আপনি যদি ‘৮০ এবং ‘৯০-এর দশকে বাংলাদেশের কোনো গ্রামে বড় হয়ে থাকেন, তাহলে সেসময়ের মুসলিম বিয়ের খাবারের মেন্যুর কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। বিয়ের খাবার সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল: একটি আয়োজকদের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের জন্য; আরেকটি অতিথিদের জন্য একটি বিশেষ মেনু।
যেমন, বিয়ের দিন বরের পরিবার কনের বাড়িতে এলে তাদের পোলাও, মুরগির রোস্ট, ডিম ভুনা ও গরুর মাংস পরিবেশন করা হতো। অন্যদিকে, হোস্ট বা কনের পরিবার সাদা ভাত, হলুদ ডাল বা মুগ ডাল এবং গরুর মাংসের তরকারি খেতো। নোয়াখালী ও আশপাশের অঞ্চলে একে ‘চিওঁ খানা’ বা বিশেষ খাবার বলা হতো।
হিন্দু বিয়েতে একটি বা দুটি মাছ এবং সবজির পদ থাকত, এবং গরুর মাংসের পরিবর্তে তারা খাসির মাংস পরিবেশন করত। মিষ্টান্ন হিসেবে সবাইকে মিষ্টি দই ও বরের আনা মিষ্টি দেওয়া হতো।
স্থানীয় বাবুর্চি (শেফ) এবং বাড়ির লোকজন মিলে এই খাবার রান্না করতেন। এর সঙ্গে কোনো কনভেনশন হল, কমিউনিটি সেন্টার বা ক্যাটারিং সংস্থার যোগসূত্র থাকত না।
মালিবাগের ইউসুফ ডেকোরেটর্সের মালিক ইব্রাহিম মিয়া বলেন, ‘সব অতিথিকে পোলাও ও রোস্ট পরিবেশন করার সামর্থ্য সবার ছিল না। সহজ কথায়, মানুষের এত টাকা ছিল না।’
তবে গত কয়েক দশকে দৃশ্যপট বদলে গেছে। এখন শুধু বিয়ের টেবিলেই যে বিভিন্ন মুঘলাই পদ থাকে তা নয়, ক্যাটারিং সংস্থাগুলোর মেনুতে বিভিন্ন দেশের খাবার থাকে।
গত দশক পর্যন্ত, বিশেষত শহরাঞ্চলের বিয়ে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্য সব কিছু সরবরাহ করতো ডেকোরেটর সংস্থাগুলো। তারা চেয়ার, টেবিল এবং কাটলারি থেকে শুরু করে হালকা সাজসজ্জা এবং এমনকি রান্নার জন্য শেফ পর্যন্ত সব সরবরাহ করত। এখন বিবাহ শিল্পের পরিসর অনেক বেড়েছে এবং প্রসাধন ও ক্যাটারিং দুটি পৃথক শিল্প হয়ে উঠেছে।
মানুষের আর স্থানীয় শেফ খুঁজে বেড়ানোর এবং থালাবাসন ও মুদিখানার তালিকা তৈরি করার সময় নেই। তারা চায় এমন একটি পরিষেবা, যারা পরিবেশনের জন্য সবকিছু একেবারে রেডি করে আনবে।
প্রিমিয়ার ক্যাটারিংয়ের ব্যবস্থাপক মারুফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের হিসাব অনুযায়ী ক্যাটারিং শিল্প এখন বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার শিল্প।’
তিনি বলেন, ‘শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান নয়; মানুষ এখন অফিস পার্টি, জন্মদিন এবং খতনা অনুষ্ঠানের জন্যও ক্যাটারিং সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। এমনকি কনভেনশন হলগুলোও এখন ক্যাটারিং কোম্পানি নিয়ে কাজ করে।’
আসুন আমরা একটা খসড়া হিসাব করি। একটি নির্দিষ্ট শুক্রবারে যদি ঢাকার ১০০টি কনভেনশন হলে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং প্রতি অনুষ্ঠানের গড় বিল যদি চার লাখ টাকা হয়, তাহলে একদিনে মোট চার কোটি টাকা। বছরে ৫২টি শুক্রবার ও ৫২টি শনিবার মিলিয়ে, শুধু এই ১০০টি কনভেনশন হল থেকেই বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪১৬ কোটি টাকা।
মারুফ ব্যাখ্যা করেন, ‘শীতের সময় প্রায় প্রতিদিনই বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠান হয়। বিয়ের আয়োজনের জন্য যে কোনো ছুটি ও ঈদের ছুটিও জনপ্রিয় সময়। আপনি যদি এভাবে বিবেচনা করেন এবং সারা দেশের সব ক্যাটারিং সংস্থা এবং কনভেনশন হলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাহলে বলতেই হয় ক্যাটারিং শিল্প একটি উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আয়ের খাত হয়ে উঠেছে।’
পোলাও থেকে কাচ্চি এবং জর্দা থেকে বাকলাভা
হোসেন বলেন, বাংলাদেশে বিয়ের খাবারের মেন্যুতে আধুনিকতার ছোঁয়া খুব বেশি দিন হয়নি। বেশিরভাগ পরিবর্তন গত ২০ বছরে ঘটেছে।
ইব্রাহিম মিয়া বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে বেসিক পোলাও, রোস্ট, গরুর মাংস, ডিম, জর্দা মেন্যুর সঙ্গে বাংলা-চাইনিজ খাবারও বিয়ের মেনুতে জায়গা করে নিয়েছিল। তবে ঢাকার একটি পরিসরেই শুধু এসব খাবার চলত। কারণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থাই স্যুপ, চাইনিজ ভেজিটেবল ও অনথন খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।’
২০০০ সালের প্রথম দশকে টিকিয়া কাবাব এবং বোরহানী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিরিয়ানি ছিল, কিন্তু সবাই এটিকে মেনে নিতে পারত না। গত দশকে ‘বিয়াবাড়ির কাচ্চি’ ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এমনকি কাচ্চি রান্নার জন্য ব্যবহৃত চালেও পরিবর্তন এসেছে – চিনিগুড়া থেকে বাসমতি। আর গত কয়েক বছর ধরে, শুধু কাচ্চি বিরিয়ানি মেন কোর্স কিংবা রাইস আইটেম নয়; মানুষ এখন স্টার্টার হিসেবে নান ও চিকেন তন্দুরি বা ঝাল ফ্রাই ও রায়তা পছন্দ করে।
আজকাল মানুষ তাদের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী মেনু সেট করে। বিষয়টি অতিথিদের খাওয়ানোর চেয়েও স্ট্যাটাস দেখানোই বেশি। কেউ কেউ খাওয়াতে চায়, আবার কেউ দেখাতে চায় যে তারা কী পরিবেশন করছে। এসব মানুষ বিশাল মেনু রাখে, যাতে এর মধ্যে সব ধরনের আইটেম থাকে।
আশির দশকে মিষ্টি দই আর রসগোল্লাই ছিল একমাত্র মিষ্টান্ন। নব্বইয়ের দশকে মেনুতে জর্দাভাত যুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০০ সালের প্রথম দশকে ফিরনি, পায়েস ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এখন ডেজার্ট সেকশনে শাহি টুকরা, বাকলাভা, মালাই বুন্দিয়া, গুলাব জামুন ইত্যাদি বিভিন্ন আইটেম পাওয়া যায়। গত ২০ বছরে মানুষের স্বাদের মানদণ্ড পরিবর্তিত হয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে এবং তাদের ক্রয় ক্ষমতাও পরিবর্তিত হয়েছে। গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে, বিশেষত সিনেমা ও নাটকের কল্যাণে মানুষ এখন ভারতীয় বিভিন্ন খাবার দিয়ে মেনুতে বৈচিত্র্য আনতে চায়।
স্থানীয় বাবুর্চি থেকে ক্যাটারিং শিল্প
আগে যেসব ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় বাবুর্চি বা শেফ তার দল নিয়ে বিয়ের আগের রাতে রান্না শুরু করতেন, আজকাল কোনো শহুরে বিয়েতে তাদের দেখা যায় না।
কিন্তু দু’দশক আগেও বিয়ে, নামকরণ অনুষ্ঠান বা জন্মদিন; যে কোনো অনুষ্ঠানের জন্য মানুষ স্থানীয় বাবুর্চি বা শেফের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বাবুর্চি যে চার-পাঁচটা আইটেম রান্না করতে পারতেন, সেগুলো দিয়ে মেনু কার্ড বানিয়ে দিতেন।
এখন এটি কর্পোরেট সংস্কৃতি সম্বলিত যথার্থ ক্যাটারিং শিল্পে পরিণত হয়েছে।
মারুফ বলেন, ‘আপনি যদি কোনো ক্যাটারিং প্রতিষ্ঠানে যান, তারা মুঘল, চীনা ও ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না করে দেবে। আপনার প্রয়োজন অনুসারে, তারা আপনার পছন্দসই প্রতিটি মেনুর ব্যবস্থা করতে পারে। আপনি বিল পরিশোধ করুন, আর আইটেমের নাম বলুন – ইলিশ, পমফ্রেট, গলদা চিংড়ি – সব কিছুই সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ, এমনকি কনভেনশন সেন্টারগুলোও খ্যাতিমান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্যাটারিং সংস্থা নিয়োগ করতেই পছন্দ করে। বাজার ও ব্যবসা বাড়াতে ক্যাটারিং কোম্পানিগুলোও তাদের মেনুতে আনতে চায় বৈচিত্র্য। তারা এখন গ্রাহকদের নতুন আইটেম যোগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।’
মারুফ ও ইব্রাহিমের মতে, বর্তমানে ঢাকায় অর্ধশতাধিক সুপ্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য ক্যাটারিং সার্ভিস কোম্পানি রয়েছে। কেউ কেউ বছরে ২০০-৩০০টি অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বা প্রজেক্টও পান।
প্রিমিয়ার ক্যাটারিং বছরে ১৫০টি বড় প্রজেক্ট পায়। যাদের রেডি ক্যাটারিং কিচেন আছে, তারা আকদ-এর মতো ছোট আয়োজনের জন্য ২৪/৭ অর্ডার নেয়।
বর্তমানে এটি একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প হলেও, ব্যাংকগুলো এখনও ক্যাটারিং ব্যবসায় ঋণ দেয় না।
মারুফ বলেন, ‘আমরা প্রতিটি প্রকল্পের জন্য ১৫ শতাংশ সার্ভিস ট্যাক্স দিচ্ছি, কিন্তু ব্যাংক আমাদের ঋণ দিতে চায় না।’