাতেখড়ি
মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে পালিত হয় সরস্বতী পূজা।স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে সানন্দে পূজার প্রস্তুতি অংশগ্রহণ করে ছাত্রছাত্রীরা। সরস্বতী হলেন বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী। শাস্ত্র মতে সরস্বতী পূজার দিন বিদ্যারম্ভের জন্য শ্রেষ্ঠ। বাঙালি সমাজে হাতেখড়ির মাধ্যমে শিশুর বিদ্যাশিক্ষা শুরু করা হয়। এদিন পূজার পর মা, বাবা অথবা পুরোহিত শিশুর হাত ধরে স্লেটে ‘অ, আ, ক, খ’ লিখিয়ে অক্ষর পরিচয় করান। এই হাতেখড়ি প্রথার মধ্য দিয়ে শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে সেই শিশু।

দোলযাত্রা
দোলযাত্রা এমনি একটি সনাতন বৈষ্ণব উৎসব যা ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে সামাজিত সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলার বাইরে পালিত হোলি উৎসবটির সঙ্গে দোলযাত্রা সম্পর্কযুক্ত। এটির উদ্ভব ভারতীয় উপমহাদেশে হলেও দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীদের মাধ্যমে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল এবং পশ্চিমা বিশ্বের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এই উৎসবের অপর নাম বসন্ত উৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোল যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। দোলযাত্রায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মত্ত হয়। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে।

চৈত্র সংক্রান্তিতে বর্ষ বিদায়
চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়ক পুজো। এটি হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ এবং বৈশাখের প্রথম দুদিন ব্যাপী এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। একে শিবঠাকুরের গাজন উৎসবের অন্যতম অঙ্গ হিসাবে ধরা হয়। এ দিন বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে এবং তা চলে কয়েক দিন ধরে। লাল কাপড় পরে মাথায় পাগড়ি বেঁধে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা এবং হাতে ত্রিশূল নিয়ে শিবের সাজ, সঙ্গে আবার দেবী পার্বতীর সাজে কেউ একজন, এদের সঙ্গে আবার খোল-করতাল, ঢাক-ঢোল নিয়ে কিছু জন। দলটির মধ্যে একজন আবার পাগল সাজে থাকে। যাকে হনু বলে পরিচয় দেওয়া হয়। এরা দলে দলে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং শিব-পার্বতীর গান গেয়ে অনুষ্ঠান করে। এই সঙ সাজের দলকে নীল বলে। এদের আবার একজন দলপতি থাকে যিনি নীল ঠাকুরকে হাতে ধরে থাকেন। বাড়ির উঠোন লেপে বা কোনও গৃহস্থ উঠোনে আলপনা দিয়ে দেয়। সেখানেই নীলকে প্রতিষ্ঠা করে চলে নীলের নাচ বা শিবের গাজন। এটা নীল উৎসব নামে পরিচিত।

এই দিনের আরও একটি বড় অনুষ্ঠান হল গম্ভীরা নাচ। আজও বরেন্দ্র অঞ্চল এবং বাংলাদেশের রাজশাহীতে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চল বলতে মালদহ ও দুই দিনাজপুরে চৈত্র সংক্রান্তিতে গম্ভীরা নাচ হয়। গম্ভীরা নাচের সঙ্গে হয় গম্ভীরা পূজো এবং শিবের গাজন। চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রাম-বাংলার আরও এক বিশেষ উৎসব তালতলার শিরনি। এই দিনে প্রতিটি বাড়ি থেকে চাল, তালের গুড়, দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর গ্রামের কোনও পবিত্র তাল গাছের নিচে বা বটগাছের নিচে এই জিনিসগুলো দিয়ে তৈরি হয় শিরনি। যা তালতলার শিরনি নামে পরিচিত। এরপর তা গ্রামের মানুষের মধ্যে বিলি করা হয়।

চাকমাদের ঘরে এইদিন পাজন রান্নার আয়োজন হয়। পাজন হল নানা সবজির মিশালি এক তরকারি। এই দিন বাড়িতে যে সব বন্ধু বা অতিথিরা আসে তাদের এই পাজন দিয়ে আপ্যায়ণ করেন চাকমারা। তাদের ধারণা বছর শেষের দিনে সব ধরনের সবজি দিয়ে তরকারি খেলে মঙ্গল। এতে নতুন বছরে শুভ সূচনা হয়।

চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন ত্রিপুরায় বসবাসকারী মানুষজনও বাজার অথবা পাহাড় থেকে ফুল সংগ্রহ করে। চৈত্রের শেষ দুদিন এবং নববর্যের প্রথম দিন নিয়ে ত্রিপুরায় পালিত হয় বৈসু। এই দিন ত্রিপুরায় ব্যাপকভাবে পিঠার আয়োজনও হয়।

বাংলাদেশে আন্ত সম্প্রদায় সম্প্রীতির কথা উঠলেই একটা বহু ব্যবহৃত শ্লোগান উঠে আসে – ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। উৎসবপ্রিয় বাঙালির হৃদয়ে একাত্মতার ভাব জাগাতে এর চেয়ে ভাল উপায় আর দ্বিতীয়টি নেই। উৎসবের আমেজ পেলেই বাঙালি ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের সংকীর্ণতা ভুলে একত্রে মিলিত হয়। আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে বাঙালির জুড়ি নেই। সাথে যদি থাকে মুখরোচক খাবার আর গান বাজনা, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কাজেই সময়ের বিবর্তনে তেরো পার্বণ বেড়ে কখন যে চব্বিশ পার্বণ হয়ে গেল – উৎসবপ্রিয় বাঙালি সেটা জানতেই পেল না। বেশি বেশি ভাল লাগা, বাঁধ ভাঙা আনন্দ, হা হা হি হি – মন্দ কি!!

তথ্যসূত্র : প্রচলিত রীতি ও ইন্টারনেট

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com