রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ০৮:০০ অপরাহ্ন

বসন্ত এসে গেছে

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫

প্রকৃতির অকৃত্রিম দানে নবরূপে সেজে উঠছে বসন্ত। আর প্রতিটি ঋতুর মতোই বসন্তের সঙ্গে নিবিড় যোগ শান্তিনিকেতনের। এখানে বসন্তের এক আলাদা অনুভূতি। সারি সারি গাছে নানা রঙের ফুলে জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে। এক দিকে বসন্তের আগমনে কোকিলের সুমিষ্ট গান। অন্য দিকে ভ্রমরের খেলা। আশ্রমের চার দিকে যেন গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। কোপাইয়ের তীরে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে কৃষ্ণচূড়া, পলাশের রক্তিম উচ্ছ্বাস। পূর্বপল্লির রাস্তার দু’ধার নানা রঙের বুগেনভিলিয়া বা বাগানবিলাসের রূপের মাধুরীতে পরিপূর্ণ। ছাত্রাবাসের ছাদের পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে শিমুল। আর মেলার মাঠে বসন্তের ‘ফাগুন বৌ’ ফুটে উঠছে। চার দিকে দেখলেই মনে হবে এ যেন ‘নানা রঙের বসন্ত’। ফাগুন হাওয়ার দোল লেগেছে বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে প্রকৃতির সবুজ অঙ্গন। শুধু তা-ই নয়, গাছে গাছে ফুটেছে আমের মুকুল। আশ্রম প্রাঙ্গণে এত দিন শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে।

ঋতুরাজ বসন্তকে প্রকৃতি বরণ করে জানিয়েছে, ‘স্বাগত বসন্ত’। বসন্তের এই আগমনে আমাদের মনে ভেসে ওঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গান, “আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…।” সোনাঝুরি কিংবা আশ্রম প্রাঙ্গণে ঝরা পাতা যেন কত না বলা কথা শুনবে বলে বসে থাকে। ক্রমশ গাছে গাছে কচি পাতার আবির্ভাব হতে শুরু করেছে। চার পাশ নানা রঙের ফুলে ভরে গেছে। দক্ষিণে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে যেন শীতের জরাগ্রস্ত পৃথিবীর বুকে শিহরন জাগাতে। বাতাসের মর্মর ধ্বনি আর কোকিলের কুহু কুহু ডাক বাংলার প্রকৃতিতে অনুরাগের প্লাবন নিয়ে আসে। কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, শুকনো ঝরাপাতার এলোমেলো শয্যা দেখে মনে হয় প্রকৃতির মিলন এই বসন্তেই। বসন্ত মানেই তো পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। মিলনের এই ঋতু বাসন্তী রঙে সাজিয়ে তোলে সকলের হৃদয়কে। আর অপেক্ষা করে কয়েক দিন পর বসন্ত উৎসবের রং যেন সবার মর্মে ও কর্মে লাগে।

বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় রয়েছে বসন্তের বন্দনা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক বাউল কবির মনকেও নাড়া দিয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। সেই জন্যই বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের সুবাসে মন আনচান করে বাউল কবির। গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড়, গাছ, মাঠভরা ফসলের খেত বসন্তের রঙে রঙিন। গ্রামের পথ পেরিয়ে শহরের ইট-পাথরের জীবনেও বসন্ত আসে। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে— “ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/ তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/… আমার বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ।”

দোলের স্মৃতি

‘দোলের আশ্চর্য দরবেশ’ (রবিবাসরীয়, ৯-৩) শীর্ষক প্রবন্ধের মাধ্যমে দোলের স্মৃতির এক অপূর্ব ছবি এঁকেছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। ফাগুনে দরবেশ-প্রকৃতি যখন রঙিন আলখাল্লায় সেজে ‘নব বসন্তের দানের ডালি’ নিয়ে দুয়ারে হাজির হয়, তখন দোল এলেই ফিরে দেখার সময় আসে, অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের মাধ্যমে বোঝা যায় বয়স বাড়ছে। তবু গেয়ে ওঠে মন, “আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।/ সুরের আবীর হানব হাওয়ায়, নাচের আবীর হাওয়ায় হানে।”

প্রকৃতিরানির কতই না সাজগোজ। নিত্যনতুন ফুলে ফুলে সেজে ওঠেন তিনি। তার তো নিত্য-দোল। কিন্তু, দোল-খেলা কেন ভিন্ন? হার-জিত নেই বলে। আবির মাখানো, পিচকারি থেকে অন্যকে, অপরিচিতকে রং ছড়িয়ে দেওয়ার অনাবিল আনন্দই তো দোল। দোলের দিন লেখাপড়া থেকে অলিখিত ছাড়, দল বেঁধে হইহল্লা, শুধু মায়ের নির্দেশ বেশি দূরে না যাওয়া। সব ক’টি ভাইবোনের জন্য প্যাকেট প্যাকেট আবির কেনার সামর্থ্য ছিল না বাবার। মা ভিন্ন ভিন্ন পুঁটলি করে দিতেন যা ফুরিয়ে যেত নিমেষে। তার পর অন্যের আবিরে ভাগ বসানো। বালতিতে রং গুলে এক বন্ধু বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত ওর দাদার সঙ্গে। চেনা-অচেনা প্রত্যেককে রং দিত, হাসির হল্লাবাজিতে পাড়া ছয়লাপ হত। তখন কি আর প্রিয়-অপ্রিয় অনুভবের দিন ছিল? একটু বড় হতে, ক্লাস ইলেভেনে, কো-এড স্কুল হওয়ার সুবাদে কোথায় যেন সুপ্ত ছিল দোল-ভালবাসা, প্রকাশের জন্য ছটফট করত, যা প্রায়শই অব্যক্ত থেকে যেত।

বড়রা বার হত একটু বেলায়। তাদের ঠিক করা থাকত টার্গেট। ঝুমাদি বা পিঙ্কিদিরাও যেন প্রস্তুত হয়ে থাকত। আবিরের স্পর্শ থেকে সে সময় কত প্রেমের যে জন্ম হত, সে সব ফুরিয়েও যেত একটা সময়, কোনও দাগ না রেখেই। কিছু অবশ্য পরিণতি পেয়েছে পরে, ‘দীপ্তেশজেঠু’র মতো মানুষ যিনি ত্যাজ্য-কন্যা করেছিলেন তাঁর অপছন্দের ‘নবকা’র সঙ্গে দোলের দিন পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে, কয়েক বছর পর ফুটফুটে নাতি বা নাতনির জন্য রং কিনতে বেরোতে দেখা গিয়েছে তাঁকেই। এ ঘটনা আকছার না হলেও ঘটে চলে আজও, অবিরাম। কারণ, দীপ্তেশজেঠুরা ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাননি। দীপ্তিদিরাও স্বমহিমায় বিরাজ করছেন।

সেই কাঠের শুকনো পাতা, ডাল, কাঠের টুকরো জড়ো করে প্রাক্-দোলের সন্ধেতে বুড়ির-ঘর পোড়ানো এখন শুধুই স্মৃতি। বিটনুন দিয়ে আলুপোড়া খেতে গেলে বাড়ির অনুমতি মিলবে না। হয়তো গাঁয়ে-গঞ্জে এখনও নেড়াপোড়া হয়। এও এক ঐতিহ্য বটে। নেড়াপোড়া বা বুড়ির ঘর পোড়ানোর অর্থ অশুভের বিনাশ। কথিত আছে, প্রহ্লাদ ও মানব জাতি বাধ্যবাধকতা ও ভয় থেকে মুক্তি পায়। নৃসিংহ অবতারের দ্বারা হিরণ্যকশিপু বধের কাহিনি অশুভর উপর শুভর জয়কে নির্দেশ করে। হোলিকা-দহন এই ঘটনারই সূত্র।

প্রকৃতি কেমন করে শিমুল, পলাশের রঙে সাজিয়ে নেয় নিজেকে, এই দোলের সময়। ‘নীল দিগন্ত’-এ ফুলের আগুন লাগে। “দীর্ঘ শীতের পর আজ মধ্যাহ্নে প্রান্তরের মধ্যে নববসন্ত নিশ্বসিত হইয়া উঠিতেই নিজের মধ্যে মনুষ্যজীবনের ভারি একটা অসামঞ্জস্য অনুভব করিতেছি। বিপুলের সহিত, সমগ্রের সহিত তাহার সুর মিলিতেছে না। শীতকালে আমার উপর পৃথিবীর যে সমস্ত তাগিদ ছিল, আজও ঠিক সেই-সব তাগিদই চলিতেছে। ঋতু বিচিত্র, কিন্তু কাজ সেই একই। মনটাকে ঋতুপরিবর্তনের উপরে জয়ী করিয়া তাহাকে অসাড় করিয়া যেন মস্ত একটা কী বাহাদুরী আছে। মন মস্ত লোক, সে কী না পারে। সে দক্ষিনে হাওয়াকেও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া হন্‌হন্‌ করিয়া বড়োবাজারে ছুটিয়া চলিয়া যাইতে পারে। পারে স্বীকার করিলাম, কিন্তু তাই বলিয়াই কি সেটা তাহাকে করিতেই হইবে? তাহাতে দক্ষিনে বাতাস বাসায় গিয়া মরিয়া থাকিবে না, কিন্তু ক্ষতিটা কাহার হইবে?” (‘বসন্তযাপন’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। ক্ষতিটা আমাদের। ক্ষতিটা সকলের। কত গান, কবিতা, গীতি আলেখ্য দিয়ে বসন্তোৎসব হয়। “ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌, লাগল যে দোল” গেয়ে পাড়া পরিক্রমা হয়।

পাখিদের ক্ষতি

‘এক নজরে’ কলামে ‘নিষিদ্ধ দোল’ (১০-৩) নামে যে অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত হয়েছে সেই সম্পর্কে বলতে চাই, আমি সোনাঝুরি হাটে নিয়মিত যাতায়াত করি। ওই হাটটিতে কোনও বৈদ্যুতিক আলো নেই। তার কারণ বনাঞ্চলের পশুপাখিদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়। বন দফতরের এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই।

কিন্তু বর্তমানে যত হোটেল অবাধে সোনাঝুরি হাটের পাশে গজিয়ে উঠেছে, সেটি উদ্বেগজনক। হোটেলগুলোর প্রচণ্ড আলো রাতের অন্ধকারকে হার মানায়। সোনাঝুরি হাটের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করার পিছনে এই হোটেলগুলি অনেকাংশে দায়ী। প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com