শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৯ পূর্বাহ্ন

বাড়ছে ব্যাবসা, বাড়ছে কমিউনিটি: বাংলাদেশিদের নতুন গন্তব্য বাফেলো-নায়াগ্রা

  • আপডেট সময় রবিবার, ৪ জুন, ২০২৩

করোনা তছনছ করেছে কোটি মানুষের জীবন। যার বাইরে নয় বাংলাদেশিরাও। একটা সময়ে এই মহামারি যে তাণ্ডব শুরু করেছিলো তাতে মানব সভ্যতার অস্থিত্ব নিয়েও সন্দেহ দেখা দেয় কারো কারো মনে। করোনা হলে আর রক্ষা নেই এমনটাই ভাবা হতো। আর এটাই ছিল সে সময়ের বাস্তবতা। করোনা হলে সমাজ বিচ্যুতির আশংকায় রোগের খবর গোপণ রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন অনেকে। ব্রঙ্কসের বাসিন্দা আব্দুস সামাদ বললেন, “আমার করোনা হওয়ার পর ভয়ে খবরটি গোপন রেখেছিলাম। কারণ করোনা শুনলেই নিজের পরিবার পরিজন আত্মীয়স্বজনরা পর্যন্ত ভয়ে তটস্থ হতো। অনেকে বিপদে খাবার নিয়ে এসে দরজায় রেখে বাইরে থেকে চলে গেছে। এটাই ছিল নিয়ম। অবস্থাটা ছিল এমন যে, করোনা হওয়া মানেই যেন, সমাজচ্যুতির লক্ষণ।”

সারা বিশ্বের দেশে দেশে লক ডাউন চলছিলো। যা কেউ কখনো কল্পনা করেনি কেউ। বিশ্বের রাজধানী খ্যাত নিউ ইয়র্ক নিয়ে আছে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ- ‘দ্য সিটি নেভার স্লিপস’। সেই সিটিই হয়ে পড়েছিল মৃত প্রেতপুরির মতো। নিউ ইয়র্ক সিটির হিসাব অনুযায়ী করোনাতে এই সিটিতে মুত্যের সংখ্যা ৭৭ হাজার ৫১২ জন। এরমধ্যে কেবল বালাদেশিদের সংখ্যাই তিন শতাধিক। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটির আমব্রেলা সংগঠন হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুর রহিম হাওলাদার বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে সঠিক তথ্য নেই তবে মৃত্যের সংখা তিন শতাধিক হবে বলে আমরা মনে করছি।

বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী বলেন, দুই শতাধিক কবর আমরা সোসাইটির পক্ষ থেকেই দিয়েছি। তাতে মনে হয় করোনাতে তিন শতাধিক বাংলাদেশি মারা গেছেন। কারণ অনেকের লাশ আবার তাদের আত্মীয় স্বজনরা নিজেদের জিম্মায় বিভিন্ন স্থানে দাফন করেছেন।

বিভিন্ন কারণে ব্যাবসা বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। আবার কেউ খোলা রাখলেও সতর্কতার শেষ ছিল না। দিনের শুরু থেকে প্রতিনিয়ত সবার কেটেছে এক ভয়, আতংক আর অনিশ্চয়তায়। রাতে কথা হয়েছে যার সাথে হয়তো সকালে উঠে খবর শুনা গেছে তিনি হাসপাতালে। একদিন দুদিনের মাথায় এসেছে তার চিরবিদায়ের খবর।

আতংক ভয় ভীতি ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাংলাদেশি কমিউনিটির ব্যাবসা বাণিজ্য ছিল অনেকেটা সচল। কমিউনিটি সার্ভিসের অংশ হিসেবে খোলা ছিল অধিকাংশ গ্রোসারি ও রেস্টুরেন্ট।

লাভ লোকসান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মত আছে। তবে একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা, যে, অন্য যে কোন ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি হলেও এই সময়ে সবচাইতে বেশি ব্যাবসা করেছে রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারী ও ইনকামট্যাক্স প্রতিষ্ঠান সমূহ। বাংলাদেশি কমিউনিটির অত্যন্ত পরিচিত একাউন্টিং প্রতিষ্ঠান ওজনপার্কের সেন্ড একাউন্টিংয়ের প্রধান মিয়া মোহাম্মদ আবজাল বলেন, তখনকার সময়ে একাউন্টিং প্রতিষ্ঠানসমূহ ছিল বেজায় ব্যস্ত। কারণ বিভিন্ন ধরনের আবেদন সহ কিভাবে সরকারি সাহায্য পাওয়া যাবে তার খবরাখবর সহ বিভিন্ন ধরনের দরখাস্তের আবেদনে সহযোগিতা করেছে বিভিন্ন একাউন্টিং বা ট্যাক্স প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
নিউ ইয়র্কে কোন বাংলাদেশি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান করোনার কারণে বন্ধ হয়েছে এমন খবর নেই। শত প্রতিকুলতার মধ্যে সেই সময়ে দেয়া সরকারের বিভিন্ন ধরনের প্রনোদনা বা স্টিমুলাস প্যাকেজ সহজ শর্তের ঋণ ব্যাবসা বানিজ্য টিকিয়ে রাখতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বাঁচতে হলে খাবার প্রয়োজন। তাই রেস্টুরেন্ট বা গ্রোসারী এই দুটোর কোনটাই বন্ধ হয়নি। ইনডোর রেস্টুরেন্ট সার্ভিস সাময়িক বন্ধ করা হলেও তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সাহায্য করেছে বিভিন্ন ধরনের প্রনোদনা বা স্টিমুলাস এবং সহজ শর্তের ঋণ।

বাংলাদেশি কমিউনিটির জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট খলিল বিরিয়ানী হাউসের প্রধান খলিলুর রহমান বলেন, ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করেছি। মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় রেখে রেস্টুরেন্ট খোলা রাখা হয়েছে। লক্ষনীয় হলো কোন রেস্টুরেন্ট বা বড় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়নি।

সে সময়ে ব্যাবসায়িকভাবে যারা সবচাইতে বেশি লাভবান হয়েছেন তারা হচ্ছেন ট্যাক্স প্রফেশনালস। ব্যক্তিগত, ব্যাবসায়িক স্টিমুলাস এবং ঋণের বিভিন্ন আইনি মারপ্যাচ ও আবেদনপত্র পূরণ করতে তখন ট্যাক্স প্রফেশনালরা ছিলেন বেজায় ব্যস্ত। কেউ যখন বড় অংকের ঋণ বা স্টিমুলাস পাওয়ার হাতছানি পেয়েছেন তখন ট্যাক্স প্রফেশনালদের অর্থ প্রদানে কোন কাপর্ন্য ছিল না তাদের। যার ফলে অনেক সিপিএ বা ট্যাক্স প্রফেশনালদের সে সময় রীতিমত ফুল টাইম অফিস করতে হয়েছে।

এই সময়েই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি নিউ ইয়র্ক ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন নতুন গন্তব্যে। যার অন্যতম হচ্ছে বাফেলো ও নায়াগ্রা সিটি।

নায়াগ্রা জলপ্রপাত পৃথিবীর ৭ম আশ্চর্যের অন্যতম। সেই সিটিতে এখন নতুন করে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি বসতি গড়ছেন। নায়াগ্রা সিটির পুরনো বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, মাত্র কয়েক বছর আগেও নায়াগ্রাতে বাংলাদেশিদের অবস্থান ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। কিন্তু মাত্র গত দুই বছরে সেখানে প্রায় ২ শতাধিক বাংলাদেশি বাড়ী কিনেছেন। নতুন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশীদের কাছে দিনে দিনে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে নায়াগ্রা সিটি। আমি মনে করি এখন প্রায় ৫ শতাধিক বাংলাদেশি পরিবার বসবাস করছেন নায়াগ্রা সিটিতে। যা মাত্র বছর খানেক আগেও ছিল কল্পনার অতীত।

২০১১ সালের আগে বাফেলোতে হাতে গোনা কতিপয় বাংলাদেশির আনাগোনা ছিল। নিউ ইয়র্কের তুলনায় অতি স্বস্তা হওয়ায় কৌতুহলবশে কিছু বাড়ীও কিনে রেখেছিলেন তারা।

করোনা যুগে নিউ ইয়র্কে যখন মৃত্যুর মিছিল। জান বাঁচাতে মানুষ তখন দিশেহারা, এই সময় সম্ভাবনার নতুন গন্তব্য ও নিউ ইয়র্কের বিকল্প হিসেবে বাফেলোকে বেছে নেন অনেকে। স্টিমুলাস, আন এমপ্লয়মেন্ট, সহজ শর্তে এসবিএ লোন ইত্যাদি বাাজারে বড় ধরনের অর্থের প্রবাহ সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় করোনা সংকটে সবার হাতেই অর্থের প্রবাহ ছিল বিপদের মধ্যে স্বস্তির খবর। বাংলাদেশি অনেকেই তাদের পাওয়া অর্থে কোন ধরনের ঋণ ছাড়াও কিনতে শুরু করেন বাড়ী। নিউ ইয়র্ক ছেড়ে বাফেলোতে বড় হতে শুরু করে কমিউনিটি। এক জনের দেখাদেখি অনেকেই বিকল্প হিসেবে বাফেলোকে বেছে নেন তাদের পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে। বাফেলোতে বাংলাদেশি কমিউনিটির সবচাইতে বড় গ্রোসারি স্টোর আল আকসার প্রধান তালহা বখত বলেন, করোনা মহামারীর সময় অনেকেই ছিলেন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়। এর মধ্যে বাফেলো সুযোগের নতুন হাতছানিতে ডেকেছে বাংলাদেশীদের। যার ডাকে সাড়া দিয়েছেন তারাও।

বাফেলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষনীয়। এরমধ্যে রয়েছে হালাল গ্রোসারি, মসজিদ, রেস্টুরেন্ট, সহ কমিউনিটি সংশ্লিষ্ঠ বিভিন্ন স্থাপনা ও ব্যবসা।

অনেকেই শুরু করেন গ্রোসারি। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে আল আকসা গ্রোসারি ও সুপারমার্কেট। যেখানে বাংলাদেশিদের জীবন ধারনের সবকিছুই পাওয়া যায়। এর আগে প্রতিষ্টিত হয়, সিকামোর গ্রোসারি, ইন্দোপাক বাংলা বাজার, জোবায়দা হালাল গ্রোসারি, মদিনা গ্রোসারি, মদিনা হালাল রেস্টুরেন্ট, বাংলা বাজার সহ আরো বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান।

ফার্স্টফুড রেস্টুরেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা বারগার অথরিটি নামে একটি নতুন রেস্টুরেন্ট। নতুন প্রজন্মের জন্য হালাল বার্গারের এটি একটি নামকরা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বার্গার আইএম নামে আরেকটি নতুন রেস্টুরেন্ট যাত্রা শুরু করেছে অতি সম্প্রতি।

বাফেলোতে বাংলাদেশি কমিউনিটির স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে ফেডালিষ্ট ইন্সুরেন্স কোম্পানিও ব্যাবসা সফল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ট্যাক্স প্রদানে যাতে কোন ধরনের সমস্যা না হয় সকথা বিবেচনা করে সেখানে শাখা খুলেছে ব্রঙ্কসের বিখ্যাত ট্যাক্স প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ডায়নামিক ট্যাক্স। অটো ইন্সুরেন্স, ক্যাব, বাড়ী ভাড়া, এয়ারপোর্ট ট্রান্সপোর্টেশন সহ বিভিন্নভাবে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছেন স্বাস্থন্দে। ডায়নামিক ট্যাক্সের প্রধান আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরী জাকির বলেন, বাফেলোতে বাংলাদেশি কমিউনিটি দিনে দিনে বড় হওয়ার কারণেই আমরা সেখানে আমাদের নতুন শাখা খুলেছি। আমরা মনে করি নিউ ইয়র্কের যান্ত্রিক জীবনের বাইরে বাফেলো স্বস্তির এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে বাংলাদেশিদের জন্য।

নিউ ইয়র্ক ছেড়ে কেন বাফেলোতে কেন বাংলাদেশিরা? এই প্রশ্নের উত্তরে নিউ ইয়র্কের সাবেক বাসিন্দা বর্তমানে হেলথ ইন্সুরেন্স প্রতিষ্টান ফেডালিষ্ট এর সুপারভাইজার ফজুলুর করিম বলেন, নিই ইয়র্কে বাড়ি কেনা কল্পনার মত হয়ে দাড়িয়েছে। এই অবস্থায় বাফেলোতে বাড়ী অনেক স্বস্তা, পার্কিংয়ের কোন ঝামেলা নেই, প্রতিযোগিতা কম, এক সময় যারা ৫ হাজার ডলারের নীচে বাড়ী কিনেছেন তারা এখন সেখান থেকে ভাড়া পাচ্ছেন কমপক্ষে ৮০০ ডলার। এর বাইরে এমহার্স, চিত্তওয়াগা, ইউলিয়ামভিল, গেইটসভিল সহ অভিজাত এলাকাতে অনেক বাংলাদেশি সুইমিং পুল সহ বাড়ি কিনছেন। এটা এখন বেড়েই চলেছে। ১০ বছর আগে যে বাড়ির দাম ছিল ১৫ হাজার ডলার বাংলাদেশিদের প্রতিযোগিতায় সেই বাড়ির দাম এখন ১৫০ হাজার ডলার। বাংলাদেশিদের উদ্যোগে প্রতিষ্টিত হয়েছে প্রায় ৩০টি মসজিদ। ইসলামিক স্কুল চালু করার জন্য ইতোমধ্যেই কেনা হয়েছে বড় ধরনের একটি স্থাপনা।

নিউ ইয়র্কের প্রবীন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট ফেরদৌস খান বলেন, নিউ ইয়র্কের তুলনায় বাফেলোতে এখনো বাড়ির দাম অনেক কম। যে কেউ চাইলে সামান্য ডাউন পেমেন্ট বা পুরো ক্যাশ দিয়েই সেখানে বাড়ি কিনতে পারেন। যা নিউ ইয়র্ক সিটিতে অনেকের পক্ষেই সম্বভ নয়।

মাত্র কয়েকদিন আগে হালাল কিংফুড নামে যাত্রা শুরু করেছে একটি নতুন ধরনের জাইরো রেস্টুরেন্ট। প্রায় ৬০০ স্কয়ার ফিট ভাড়া নিয়ে একজন বাংলাদেশি চালু করেছেন নিজন্স গ্যাস স্টেশন। তার মধ্যেই আছে হালাল কিংফুড। রাস্তায় খাবার বিক্রি করতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে দুটো হালাল জাইরো কার্ট। জানালেন, কমিউনিটির অন্যতম পরিচিত মুখ ফজলুল করিম।

আবু তাহের

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com