শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:২১ অপরাহ্ন

ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে আয় তিন লাখ, পড়ছেন জার্মানিতে

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

সাব্বির হোসাইন। সুনামগঞ্জের নারায়ণপুরে জন্ম। জীবনসংগ্রামের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ছোটবেলাতেই। ২০১৯ সালের আগপর্যন্ত এই সংগ্রামের সঙ্গেই জীবন জড়িয়ে গিয়েছিল। পকেটে একটা টাকাও নেই—বন্ধুর সঙ্গে রাস্তায় হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। মাঝেমধ্যে কোনোভাবে পকেটে খুচরো কিছু টাকা চলে এলেও তা নিয়ে উল্টোপাল্টা খরচ করতেন না সাব্বির। সেই টাকায় মুঠোফোনে নেট কিনে টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখতেন। সেই সময়েই বাস্তবতা তাঁকে শিখিয়েছিল—পকেটশূন্য মানুষের কাছে পৃথিবী বড় ধূসর। আর এখন নিজে ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করেন। সেই টাকায় পড়তে গেছেন জার্মানিতে।

২০১৮ সালে ইন্টারনেটের সেবা এমন সহজলভ্য ছিল না। ঘরে ঘরে ইন্টারনেট, ওয়াই–ফাই দুর্লভ ছিল। ইন্টারনেট চালানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম ছিল মুঠোফোনে এমবি কেনা। কিন্তু শুধু এমবি কিনলেই তো হতো না। ইন্টারনেট–সংযোগ ছিল না। থাকলেও সমানভাবে নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত না সব জায়গায়। ঠিকভাবে ইন্টারনেট পেতে অনেক সময় মুঠোফোন জানালার সামনে রেখে দিতে হতো। তবু লেগে ছিলেন সাব্বির। হাতে টাকা এলেই মুঠোফোনে এমবি কিনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের টিউটোরিয়াল দেখার সেই নেশাই আজ তাঁর দারিদ্র্য দূর করেছে, তাঁকে সফলতা দিয়েছে।

মাঝেমধ্যে জীবনের এমন সব বাঁকে সাব্বির নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন, মনে হয়েছিল, সব শেষ বুঝি। যেমন ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষার পর আর্থিকভাবে প্রচণ্ড দুরবস্থার মধ্যে পড়ে তাঁর পরিবার। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সাব্বিরকেই জীবনসংগ্রামে নেমে যেতে হয়। নিরুপায় হয়ে সুনামগঞ্জ শহরে টুকটাক টিউশনির পাশাপাশি সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটা খণ্ডকালীন প্রকল্পে ঢুকে পড়েন তিনি।

ডেটা এন্ট্রির প্রজেক্টে কাজ। কাজটি করার সুযোগ এসেছিল এক মামার হাত ধরে, ২০১৮ সালের শুরুর দিকে। সাব্বিরের কাছে কাজ করার জন্য কোনো যন্ত্রও ছিল না সে সময়। সেই মামা তাঁকে একটি ল্যাপটপ জোগাড় করে দেন। সেটি দিয়ে কয়েক মাস জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কাজ চালিয়ে যান তিনি।

এ প্রকল্পে কাজ করার সময় ইমন নামের এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় সাব্বিরের। ইমনের কাছ থেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রথম ধারণাটা পান সাব্বির। যদিও প্রথমবার তাঁর বলা অনেক কথাই বুঝতে পারেননি সাব্বির, তবে তিনি টের পেয়েছিলেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মধ্যে তাঁর একটা আলাদা আগ্রহ কাজ করে। তাই ইমনের প্রতিটি কথা খাতায় নোট করে রাখতেন। তাঁর মাধ্যমেই গ্রাফিকস ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় সাব্বিরের।

ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে সাব্বিরের আগ্রহ ধীরে ধীরে আরও বাড়তে থাকে। বলা যায়, অন্তরে লুক্কায়িত বীজ মহিরুহ হয়ে ওঠে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানা সেমিনার ও ওয়ার্কশপে যেতে শুরু করেন তিনি। সেই সঙ্গে ফ্রিল্যান্সিং-সম্পর্কিত প্রচুর ভিডিও দেখতে থাকেন। ধীরে ধীরে আস্থা পান, অনলাইনে কাজ করে আয় করার বিষয়টা মোটেও মিথ্যা নয়। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তখন থেকেই।

নিজের বাসা পাকা করেন যখন
নিজের বাসা পাকা করেন যখনছবি : সংগৃহীত

শুরুর দিকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয় সাব্বিরকে। প্রথমত, ওয়ার্কশপ ও সেমিনারগুলোতে অংশ নিয়ে তিনি বুঝে যান, তাঁকে দিয়ে গ্রাফিক ডিজাইনের মতো কাজ হবে না। তবে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পোকা তত দিনে পেয়ে বসে তাঁকে। কিছু একটা শেখার তাগিদ থেকেই বন্ধু পাভেল, সোহাগসহ কয়েকজনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ধার করেন। তারপর ভর্তি হন একটা অনলাইন কোচিংয়ে; কিন্তু কাজে লাগানোর মতো কিছু শিখতে পারেন না সেখান থেকে। বলা যায়, প্রথম লগ্নিকৃত সেই ১০ হাজার টাকা একদম জলে চলে গিয়েছিল।

তবে এসবে কখনো কখনো মনোবল হারালেও ধৈর্য হারাননি সাব্বির। আঠার মতো লেগে রইলেন ফ্রিল্যান্সিংয়ে। এই জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি কখনো। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফল পেতে শুরু করলেন ধীরে ধীরে। প্রথমে ছোটখাটো কিছু প্রকল্পে কাজ করে টাকাপয়সার মুখ দেখা শুরু করেন। মামার দেওয়া সেই ল্যাপটপ দিয়েই টুকটাক কাজ করতে থাকেন। প্রথমে ভেবেছিলেন, এই ল্যাপটপেই তাঁর ভাগ্য ঘুরে যাবে; কিন্তু পরিস্থিতি দেখা গেল ঠিক তার উল্টো। সবে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জগতে প্রবেশ—ছোটখাটো প্রজেক্টে যা আসছে, তা ইন্টারনেটের জন্য এমবি কিনতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। ল্যাপটপ হাতে পাওয়ায় একদিকে সবার আকাশকুসুম প্রত্যাশা, অন্যদিকে সংসার বেহাল। অসুস্থ বাবার কৃষিজমির ওপর নির্ভর করে সংসার চলে। সবাই চাইছিল পরিবারের বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে সাব্বির যেন দ্রুত সংসারের হাল ধরেন।

শুরু হলো নতুন পথচলা

২০১৯ সালের দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের খণ্ডকালীন প্রকল্পটি শেষ হয়ে যায়। ফলে নারায়ণপুর অর্থাৎ বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে আসার আগে মামার ল্যাপটপটি রেখে আসতে হয়। ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ল্যাপটপটি জরুরি ছিল। ফলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে পথচলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল সাব্বিরের। সব মিলিয়ে আশা হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন যেন।

ওই আশাটুকুর জন্যই হয়তো সে সময় সাব্বিরের জীবনে ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে আসেন তাঁর খালা। তাঁর অদম্য ইচ্ছা ও পরিশ্রম খালা-খালুর চোখে পড়েছিল। তাঁরা যখন ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি সাব্বিরের তুমুল আগ্রহ এবং অল্পস্বল্প টাকাপয়সা আয়ের চিত্র দেখতে পেলেন, তখন তাঁকে একটি ল্যাপটপ কিনে দিলেন উপহার হিসেবে। এই ল্যাপটপ সাব্বিরের জীবনে একটা ‘লাইফলাইন’ হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ সম্ভাব্য বন্ধ হওয়া ফ্রিল্যান্সিংয়ের সম্ভাবনা জেগে ওঠে আবার।

জার্মানিতে কয়েকজনের সঙ্গে সাব্বির
জার্মানিতে কয়েকজনের সঙ্গে সাব্বিরছবি : সংগৃহীত

অনেকেই সাব্বিরকে এসবের পেছনে বৃথা সময় নষ্ট করতে নিষেধ করেছিলেন। উৎসাহ না দিয়ে বরং বারবার নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন অনেকে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনলাইনের দুনিয়ায় নিজেকে গুছিয়ে আনতে সক্ষম হন সাব্বির।

অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইটে ফাইভআরে নিজের প্রোফাইল গুছিয়ে পোস্ট করে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করার পর ইংল্যান্ডের এক গ্রাহকের কাজ পান সাব্বির। সেই কাজটা খুব সুন্দরভাবে করে দেওয়ার পর একই গ্রাহক আরও কিছু কাজ দেন তাঁকে। ওই গ্রাহকের কয়েকটা কাজই ফাইভআরে সাব্বিরের ক্যারিয়ার দাঁড় করিয়ে দেয়।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে কাজ করতে গিয়ে সাব্বিরের পরিচয় হয় সাইফ, শামীম হুসাইনের মতো কিছু অসাধারণ ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে। মূলত এই খাতে সাব্বিরের পেশাদার যাত্রা শুরু হয় শামীম হুসাইনের হাত ধরে। তারপর থেকে সাব্বিরকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

যাত্রাটা এত সহজ ছিল না

সমাজ আর পারিবারিক পরিস্থিতির মধে৵ ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার এই যাত্রা ছিল নানা বাধাবিপত্তি দিয়ে ভরা। ইন্টারনেট ছিল না, যন্ত্র ছিল না, কাছের মানুষদের অনেকে সমর্থন দেয়নি—তবু অধ্যবসায় দিয়ে সব বাধা ডিঙিয়ে জীবনে জয়ী হয়েছেন। জীবনের প্রথম আয়ের ১০ হাজার টাকা যেদিন বাবার হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন সাব্বির, সেদিনই অনুভব করেছিলেন জীবনযুদ্ধে জয়ের স্বাদ।

আজ ফ্রিল্যান্সিং করে জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে সাব্বিরের। খুচরো টাকা জমিয়ে এমবি কেনা সাব্বির আজ মাসে প্রায় আড়াই হাজার পাউন্ডের ওপরে আয় করেন, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় তিন লাখ টাকা। এই ফ্রিল্যান্সিংয়ের টাকাতেই উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে যেতে পেরেছিলেন সাব্বির। গ্লোবাল বিজনেস অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিষয়ের ওপর মাস্টার্স করছেন সেখানে।

সাব্বির বলেন, ‘আমি আমার স্বপ্নকে সত্যিতে পরিণত করতে পেরেছি। আমার বর্তমান লক্ষ্য একটা বড় ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানি গঠন করে আমার মতো আরও এক হাজার স্বপ্নবাজ তরুণকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া। বিদেশে থিতু হওয়ার সামান্য ইচ্ছা থাকলেও দেশের জন্য, দেশের তরুণদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে স্বপ্ন দেখা থামানো যাবে না। কারণ, আমি জানি, স্বপ্ন পূরণের চেয়ে মধুর অনুভূতি আর কোনো কিছুতেই নেই!’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com