শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১১ পূর্বাহ্ন

প্রাণ ফিরছে সুন্দরবনে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০২৪

টানা বৃষ্টিতে সবুজে ছেয়েছে ম্যানগ্রোভ

ঘূর্ণিঝড় রিমালের ধ্বংসলীলা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে সুন্দরবন। কয়েক সপ্তাহে টানা বৃষ্টিতে সবুজে ছেয়েছে ম্যানগ্রোভ (শ্বাসমূলীয়) বনভূমি। লোনাপানি সেচে ফেলা পুকুরগুলোতে ৩-৪ ফুট বৃষ্টির পানি জমেছে। সেখানে বাঘ, হরিণসহ অন্য প্রাণীরা পানি পান করছে। গরমে শুষ্ক আবহাওয়ায় বনে বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় দাস পোকার (বড় আকারে মাছি) উৎপাত বেড়েছিল। বন্যপ্রাণীকে কামড় দিলে রক্তঝরা বন্ধ হতো না। বৃষ্টিতে সেই পোকামাকড়ের উৎপাতও কমেছে। সবুজে সবুজে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে সুন্দরবন। বনকর্মকর্তারা বলছেন, বনের পরিবর্তনটা এখনই চোখে পড়ছে।

দুয়েক মাসের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি পুষিয়ে স্বাভাবিকতায় ফিরবে বনভূমি। বন্যপ্রাণীর জন্য টানা বৃষ্টিটা প্রয়োজন ছিল। পশ্চিম সুন্দরবন বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, রিমেলে ৩৬-৪০ ঘণ্টা সুন্দরবন পানিতে তলিয়ে ছিল। অসংখ্য বন্যপ্রাণী অতিরিক্ত লোনাপানি খেয়ে মারা গেছে। বৃষ্টিতে গরম কমে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর মাঝেও স্বস্তি ফিরেছে।

ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায় রূপ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। ভোরের আলোতে এক রূপ, দুপুরে নিস্তব্ধতা, পড়  বিকালে ভিন্ন রূপ, মধ্য গভীর রাতে আরেক রূপ। চাঁদনী রাতে নৈসর্গিক রূপ। পানিতে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ, সবুজের হাতছানি- রোমাঞ্চের ঢেউ তোলে প্রতি মুহূর্তে। এ বনে রয়েছে সাড়ে ৪০০ নদী-খাল। সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, গরান গোলপাতাসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, মায়া হরিণ, লোনাপানির কুমির, অজগর, কচ্ছপ, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ৩০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এই বনে আছে সর্বাধিক নয় প্রজাতির মাছরাঙা। হাঁসপাখি, শকুন, পলাশীকুড়া ঈগল, প্যারাবন সুনচা, চামচ ঠুটোরও বসবাস সুন্দরবনে।

ফিরছে  ১০০ বছর আগের চেহারায়

বনের আয়তন টিকিয়ে রাখতে নতুন বন সৃজনের উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। ১০০ বছর আগের চেহারাটা ফিরিয়ে আনা হবে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটে ১৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদীতীরে সুন্দরবনের আদলে গোলপাতা, গেওয়া, কেওড়ার বন সৃজন করা হবে। ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। বন গবেষকরা বলছেন, ১৯০৪-২৪ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ২০২১ সালে কমে হয় ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে আরও কমে হয়েছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, একসময় বাগেরহাটের বলেশ্বর নদ, বগী নদী থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে কালিন্দি নদী পর্যন্ত ৫২টি নদী-খালের পাশে ম্যানগ্রোভ বন ছিল। ওইসব নদী-খাল ভরাট ও বনভূমি বিলীন হয়ে গেছে। এখন সুন্দরবন থেকে ওপরের দিকে ৩ কিলোমিটার এলাকায় বনায়ন করা হবে। ১৩০ কিলোমিটার জায়গায় বন ও খাল তৈরি করা হবে।

বন্যপ্রাণীদের রোগ নির্ণয়ে গবেষণা

সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর রোগ নির্ণয়ে প্রথমবারের মতো চলছে গবেষণা। নির্ণয় করা হবে বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর ও সজারুর রোগ। জানা গেছে, সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় বাঘসহ পাঁচটি বন্যপ্রাণীর রোগ নির্ণয়ে পাঁচ সদস্যের গবেষক দল কাজ করছে। বনের ৬৫টি গবেষণা প্লট থেকে তারা নমুনা হিসেবে এসব প্রাণীর মল, পশম, হাড়, মৃত প্রাণীর রক্ত সংগ্রহ করেন। গবেষণা প্লট থেকে ২৫০টির মতো নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এখন সিলেট, ময়মনসিংহ ও গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ল্যাবে এ নমুনাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। বনবিভাগ জানায়, বনের কাছাকাছি লোকালয়ের কুকুর ও বিড়ালের রক্ত নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হবে। বন্যপ্রাণীর যে ধরনের সংক্রমণ হচ্ছে, লোকালয়ে প্রাণীরও একই ধরনের সংক্রমণ হচ্ছে কি না, গবেষকরা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।

নিষিদ্ধ সময়ে বনে বনজীবীরা

১ জুন-৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও বনজীবীদের বনে প্রবেশ বন্ধ করা যায়নি। প্রতিনিয়ত বনে ঢুকে তারা মাছ ও কাঁকড়া শিকার করছে। বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে সহায়তা না দেওয়ায় জীবিকার তাগিদে তারা বনে ঢুকছে বলে জানা গেছে। বন কর্মকর্তারা জানান, প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার বনজীবীর একটি তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে নিষিদ্ধকালীন বিকল্প কোনো কাজ না পেয়ে বনজীবীরা ঝুঁকি নিয়েই বনে প্রবেশ করছে। এতে এক মাসে আটক ও মালামাল জব্দের ঘটনা বেড়েছে। এসব আটকের ঘটনায় বন কর্মকর্তা ও বনজীবীদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

পর্যটক ও রাজস্ব  বাড়ছে

সুন্দরবনের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুন্দরবনের পশ্চিম ও পূর্ব বিভাগে ২ লাখ ১৬ হাজার ১৪৩ জন পর্যটক ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক ছিলেন ২ হাজার ১৪৩ জন। রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ ৩২ হাজার ৪৮০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৭৭ জন পর্যটক ভ্রমণ করেন। বিদেশির সংখ্যা ১ হাজার ১০৩ জন। রাজস্ব আদায় হয় ২ কোটি ২৪ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮০ টাকা। বর্তমানে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মে মাসে ভ্রমণ করেছেন ৫০৮ জন। রাজস্ব আয় হয়েছে ৪ লাখ ৪১ হাজার ২৪০ টাকা। ছোট বড় প্রায় ৫০টি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনে পর্যটক ভ্রমণ কাজে নিয়োজিত আছে। তবে অভিজ্ঞ ট্যুর অপারেটর ৬-৭টি।

বর্জ্য দূষণের কবলে

সুন্দরবন উপকূলীয় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলা ও উপজেলা শহর এবং মোংলা বন্দর থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টন কঠিন ও তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজ ও বনের মধ্যে দিয়ে নৌযানের যাতায়াতে তেল-মবিলসহ বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে। এসব বর্জ্য জোয়ার ভাটার টানে সুন্দরবনে আটকা পড়ে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে সুন্দরবনে ইকো সিস্টেম ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বর্জ্যরে মাধ্যমে সুন্দরবন কী পরিমাণ দূষণের শিকার হচ্ছে তার পরীক্ষা বা গবেষণার ব্যবস্থা নেই।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com