বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, যা “ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গল” নামেও পরিচিত, হলো আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত একটি ত্রিভুজাকৃতির অঞ্চল। এর তিনটি প্রান্ত হলো বারমুডা দ্বীপ, মায়ামি বিচ (ফ্লোরিডা), এবং পুয়ের্তো রিকোর সান জুয়ান। এই অঞ্চলটি বহু বছর ধরেই এক রহস্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। কথিত আছে, এখানে জাহাজ, নৌকা কিংবা উড়োজাহাজ অদ্ভুতভাবে উধাও হয়ে যায় এবং তাদের কোনো খোঁজ আর পাওয়া যায় না। কিন্তু এই কথাগুলো কতটা সত্য, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলছেই।
রহস্যের উৎপত্তি
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে মানুষের আগ্রহ প্রথম শুরু হয় ১৯৪৫ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ৫ ডিসেম্বর তারিখে পাঁচটি টিভিএম অ্যাভেঞ্জার উড়োজাহাজ প্রশিক্ষণ মিশনে বের হয়ে এই অঞ্চলে নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই মিশনটিকে বলা হয় “ফ্লাইট ১৯”। এমনকি তাদের উদ্ধারে পাঠানো একটি উদ্ধারকারী উড়োজাহাজও অদৃশ্য হয়ে যায়। এর পর থেকেই এই অঞ্চলটি রহস্যময় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজের নিখোঁজ হওয়ার খবর আসায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে কল্পনা ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাড়তে থাকে।
বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
বিশেষজ্ঞদের মতে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্য আসলে অতিরঞ্জিত। বেশিরভাগ ঘটনাই প্রকৃত দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক কারণের ফল। এই অঞ্চলে জাহাজ ও উড়োজাহাজ চলাচল খুবই বেশি, যা দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়াতে পারে। বিশেষ করে, আটলান্টিক মহাসাগরের এই অংশে প্রবল উপসাগরীয় স্রোত, হঠাৎ পরিবর্তনশীল আবহাওয়া, এবং টর্নেডোর প্রকোপ অনেক বেশি। এগুলো জাহাজ বা বিমানের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী হতে পারে।
এছাড়া এই অঞ্চলে কম্পাসের কাঁটা চুম্বকীয় উত্তর (magnetic north) এবং ভৌগোলিক উত্তরের (true north) মধ্যে পার্থক্য থাকে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে এই পার্থক্য প্রায় ২০ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। যদি নাবিক বা পাইলট এই পার্থক্য হিসাবের মধ্যে না রাখেন, তবে দিকভ্রান্ত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বিমা কোম্পানির তথ্য
যদি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল সত্যিই অতিরিক্ত বিপজ্জনক হতো, তাহলে বিমা কোম্পানিগুলো এই অঞ্চলের জন্য বাড়তি প্রিমিয়াম আরোপ করত। কিন্তু বাস্তবে সেখানে বিমার হার অন্য অঞ্চলের মতোই। অর্থাৎ, সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানেও বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে অন্য এলাকার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হিসেবে প্রমাণ করা যায় না।
মিথ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে মানুষের মনে রহস্য ও ভয়ের জন্ম দেয়ার পেছনে গণমাধ্যম এবং সাহিত্যিকদের ভূমিকা কম নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রায়শই ঘটনাগুলো অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি রহস্যঘেরা উপন্যাস ও চলচ্চিত্রগুলোও মানুষের মনে ধারণা পাকাপোক্ত করেছে যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল কোনো অলৌকিক জায়গা। অথচ বেশিরভাগ ঘটনাই ছিল প্রাকৃতিক কারণের ফল এবং ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
উপসংহার
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে মানুষের মনে রহস্যের যে ধারণা আছে, তার পেছনে বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ব্যস্ত নৌপথ এবং আকাশপথ, যেখানে দুর্ঘটনার হার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নয়। রহস্যের বদলে এর ঘটনাগুলোকে সাধারণ দুর্ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করাই যথার্থ। মানুষ যতদিন কল্পকাহিনি আর ষড়যন্ত্র তত্ত্বে আগ্রহী থাকবে, ততদিন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে রহস্যের গল্পও বেঁচে থাকবে। তবে বিজ্ঞান আমাদের নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়—এখানে কোনো অলৌকিকতা নেই।