এই যাত্রায় পাঁচ মহাদেশজুড়ে রয়েছে মানবপাচাকারীদের নেটওয়ার্ক৷ এই নেটওয়ার্কে দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি যেসব দেশে অভিবাসীদের রাখা হয়, সেখানকার স্থানীয়দের অনেকেও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া থেকে ভুয়া পাসপোর্টে ব্রাজিল যাওয়ার সময় এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে আটক হন দুই বাংলাদেশি৷ এর আগে আরো কয়েকজনের আশ্রয় আবেদন বাতিল করে গাম্বিয়ায় ফেরত পাঠিয়েছে নেদারল্যান্ডস কর্তৃপক্ষ৷ পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ ঘানা থেকেও ইনফোমাইগ্রেন্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী৷
মূল ট্রানজিট দুবাই
বাংলাদেশ থেকে এই পথে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের প্রথম গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাই৷
পর্যটন বা ট্রানজিট ভিসার ক্ষেত্রে অনেকটাই শিথিলতা দেখায় সেখানকার কর্তৃপক্ষ৷ বিমানের টিকেট, হোটেল বুকিং, অন্য কোনো দেশে ভর্তি হতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ভর্তির অনুমোদনপত্রসহ বিভিন্ন নথি দেখিয়ে সহজেই পাওয়া যায় আরব আমিরাতের ভিসা৷
দুবাই এবং বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট থেকে কিভাবে ‘কন্ট্রাক্টের’ মাধ্যমে অভিবাসীদের নির্বিঘ্নে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয় তা সাইপ্রাসে এসে আটকা পড়া অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী এবং তাদের এজেন্টরাও ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন৷
বাংলাদেশ থেকে ২০২২ সালে দুবাইয়ে পৌঁছান লিটন* ও জামান*৷ বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে এক শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা তারা৷ সেখানেই তারা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের যাত্রার বিস্তারিত তুলে ধরেন৷
লিটন জানান, তিনি মূলত ব্রাজিল যাওয়ার জন্য বাংলাদেশি এজেন্টকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন৷ সেই এজেন্টই তাকে শুরুতে দুবাই আসার ব্যবস্থা করে দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি নোয়াখালি থেকে ঢাকা এসেছি৷ এখানে আসার পরে আমি দালাল ধরেছি আমাকে ব্রাজিল পৌঁছে দেয়ার জন্য৷ পরবর্তীতে আমি ওদেরকে পাসপোর্ট দেই৷ কয়েকদিন পর তারা আমাকে জানিয়েছে আপনার ভিসা হয়ে গেছে, আপনাকে দুবাই পাঠানো হবে৷”
কাকে কিভাবে কোন রুটে পাঠানো হবে, সেটি মূলত দুবাই থেকেই নির্ধারণ করা হয়৷ লিটন এবং জামানকে যেমন গাম্বিয়ায় পাঠানো হয়েছিল৷ অনেককে ভিন্ন রুটেও পাঠানো হয়৷
জামান বলেন, “আমি জানতাম না আমাকে কোনদিক দিয়ে পাঠানো হবে৷ আমার প্রসেসিংটা যেভাবে করলে ভালো হবে, সেটাই তারা (দালাল) করেছে৷ আমি আফ্রিকা দিয়ে এসেছি, অনেকে সরাসরি দুবাই থেকেই আসে, যখন যেদিকে সুবিধা হয়৷’’
আগাম ভিসা নেয়া না থাকলে দুবাই থেকে ইউরোপের কোনো দেশে বৈধ উপায়ে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব৷ ফলে দালালরা বেছে নেন অন্য এক উপায়- ভুয়া পাসপোর্ট৷
আফ্রিকায় অবস্থান, ভুয়া পাসপোর্টে ইউরোপে ট্রানজিট
দুবাইয়ে ২২-২৩ দিন রাখার পর ই-ভিসা করে লিটনকে নিয়ে আসা হয় গাম্বিয়া৷ প্রায় এক বছর তিনি পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতেই অবস্থান করেন৷ সেখানেই পাকিস্তানের এক নাগরিকের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার জাল পাসপোর্ট তৈরি করানো হয়৷ ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের জন্য ব্রাজিলে রয়েছে ভিসামুক্ত প্রবেশের অনুমতি৷ আর সে সুযোগকেই কাজে লাগাতে চান অভিবাসীরা৷
কিন্তু এই প্রচেষ্টা অনেকক্ষেত্রেই সফল হয় না৷ হয়নি লিটন আর জামানের ক্ষেত্রেও৷ ১৯ এপ্রিল নেদারল্যান্ডসে এসে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তারা৷ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার স্বপ্নে যাত্রা করা এই অভিবাসীদের আশ্রয় এখন আমস্টারডামের একটি শরণার্থী শিবিরে৷
ভুয়া পাসপোর্ট দিয়ে ব্রাজিল যাওয়ার সময় নেদারল্যান্ডসে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়৷ দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে এই বিষয়ে ইনফোমাইগ্রেন্টসের পক্ষ থেকে পরিসংখ্যান জানতে চাইলেও তার উত্তর এখনও মেলেনি৷ তবে অভিবাসীদের সূত্রে অন্তত আরো দুই বাংলাদেশির আটক হওয়ার তথ্য জানা গেছে৷ এর মধ্যে একজনের আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়ার পর তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে গাম্বিয়ায়, অন্যজনকেও দ্রুত ফেরত পাঠানো হতে পারে৷
আন্তর্জাতিক আইন এবং ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন অনুসারে পাসপোর্ট না থাকলে বা ভুয়া পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্র নিয়ে কেউ কোনো দেশে প্রবেশ করলেও তার আশ্রয় আবেদনের সুযোগ থাকে। ফলে আবেদনের নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আশ্রয় দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর।
লিটন জানান, বিমানবন্দরে তাদের ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করার অপরাধে দুই মাসের কারাদণ্ড হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। পরে তাকে এবং জামানকে প্রায় দুই সপ্তাহ নেদারল্যান্ডসের একটি আটককেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। সেখানে বেশ কয়েকবার তাদের পরিচয় এবং সে দেশে আসার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। পরবর্তীতে লিটন এবং জামান নেদারল্যান্ডসেই রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনের সুযোগ চাইলে তাদের পাঠানো হয় উন্মুক্ত আশ্রয় কেন্দ্রে। এখন তারা চাইলেই কেন্দ্রের বাইরে বিনা বাধায় চলাফেরাও করতে পারেন।
একই রুটে আসার অপেক্ষায় পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ ঘানায় রয়েছেন অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি৷ একাধিক বাংলাদেশি অভিবাসী দেশটির রাজধানী আক্রা থেকে যোগাযোগ করেছেন ইনফোমাইগ্রেন্টসের সঙ্গে৷ তেমনই একজন রিমন*৷ এই অভিবাসী জানিয়েছেন, “বাংলাদেশের এক ভাই এর মাধ্যমে আমি দুবাই থেকে এই ঘানাতে আসি৷ আমি যেখানে থাকি সেখানে সে আরো কিছু লোক বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছে এবং আমাদের সবার কাছ থেকে ইউরোপ অ্যামেরিকা ভিসা করে দিবে বলে ১৫-১৮ লক্ষ করে টাকা নিয়েছে৷ সে বর্তমানে সবার টাকা ফেরত না দিয়ে ঘানা ছেড়ে ইউরোপ পালিয়ে গেছে৷”
তার পরিচিত অন্তত ৫৫ জন বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার উদ্দেশ্যে আক্রায় অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন রিমন৷
শাহেদ* নামে আরেক অভিবাসী জানিয়েছেন, “আমি বর্তমানে ঘানাতে আছি ভাই৷ আমিও অ্যামেরিকায় যাওয়ার জন্য এসেছি৷ দালালে আমাকে নিয়ে এসেছে। এখানে এসেছি চার পাঁচ মাস হয়েছে এখনও কিছুই করতে পারিনি৷”
শাহেদও অন্যদের মতোই প্রথমে দুবাই আসেন৷ সেখানে ২০ দিন থেকে ই-ভিসা নিয়ে চলে আসেন ঘানা৷ তিনি বলেন, “এখানে অনেক বাঙালিকে এনে রেখেছে দালাল, দালালে এক একজনের কাছ থেকে ২০-২৫ লক্ষ টাকা নিয়েছে ফ্লাইট করাবে বলে, এখানে অনেকেই এসেছে দেড় বছর হয়ে গেছে৷ যাদের ফ্লাইট করানো হয় নাই ওদেরকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে৷ তাদের পাসপোর্ট দালালের হাতে। দালাল বলতেছে, এখন এই রোড বন্ধ হয়ে আছে চালু হলে তোমাদের ফ্লাইট করানো হবে৷’’
ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি এবং ফ্লাইট বুক করার জন্য সময় লাগে অনেক৷ কাউকে কাউকে অপেক্ষা করতে হয় এক বছরেরও বেশি৷ এই সময়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে ব্যবসার কথা বলে দালালরাই অভিবাসীদের বসবাসের অনুমতি জোগাড় করে দেন৷ কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই আফ্রিকার থাকার পুরোটা সময় খাওয়া এবং থাকার খরচ অভিবাসীদের আনতে হয় দেশ থেকেই৷
অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অনেকেই এরই মধ্যে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন দেশে৷ কিন্তু তাদের কাউকেই আর টাকা ফেরত দেয়া হয়নি৷
ইনফোমাইগ্রেন্টসকে শাহেদ জানিয়েছেন, “থাকা খাওয়ার খরচ বাড়ি থেকে এনে চলতে হয়৷ আমরা বাসা থেকে খুব কম বের হই৷ এখানে বাসা ভাড়া করে থাকি৷ আমরা নয় জনের মত আছি, আরো ছিলো প্রায় ৩০ জনের মতো৷ ওরা দেশে চলে গেছে৷ তাদেরকে দালাল এক টাকাও ফেরত দেয়নি৷”
বৈধ অভিবাসনে বাধা
আফ্রিকা ও ল্যাটিন অ্যামেরিকা হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার জন্য নানা ধাপে বাংলাদেশি অভিবাসীদের অন্তত ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়৷ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কেউ সংগ্রহ করেন ভিটেমাটি বন্ধক বা বিক্রি করে, কেউ নানা জনের কাছ থেকে ধার করে৷
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই পরিমাণ অর্থ খরচ করে দেশেও কিছু করা সম্ভব ছিল কিনা। অনেকে মনে করেন এই টাকা থাকলে সহজে ইউরোপ-অ্যামেরিকার নানা দেশের ভিসা বৈধভাবেই জোগাড় করাও সম্ভব৷
কিন্তু অনিয়মিত পথে রওনা হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা তা মানতে নারাজ৷ তাদের অনেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করেছেন৷ নিজেকে বিএনপির কর্মী দাবি করে জামান বলেন, তার নামেও দেশে ভুয়া মামলা রয়েছে। তিনি বলেন, “বিভিন্নভাবে পুলিশী হয়রানি তো রয়েছেই, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। আমি হয়তো সরকারি দলের কর্মী না৷ কিন্তু স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে যেকোনো দলকে সমর্থন করার অধিকার আমার রয়েছে৷ কিন্তু সেটা তারা নেগেটিভভাবে নেয়৷’’
অন্যদিকে, দুবাইয়ে ভ্রমণের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও যেভাবে সহজে ভিসা পাওয়া যায়, ইউরোপ বা অ্যামেরিকার ক্ষেত্রে তা প্রায় অসম্ভব৷ আর সে সুযোগই নানাভাবে দালালেরা কাজে লাগান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷
কিছু জানে না বাংলাদেশ দূতাবাস
অভিবাসনের জন্য ব্রাজিলকে বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে অভিবাসীরা জানিয়েছেন, দেশটিতে এরই মধ্যে অনেক বাংলাদেশি বসবাস করছেন। লিটন বলেন, ‘‘ব্রাজিলে আমাদের সহজেই থাকতে দেয়৷ সেখানো ঢোকাটাও সহজ৷ আমাদের আশেপাশের অনেক মানুষই এভাবে ওখানে গিয়ে থাকছে৷’’
অনিয়মিত অভিবাসন বিষয়ে জানতে চেয়ে ব্রাজিলে বাংলাদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। ইনফোমাইগ্রেন্টসকে পাঠানো একটি ফিরতি ইমেইলে দূতাবাস জানিয়েছে, “আপনার ইমেইলে পাঠানো বিষয়বস্তু (বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিলে অনিয়মিত অভিবাসন) সম্পর্কে কোনো তথ্য দূতাবাসের কাছে নেই।”