শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০৩ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

বাংলাদেশের ভূস্বর্গ চলনবিল

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

প্রবাদে আছে, বিল দেখতে চলন, গ্রাম দেখতে কলম। চলনবিল যার নাম শুনলেই গা ছমছম করে ওঠে। থইথই জলে উথালপাতাল ঢেউয়ের কথা ভেবে। ষড়ঋতুর এই দেশে প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায় চলনবিলকে।

বর্ষায় সাগরের মতো বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে ভয়ংকর রূপ ধরে এ বিল। শরতে শান্ত জলরাশির ওপর ছোপ ছোপ সবুজ রঙের খেলা। হেমন্তে পাকা ধান আর সোঁদা মাটির গন্ধে ম ম করে চারদিক। শীতে হলুদ আর সবুজের নিধুয়া পাথার এবং গ্রীষ্মে চলনের রূপ রুক্ষ। যে কোনো ঋতুতে চলনবিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ।

ষড়ঋতুর এই দেশে প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায় চলনবিলকে। রূপ বদলের এই বৈচিত্র্য শরতের চলনবিল এক ভিন্ন জগৎ। বর্ষার চলনবিলের রুদ্র মূর্তি এখন শান্ত, জলরাশি স্থির। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নানা রঙের ফুল, হরেক রকম পাখির কলরব। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ সাজ। তাই চলনবিলে নিরাপদে নৌকা ভ্রমণ করার জন্য শরৎই সবচেয়ে ভাল সময়। বিশেষ করে বর্ষার সময় এই বিলের বিশালতা বৃদ্ধি পায়। আবার গ্রীস্মে এই বিল তার অন্য রূপ ধারণ করে।

তবে চলনবিল যত রূপেই আমাদের কাছে দৃশ্যমান হোক না কেন তার মধ্যে এর নৌকা ভ্রমণ অর্থাৎ অথৈ জলরাশির দৃশ্য আমাদের অন্তরে স্থায়ীভাবে গেঁথে থাকে।

দেখা যায়, বিস্তৃত জলরাশির বুকে ঢেউ ভাঙার খেলা। মাঝেমধ্যে দিগন্ত রেখায় সবুজের আলপনা। এরমধ্যে ঢেউ ভেঙে ছুটে চলেছে যান্ত্রিক শ্যালো নৌকা। আছে মাছ ধরার বিচিত্র আয়োজনও। এটাই বর্ষা মৌসুমের চলনবিল। জীব বৈচিত্র্যের বিপুল সমাহার। নাটোর-সিরাজগঞ্জ-পাবনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এ বিলের অবস্থান। শুকনো মৌসুমে বিলের আয়তন অনেক কমে গেলেও তা প্রাণ ফিরে পায় বর্ষাকালে। তাই ভ্রমণ পিপাসুদের বর্ষা মৌসুমে চলনবিল হয়ে উঠেছে উপযুক্ত গন্তব্য।

বিশালতার দিকে থেকে চলনবিল দেশের অন্যতম বড় বিল। ১৯০৯ সালে চলনবিলের জরিপের এক প্রতিবেদনে আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। এর মাঝে মাত্র ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকে। অবাক করার তথ্য এটাই যে, মাত্র ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের জায়গার মাঝে রয়েছে ৩৯টি বিল। এই ৩৯টি বিলসহ মোট ৫০টির ও বেশি বড় বড় বিলের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে আজকের চলনবিল। ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তনের ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ৩৯টি খাল ও অসংখ্য পুকুর।

দ্বীপের মতো গ্রামগুলো যেন একেকটা ভাসমান বাজার। বর্ষায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া, গ্রাম থেকে শহর, স্কুল-কলেজসহ যোগাযোগের সব জায়গায় ভাসমান মানুষগুলোর নিত্য সঙ্গীই যেন ঐতিহ্যবাহী ডিঙি নৌকা। কোনোটা চলছে পাল উড়িয়ে, কোনোটা ঠেলা নৌকা, আবার কোনোটা স্টিলের তৈরি ইঞ্জিনচালিত। চলনবিলের সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করেছে বালিহাঁস, তিরমূল, বাটুলে, মুরগি, হাঁস, খয়রা, মানিক জোড়, ডুটরা, চাপাখি, লোহাড়াং, মেমারচ, বোতক, নলকাক, সাদা বক, কানাবক, ফেফী, ডাহুক, চখা, বকধেনু, ইচাবক, করা, কাছিচোরা, রাতচোরা, ভুবনচিলা, মাছরাঙা, পানকৌড়িসহ নানা প্রজাতির পাখপাখালি।

এক সময় খাদ্য ও মৎস্য সম্পদের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিলো চলনবিল। বিলের মাছ ট্রেনযোগে যেত বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। মাছের সে সমাহার এখন তেমনটি না থাকলে বহু প্রজাতির দেশি মাছের দেখা মিলবে বিলে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য রুই, চিতল, বোয়াল, শিং, মাগুর, কই, শোল, গজার, টাকি, বাইম, পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, টাটকিনি, ভেদা ও চাঁদা। বিলের যেখানেই পানি আছে, সেখানেই চোখে পড়বে মাছ ধরার ধুম। সুতিজাল, ভেশাল, খাঁড়া জাল, দোয়ার, চাঁই, বড়শিসহ বিভিন্ন মাছ ধরার যন্ত্র নিয়ে মেতে আছেন সব বয়েসের মানুষ।

শরতের চলনবিলের রূপবিকাশে আরেকটি প্রধান আর্কষণ হচ্ছে শাপলা ফুল। এছাড়াও পদ্ম, কচুরিপানা ও বিলের নিচে থেকে গজিয়ে ওঠা ঘাস সৌন্দর্য বর্ধন করে থাকে। আর নানা রঙের বুনো ফুলের সাথে আছে সবুজ ধানের খেতে সাদা বক আর জলে পানকৌড়িদের ডুবসাঁতার খেলা।

চলনবিলের নাম করণের ইতিহাস আজও অজানা। বিশাল এই বিলকে কেন চলনবিল নামে ডাকা হয়, এর সঠিক উত্তর আজো কারো জানা নেই। তবে কথিত আছে, দুই হাজার বছর আগেও চলনবিল নামের কোন অস্তিত্ব ছিল না। এই অঞ্চল ছিল তখন সমুদ্রগর্ভে। কালের বিবর্তনে সমুদ্র সরে যায় দক্ষিণে। ব্রিটিশ গেজেটিয়ারে উল্লেখ রয়েছে, সমুদ্র সরে যাওয়ার পর তার স্মৃতি ধরে রেখেছে চলনবিল। অন্যান্য বিলের মতো এই বিল স্থির নয়। তাই হয়তো নদীর মতো তেমন কোন স্রোত ছিল বলেই এর নাম হয়েছিল চলনবিল।

ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ নামক বই থেকে জানা যায়, নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রাণীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল শেরপুর মিলেই বিশাল আয়তনের চলনবিল।

১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপনের পর উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণসহ তিন অংশে চলনবিল বিভক্ত হয়। বর্তমানে চলনবিল নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনার চাটমোহর, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জে অবস্থান করছে।

১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘চলনবিলের ইতিকথা বই থেকে জানা যায়, ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। এরপর ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপের এক প্রতিবেদনে আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকে। এসব নদ-নদী ও খালগুলোর মধ্যে রয়েছে আত্রাই, করতোয়া, বড়াল, মরা বড়াল, তেলকুপি (মরা আত্রাই), নবী হাজির জোলা, হক সাহেবের খাল ইত্যাদি।

চলনবিলে রয়েছে বিভিন্ন নামের অনেক বিল! জানিয়ে রাখা ভালো, বিস্তীর্ণ চলনবিলের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন নামে ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল। প্রধান ৩৯টি বিলসহ মোট ৫০টির বেশি বড় বড় বিলের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে চলনবিল। এই বিলগুলো চলনকে বিশালতা দিয়েছে। নানা রূপে সাজিয়েছে বিলের সৌন্দর্যকে।

বিলগুলোর মধ্যে উলে­খযোগ্য হচ্ছে ছয়আনি বিল, বাঁইড়ার বিল, সাধুগাড়ি বিল, সাঁতৈল বিল, কুড়ালিয়া বিল, ঝাকড়ার বিল, কচুগাড়ী বিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ি বিল, চেচুয়া বিল, টেঙ্গরগাড়ি বিল, খোলার বিল, কুমীরাগাড়ি বিল, খৈগাড়ি বিল, বৃগরিলা বিল, দিগদাড়িয়া বিল, খুলুগাড়ি বিল, কচিয়ারবিল, ধলার বিল, ধরইল বিল, বড়বিলা, বালোয়া বিল, আমদাকুরি বিল, বাঙ্গাজালি বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরী বিল, রঘু কদমা বিল, কুমিরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়ি বিল, রহুয়া বিল, সোনাডাঙ্গা বিল, তাড়াশের বড় বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুণের বিল, নলুয়াকান্দি বিল, ঘরগ্রাম বিল, বেরোল বিল, কচিয়ার বিল, কাশিয়ার বিল, কাতল বিল, বাঘ মারা বিল, চিরল বিল, ডিকশী বিল, রুখলি ডাঙা বিল, রউল শেওলা বিল, পাতিয়া বিল, আইড়মারি বিল, কৈখোলা বিল, কানচগাড়ি বিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গা বিল, মেরিগাছা বিল, খলিশাগাড়ির বিল প্রভৃতি।

এছাড়াও নাটোরের গুরুদাসপুরে খুবজিপুরগ্রামে দেখা যাবে চলনবিল জাদুঘর। এখানে পাবেন চলনবিলের বিভিন্ন ঐতিহ্যময় জিনিসপত্র। শান্ত জলরাশির, নির্মল বাতাসে ভরপুর প্রকৃতি আর প্রাচীন নিদর্শন দেখতে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল থেকে।

বিলের মধ্যে যখন আপনি নৌকাভ্রমণে ব্যস্ত থাকবেন, তখন শুনতে পাবেন, আপনি একটি নদীও পার হচ্ছেন। বেশ কিছু নদ-নদী ও খাল আঁকাবাঁকা জলরাশিতে তৈরি করেছে চলনবিলের আলাদা সৌন্দর্য। উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণ তিন অংশে চলনবিল বিভক্ত হয়।

বর্তমানে চলনবিলে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া; পাবনার চাটমোহর, ভাক্সগুরা, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন, আটটি পৌরসভা ও ১ হাজার ৬০০টি গ্রাম রয়েছে। পুরো অঞ্চলের লোকসংখ্যা ২০ লাখের বেশি।

এ কারণে বিশাল বিল, জলরাশি, সবুজ ধানখেত, ফুল, পাখির পাশাপাশি চলনবিলে বেড়াতে গেলে পরিচয় হবে কিছু দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে। দেখা পাবেন দেশের বড় গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম কলম গ্রামেরও, যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এর মধ্যে পাবনার চাটমোহরে শাহি মসজিদ, জগন্নাথমন্দির; ফরিদপুরের বনওয়ারী নগর জমিদারবাড়ি; সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দেখা যাবে রাধাগোবিন্দমন্দির, রশিকমন্দির, শিবমন্দির, বড় কুঞ্জবন দিঘি, উলিপুর দিঘি, মথুরা দিঘি, মাকরসন দিঘি। তাড়াশের কাছে পিঠে বিনসারা গ্রাম।  সেখানে গিয়ে দেখা মিলবে কিংবদন্তি বেহুলা সুন্দরীর বাবা বাছো বানিয়া ওরফে সায় সওদাগরের বসতভিটা জিয়ন ক‚প। এ ছাড়া সিংড়ার হযরত খাসি দেওয়ানের মাজার, ডুবন্ত সড়ক,চৌগ্রাম জমিদার বাড়ি ,নাটোরের গুরুদাসপুরে খুবজিপুর গ্রামে দেখা যাবে চলনবিল জাদুঘর। এখানে পাবেন চলনবিলের বিভিন্ন ঐতিহ্যময় জিনিসপত্র।

চলছে শরৎকাল। শান্ত জলরাশি, তাজা অক্সিজেনে ভরপুর নির্মল প্রকৃতি আর প্রাচীন নিদর্শন দেখতে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল থেকে।

কীভাবে যাবেন চলনবিল ঘুরতে

ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের কাছিকাটা অথবা পাবনার চাটমোহর, ভাক্সগুরা, ফরিদপুর। সবখানেই বাসযোগে যাওয়া যাবে যাবে। অন্যদিকে ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে আসলে চাটমোহর অথবা ভাক্সগুরার বড়াল ব্রিজ স্টেশনে নেমে চলনবিল ঘোরা যাবে। দেশের অন্য যেকোনো স্থান থেকেই খুব সহজে বাসে আসা যাবে সিরাজগঞ্জের কাছিকাটা। কাছিকাটা নামলে সেখান থেকে ছোট–বড় নৌকায় চলনবিল ঘোরা যাবে। অন্যদিকে ব্যাটারিচালিত নৌকায় বিলের রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়ানো যাবে। কাছিকাটা থেকে আট কিলোমিটার দূরে চাটমোহর বাজার। এছাড়া নাটোর শহরে নেমে অনায়াসেই যেতে পারবেন সিংড়ায়। সেখান থেকেও ঘুরতে পারবেন চলনবিল।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com