বেশ কয়েক বছর আগে চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ শহর পরিদর্শন করার এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতার কথা খুব সংক্ষেপে নিবেদন করছি এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে। আমার ইতালিয়ান বন্ধু ফেদেরিকো কাক্কাভালে ও আমি – এই দু’জনে মিলে প্রাগে এসেছিলাম একটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগদান করতে। ফেদেরিকো এখন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ এ থাকে। ওর সাথে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত একটানা তিন বছর কাজ করেছি ইতালির বিখ্যাত পাদোভা ইউনিভার্সিটিতে। ফেদেরিকো ভেনিসে থাকতো এবং অসম্ভব ভালো গাড়ি চালাতো। পাদোভার একেবারে পাশেই ভেনিস শহর, যার ফলে আমিও পাদোভা থেকে ভেনিসে চলে যেতাম প্রায় বেশিরভাগ সপ্তাহান্তে।
ভেনিস থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম দু’জনে মিলে। ফেদেরিকো নিজেই ড্রাইভ করছিলো। ইতালির উত্তরের প্রান্তিক শহর বোলজানো (Bolzano) ছাড়িয়ে আমরা অষ্ট্রিয়ায় প্রবেশ করলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আল্পস পর্বতমালা ভেদ করে এক বিশাল টানেল অতিক্রম করে অবশেষে প্রাগ শহরে এসে পোঁছালাম। কি অসাধারণ সুন্দর শহর প্রাগ! এত অপরূপ শৈলী ইউরোপের আর কোন শহরে আছে কি না জানি না। অবশ্য আমার মনে হয় ইউরোপের প্রতিটি দেশই অপরিসীম সৌন্দর্যের! সৌন্দর্যের বিচারে ইতালির ফ্লোরেন্স, ফ্রান্সের প্যারিস, হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ, জার্মানির কোলন, অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা, প্রতিটিই শররই অসম্ভব সুন্দর! তবে আমার দৃষ্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনের সৌন্দর্যের জুড়ি মেলা ভার!
প্রাগ ক্যাসল এককথায় অসাধারণ!! পৃথিবীর প্রাচীনতম দুর্গগুলির মধ্যে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে বড়। প্রায় ৭০,০০০ বর্গ মিটার জায়গা জুড়ে এর অবিশ্বাস্য বিস্তৃতি। সমগ্র দুর্গটি পাথর দিয়ে বাঁধানো। সন্ধ্যের পর আলোকমালায় সুসজ্জিত হয়ে এই দুর্গ যেন এক মোহময়ী রূপ ধারণ করে! আমি বিস্ফারিত নেত্রে অবলোকন করেছি এই দুর্গটির অভাবনীয় সৌন্দর্য। অনেকক্ষণ বিচরণ করেছি এই দুর্গের মধ্যে। পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে অশ্বারোহী সুদৃশ্য পুলিশদের গট গট করতে করতে চলে যাওয়ায় কেমন যেন রোমাঞ্চকর লেগেছিল! প্রাগ শহরের রেস্টুরেন্টগুলো সম্পর্কে না বললেই নয়। রেস্তোরাঁগুলো যেন জীবন্ত! কি অসাধারণ প্রাণচাঞ্চল্য এখানে! রাত যত বাড়তে থাকে তত যেন প্রাণশক্তিতে ভরপুর হয়ে ওঠে এই রেস্তোরাঁগুলো। এখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে marinated sirloin এবং গোলাশ এর স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। গোলাশ অনেকটা আমাদের মাটন কষার মত দেখতে, কিন্তু স্বাদ বা গন্ধ একেবারেই আলাদা। ছোট ছোট মাংসের টুকরো পেঁয়াজ, টমেটো ও রেড ওয়াইন সহযোগে রান্না করা হয়। ঘন গ্রেভিতে আচ্ছাদিত অসম্ভব মোলায়েম ও সুস্বাদু এই গোলাশ, যা নরম রুটি দিয়ে খেতে অসাধারণ লাগে। অবশ্য আমার কাছে হাঙ্গেরিয়ান গোলাশ আর একটু বেশি সুস্বাদু লেগেছে তুলনামূলক ভাবে। প্রাগের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় চেকোস্লোভাকিয়া-খ্যাত Budeweiser বিয়ার প্রাণভরে পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছি। এই একই নামের বিয়ার আমেরিকাতেও দেখেছি কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়া বিয়ারটি বেশী ভাল মনে হয়েছে।
প্রাগে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়া। সেমিনারের বিষয় ছিল Radiation Effects on Insulators এবং আমি Ion-beam induced optical modifications of glasses এর উপরে একটি আমন্ত্রিত বক্তৃতা দিয়েছিলাম। চেক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স আয়োজিত এই সেমিনারে বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। সেসব কথা সত্যিই ভুলবার নয়!