ঢাকার পুরান টিকাটুলির সরু গলিপথ দিয়ে এগোলেই এক সময় দেখা মিলত রঙিন উঠোনের একটি বাড়ি। সেই বাড়িতেই ১৯৫৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম নিয়েছিলেন সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা, যিনি দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী পাইলট হিসেবে নিজের নাম লিখে গেছেন। পরিবারে আদরের নাম ছিল ‘তিতলী’, ভাইবোনেরা ডাকত ‘লিটল আপা’। নামের মতোই তিনি ছিলেন উড়ন্ত স্বপ্নের অধিকারী, প্রাণবন্ত ও দুঃসাহসী।
শৈশবে রোকসানার দিনগুলো কেটেছে হাসি, খেলাধুলা আর নতুন কিছু শেখার নেশায়। পুতুল খেলায় তেমন মন বসত না, বরং সাইকেলে চড়ে গলিপথ ছুটে বেড়ানো, বন্ধুদের সঙ্গে টেবিল টেনিস বা ব্যাডমিন্টনে ব্যস্ত থাকা ছিল তার প্রিয় কাজ। পরিবারটি ছিল সংস্কৃতি ও শিক্ষাপ্রেমী। বাবা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এবং মা সবসময়ই সন্তানদের সাহস করে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিতেন।
রোকসানার পড়াশোনার পথও ছিল উজ্জ্বল। ১৯৬৯ সালে কামরুন্নেসা গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭৩ সালে শেরে বাংলা গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ইডেন কলেজ থেকে বিএসসি সম্পন্ন করেন। শুধু একাডেমিক শিক্ষায় নয়, ভাষা শিক্ষায়ও ছিল তার গভীর আগ্রহ—স্প্যানিশ, জার্মান, ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন। এমন বহুমুখী প্রতিভা তখনকার সময়ে খুবই বিরল ছিল, বিশেষত একজন নারীর জন্য।
১৯৭৬ সাল ছিল রোকসানার জীবনের মোড় ঘোরানোর সময়। সেবার তিনি ভর্তি হলেন বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাবে। ছোটবেলা থেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হতো—“একদিন আমি এখান দিয়ে উড়ে যাব।” দুই বছরের মধ্যেই ১৯৭৮ সালে তিনি পেয়ে গেলেন কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স। খুব দ্রুতই ফ্লাইং ক্লাবের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব নিতে শুরু করেন।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে যখন বাংলাদেশ বিমানে ক্যাডেট পাইলট পদে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করলেন, তখন সামনে এল এক অপ্রত্যাশিত বাধা। কর্তৃপক্ষ জানাল, নারী প্রার্থীদের আবেদন গ্রহণ করা হবে না। অথচ রোকসানার ফ্লাইং আওয়ার ছিল অনেক পুরুষ প্রার্থীর চেয়েও বেশি। এটি ছিল একেবারেই স্পষ্ট বৈষম্য, যা তাকে মেনে নিতে হয়নি।
তখনই তিনি সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। ১৯৭৯ সালের ৩১ মে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হল তার খোলা চিঠি—‘বাংলাদেশ বিমান বনাম মহিলা বৈমানিক’। সেখানে তিনি লিখলেন, “আমি এক বিন্দু সুবিধা চাই না, শুধু মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে আমাকে যেন আমার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা না হয়।” এই চিঠি জনমতকে নাড়িয়ে দিল। সুশীল সমাজ, নারী সংসদ সদস্য, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই তার পক্ষে দাঁড়াল।
অবশেষে সরকারি হস্তক্ষেপে বৈষম্যমূলক নিয়ম তুলে নেওয়া হলো। ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর রোকসানা যোগ দিলেন দেশের প্রথম নারী ক্যাডেট পাইলট হিসেবে। সেটি শুধু তার ব্যক্তিগত বিজয় ছিল না, বরং বাংলাদেশের নারীদের জন্য আকাশে উড়ার দ্বার উন্মোচনের মুহূর্তও ছিল।
এরপর রোকসানা দ্রুতই ফার্স্ট অফিসারের পদে উন্নীত হন। সহকর্মীরা তাকে মনে রাখেন সবসময় আত্মবিশ্বাসী, হাসিখুশি ও মনোযোগী হিসেবে। তার স্বপ্ন ছিল একদিন ক্যাপ্টেন হওয়া এবং আরও বেশি তরুণীকে এই পেশায় উৎসাহিত করা। কিন্তু সেই স্বপ্নের মাঝপথে এসে থেমে যায় তার যাত্রা।
১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট, এক বর্ষণমুখর সকালে রোকসানা একটি ফকার-২৭ বিমান নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। প্রবল ঝড়বৃষ্টি ও কুয়াশায় ঢাকার রানওয়েতে অবতরণ করতে গিয়ে প্রথমবার ব্যর্থ হন। দ্বিতীয়বারেও একই পরিণতি। তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় কুয়াশায় ঢেকে থাকা একটি খোলা স্থানকে রানওয়ে ভেবে ল্যান্ড করার চেষ্টা করেন। ভুল অনুমানের কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই নিভে যায় ৫১টি প্রাণ, যার মধ্যে ছিলেন রোকসানাও। তখন তার বয়স মাত্র ২৯ বছর।
তার একমাত্র সন্তান সৈয়দ শোয়েব হাসান বনি তখন মাত্র ৮ বছরের শিশু। মায়ের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পরিবার পুরান টিকাটুলিতে প্রতিষ্ঠা করে ‘ক্যাপ্টেন রোকসানা’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন এবং প্রকাশ করতে শুরু করে ‘রোকসানা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা।
আজ বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতে প্রায় ১৭ জন নারী পাইলট কর্মরত আছেন, অনেকে ক্যাপ্টেনের পদে পৌঁছেছেন। বড় বড় আধুনিক বিমান উড়াচ্ছেন তারা। প্রতিটি নারীর উড়াল গল্পে কোথাও না কোথাও রোকসানার নাম জড়িয়ে আছে। কারণ তিনি পথ দেখিয়েছিলেন, প্রমাণ করেছিলেন—আকাশ শুধু পুরুষের নয়, নারীরাও ডানা মেলতে পারে সমান শক্তিতে।
রোকসানার জীবন যেন এক অসমাপ্ত কবিতা, যেখানে স্বপ্ন ছিল উঁচুতে, পথচলা ছিল সাহসী, আর শেষটা ছিল অকাল ও বেদনাদায়ক। তবুও তার গল্প আজও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয়—অসীম আকাশের মতোই নারীর সম্ভাবনাও সীমাহীন।