বাংলাদেশের ট্রাভেল খাতে গত এক দশকে বড় পরিবর্তন এনেছে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিগুলো (ওটিএ), ভ্রমণশিল্পের দখল করে নিয়েছে বড় একটি অংশ । ২০১৫ সালে যাত্রা শুরুর সময় ওটিএ প্ল্যাটফর্মে যেখানে মাত্র ১২% বিমান টিকিট বিক্রি হচ্ছিল, ২০২৫ সালে তা পৌঁছেছে প্রায় ৪০%-এ। প্রবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৭ সালের মধ্যে ৬০%-এ পৌঁছার সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় এই খাতটি চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সর্বশেষ ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ নামের একটি শীর্ষস্থানীয় ওটিএ কোটি কোটি টাকা গ্রাহক বকেয়া রেখে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। এর আগে ২০২২ সালে ‘হালট্রিপ’ নামে আরেকটি ওটিএ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের মধ্যে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর প্রতি আস্থা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং ট্রাভেল খাতের অন্যান্য অংশীজন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে এই ঘটনাগুলো কেন ঘটছে?
ওটিএ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই খাতে কাঠামোগত দুর্বলতা, তদারকির অভাব এবং লসের ভিত্তিতে টিকিট বিক্রির অসুস্থ প্রতিযোগিতা এর পেছনে দায়ী।
দেশের প্রথম অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি এমিবিডি’র চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম আকাশযাত্রাকে বলেন, “লস দিয়ে টিকিট বিক্রির প্রতিযোগিতা ওটিএ বন্ধের মূল কারণ। দীর্ঘদিন লসে ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা।”
তার পরামর্শ, “ওটিএ খাত টিকতে হলে সেবার মান, নতুন পণ্য এবং উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে বাজারে থাকতে হবে, প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।”
আরেক ওটিএ কর্মকর্তার ভাষায়, “অনেকে শুধুমাত্র লস দিয়ে বাজার ধরার খেলায় নেমেছিল। কেউ সময়মতো থেমেছে, কেউ ডুবে গেছে। সেই খেলায় ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধ হলো, আগামীতে বাকিরা বন্ধ হবে।”
২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করা ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ তার সহজ ইন্টারফেস ও ডিসকাউন্ট অফারের মাধ্যমে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। ২০২১ সালে বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ৪২ কোটি টাকার বেশি (৫০ লাখ ডলার) মূল্যে এটি অধিগ্রহণ করে। যদিও বলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি স্বতন্ত্রভাবে চলবে, কিন্তু ইভ্যালির আর্থিক কেলেঙ্কারির পথেই হাঁটে তারা। এরপর প্রতিষ্ঠানটির পতন সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র।
ফ্লাইট এক্সপার্টের মালিক ছিলেন মক্কা গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ রশিদ শাহ সম্রাট ও তার ছেলে সালমান বিন রশিদ শাহ সায়েম। দেখভাল করতেন ছেলে সালমান। হজ এজেন্সি মক্কা ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের মালিকও তারা। ২০২৩ সালে বাবা-ছেলের নামে কর ফাঁকির অভিযোগে সৌদি আরবে গ্রেপ্তারি ঘটনা আলোচনায় আসে।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালের শেষ দিকে বন্ধ হওয়া ‘হালট্রিপ’ চালাতেন পিকে হালদার, যিনি পরবর্তীতে ১১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশত্যাগ করেন। যাত্রা শুরুর একবছরে সবাইকে তাক লাগিয়ে ব্যাপক ছাড়ে টিকেট বিক্রি শুরু করে হালট্রিপ। ফলে মানুষ হালট্রিপের মাধ্যমে টিকেট কিনতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হালট্রিপ পিকে হালদারের প্রতারণার অংশ ছিল বলেই পরে প্রমাণিত হয়।
উদাহরণ টেনে এমিবিডি’র চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ বিমান টিকেট বিক্রির পর ৭% কমিশন দিচ্ছে। কিন্তু কিছু অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি কমিশন দিচ্ছিল ১১%। ফলে অনেক ট্রাভেল এজেন্ট সেদিকেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল।
শামসুল ইসলাম মনে করেন, সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যকর তদারকি থাকলে এই অনিয়ম ঠেকানো যেত। “তদারকি ও সুশৃঙ্খল প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে গ্রাহক ক্ষতির শিকার হতেন না, এবং সৎ ব্যবসায়ীদের গুডউইল বাড়ত,”— বলেন তিনি।
বাংলাদেশে প্রতি মাসে প্রা প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এয়ারটিকিট বিক্রি হয়, যার মধ্যে ১, হাজার কোটি টাকার বেশি আসে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে। পর্যটন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ওটিএ খাত দেশের ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২-এ পর্যটন খাতকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১৭টি শিল্পের মধ্যে তৃতীয় এবং সেবা শিল্পের মধ্যে নবম অবস্থানে রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশাল সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তবে সম্ভাবনার এই খাত যদি তদারকির বাইরে থাকে এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতায় পড়ে, তাহলে তা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।