গত কয়েক বছরের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের পোর্টফোলিও বা কার্যালয় নতুন দেশে স্থানান্তরিত করছে। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের জায়গা বদলের এই হাওয়ায় কিছু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সুবিধা ভোগ করছে সিঙ্গাপুর, জাপান ও ভারত। আর মাশুল গুনছে হংকং।
ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) সম্প্রতি এক পূর্বাভাসে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, হংকংয়ের ওপর চীনের কঠোর পদক্ষেপ, মার্কিন-চীন সম্পর্কের অবনতি, মুদ্রার অস্থিরতা, নিয়ন্ত্রণ বিধিবিধানের পরিবর্তন এবং প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার কারণে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোতে গত কয়েক বছরে অস্থিরতা দেখা গেছে। এই প্রবণতা আরও কয়েক বছর বজায় থাকবে।
জাপান ও ভারতের উন্নতি
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগকারীরা চীনে ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন। এ কারণে তারা চীনের পাশাপাশি জাপান, ভারত ও এশিয়ার অন্য দেশে নিজেদের কার্যালয় খুলছেন। বিনিয়োগকারীদের এই কৌশল ‘চায়না প্লাস ওয়ান স্ট্র্যাটেজি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
ভারত ও জাপানে নিজেদের কার্যালয় খুললেও দেশ দুটির শেয়ারবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের কিছুটা উদ্বেগ রয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে প্রতিবেশী অন্য দেশের তুলনায় ভারতের শেয়ারবাজারের উচ্চ মূল্য-আয় (পি/ই) অনুপাতের কথা বলা যায়। এটা ভবিষ্যতে শেয়ারবাজারের লেনদেনে প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে জাপান নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ একটু ভিন্ন প্রকৃতির। যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে নির্বাচিত হচ্ছেন তার ওপর দেশটির শেয়ারবাজারের অনেক কিছু নির্ভর করছে। যদি এমন কেউ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন যিনি আরও বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি গ্রহণ করবেন, তাহলে বৈরী ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জাপানের শেয়ারবাজার আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রা ইয়েনের মান আরও কমতে পারে।
সিঙ্গাপুরের চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক পরিসরে সিঙ্গাপুরের শেয়ারবাজারের সুনাম রয়েছে। এই শেয়ারবাজার একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। চীনের অব্যাহত হস্তক্ষেপের কারণে অনেক বিনিয়োগকারী হংকং ছেড়ে সিঙ্গাপুরে নিজের কার্যালয় সরিয়ে নিচ্ছে। স্থিতিশীলতা, বাণিজ্যবান্ধব ও কর হার কম হওয়ায় সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ বেসরকারি সম্পদ ও পুঁজি হংকং থেকে সিঙ্গাপুরে স্থানান্তরিত হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের সমস্যা হলো রাষ্ট্রটির ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো সম্প্রতি যে পরিমাণ সাফল্য দেখিয়েছে সেটির তুলনায় শেয়ারবাজারের সাফল্য কম। দেশটির শেয়ারবাজারে (এসজিএক্স) রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বেশি হওয়ায় কিছু সমস্যা হচ্ছে।
তবে কিছু সংস্কার আনা হলে তা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুর ভেন্সার ও প্রাইভেট ক্যাপিটাল অ্যাসোসিয়েশন এরই মধ্যে কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে শেয়ারবাজারটিকে ঘিরে বিরাজমান শঙ্কাগুলো কেটে যাবে।
ক্ষয়িষ্ণু হংকং
বিশ্বের শীর্ষ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে হংকংয়ের অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটির শেয়ারবাজারের অস্থিরতা ও প্রবৃদ্ধি হ্রাসের পাশাপাশি আরও কিছু সমস্যা আর্থিক কেন্দ্রটিকে ভোগাচ্ছে। একদিকে শহরটিতে চীনের হস্তক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। এসব কিছুর কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজার ছেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরাও শহরটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। চীনের আবাসন ও প্রযুক্তির খাতের অস্থিরতা হংকংয়ের সমস্যাকে আরও বাড়িয়েছে। হংকং শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ছিল গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তবে নিজেদের শেয়ারবাজারকে চাঙা করার জন্য ২০২৩ সালের আগস্টে হংকং সরকার একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠা করেছে টাস্ক ফোর্স অন এনহেন্সিং স্টক মার্কেট লিকুইডিটি। এটা বাজারটিকে নানাভাবে ঢেলে সাজাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু ইআইইউ মনে করে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে টিকে থাকলেও আগামীতে বাজারটির গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।