শীতে কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানে বেড়ানোর জন্য অনেকে ছুটে আসেন দূর পাহাড়ে। আর শীত মৌসুমই হলো পাহাড়-অরণ্যের জেলা বান্দরবানের দুর্গমাঞ্চলগুলোর দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। শুধু শীত এবং বর্ষা নয় সারা বছরই বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি জেলা বান্দরবান। প্রকৃতি নিজেকে এ জেলায় মেলে ধরেছে আপন সাঁজে। বান্দরবানে বেড়াতে এসে কখনো মন খারাপ করে বাড়ি ফেরেনা পর্যটকেরা। চিরসবুজের ছোয়া যারা পেতে চান, তাদের যেতে হবে পাহাড়ি জনপদের পাহাড়ের আনাচে-কানাচে।
যা দেখতে পাবেন
বান্দরবানে বেড়াতে এলে হাতে অন্তত তিন-চারদিন সময় নিয়ে আসবেন। তা না হলে ভ্রমণ অপূর্ণ রাখার যন্ত্রণা নিয়েই কিন্তু ফিরতে হবে। এখানে রয়েছে ভিন্ন ভাষার এগারোটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি-জীবনধারার মানুষ এবং বাঙালি সম্প্রদায় মিলে প্রায় চার লাখ মানুষের বসবাস এ জেলায়। ১৯৮১ সালের ১৮ এপ্রিল বান্দরবান ও লামা দুটি মহকুমার সমন্বয়ে বান্দরবানকে একটি স্বতন্ত্র জেলা ঘোষণা করা হয়। বান্দরবান নামকরণের পেছনে রয়েছে একটি কাহিনীও। প্রবীণদের মুখে শোনা যায় অতীতে বর্তমান জেলা সদরে অসংখ্য বানরে ভরপুর ছিল। বানরগুলো শহরে অবস্থিত খালের ওপর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে পাশের জঙ্গলে ফলমূল খেতে যেত এবং সন্ধ্যায় আবারও ফিরে আসত। মেসকি সেতুর ওপর দিয়ে বানরের যাওয়া আসার অবাধ বিচরণের দৃশ্যটিকে এই অঞ্চলের মারমা সম্প্রদায়েরা তাদের ভাষায় ‘ম্যাগসি’ বলত। বাংলায় ম্যাগ অর্থ-বান্দর (বানর) এবং সি অর্থ-বাঁধ (বান)। পরবর্তী সময়ে কালের বির্বতনে বানরের বসবাসকৃত এ স্থানটির নামকরণ করা হয় বান্দরবান।
কী নেই এ জেলায়? নীলাচল পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যাস্ত দেখা, নীলগিরি থেকে পাহাড়ের সমুদ্র দেখা, পাহাড়ের চূড়ায় প্রাকৃতিক বগালেক, পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝড়েপড়া রিজুক ঝর্ণা, জাদিপাই ঝর্ণা, চিংড়ি ঝর্ণা, শৈল প্রপাত ঝর্ণা, বাদুরগুহা, আলীর সুরঙ্গপথ, মেঘলায় লেকের ওপরে আকর্ষণীয় দুটি ঝুলন্ত সেতু, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থান নামে পরিচিত স্বর্ণমন্দির, রামজাদী মন্দির, রেমাক্রী বড়পাথর, দেবতাপাহাড়, নাফাকুম জলপ্রপাত, ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোলা চা বাগান, দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সাকাহাফং, তাজিংডং বিজয়, কেওক্রাডং চূড়া এবং ভিন্ন ভাষার ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি বান্দরবানের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে আরো বহুগুণে।
নীলাচল
হাতছানি দিয়ে ডাকছে পর্যটকদের নীলাচল পর্যটন স্পট। জেলা শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুহাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় নীলাচল অবস্থিত। স্পটটি স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। গাড়ি এবং পায়ে হেঁটেও সহজে নীলাচলে যাওয়া যায়। তবে শুধু নীলাচলে যাওয়ার জন্য আলাদা কোনো সার্ভিসের ব্যবস্থা নেই। ভাড়াগাড়ি রিজার্ভ করে কিংবা নিজস্ব গাড়িতে করে এই স্পটে যেতে হয়। পর্যটকের সুবিধার জন্য নীলাচলে নির্মাণ করা হয়েছে আকর্ষণীয় কাচের টাওয়ার, দৃষ্টি নন্দন সিঁড়ি, গোলঘর এবং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। রাত্রিযাপনের জন্য তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় কয়েকটি কটেজও।
পর্যটকদের নজর কাড়তে সক্ষম নীলাচল পর্যটন স্পটে গিয়ে যেকোনো মানুষ মুগ্ধ হতে বাধ্য। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের বিপরীতে এখানে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ি সমুদ্রের। যেদিকে চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের এই সমুদ্র প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনকে হার মানাতে বাধ্য। নীলাচল হতে খোলা চোখে অনায়াসে দেখা যায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী। রাতের বেলা এখান থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে অবস্থানরত জাহাজগুলোকে মনে হয় একেকটি গ্রহ-নক্ষত্র। ভূমি থেকে আকাশের তারাকে যে রূপে দেখা যায় কর্ণফুলীতে অবস্থানরত জাহাজগুলোও রাতের বেলা নীলাচল থেকে তেমনি মনে হয়। দিন আর রাতের এই বৈশিষ্ট্যের জন্য নীলাচল পর্যটকদের কাছে আরো বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যায় নীলাচল থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অনায়াসে দেখা যায়। তবে নীলাচল পর্যটন স্পটে দিনের চেয়েও রাতের চাঁদের আলোয় সময় কাটানো যায় অতি রোমাঞ্চের মধ্য দিয়ে।
সেনা নিয়ন্ত্রিত নীলগিরি
নীলগিরি পর্যটকদের কাছে স্বপ্নীল একটি নাম। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন কার না জাগে, মেঘে গা ভাসানোর ইচ্ছে কার না করে। সব স্বপ্ন ও ইচ্ছে কখনো পূরণ হয় না কথাটি সত্যি। তবে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও মেঘে গাঁ ভাসানো সম্ভব বান্দরবানে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত নীলগিরি পর্যটন স্পটে হাত বাড়ালেই মেঘ ছোঁয়া যায়। অনেকটা মেঘের দেশে ভেসে বেড়ানোর মতো। বান্দরবানে অসংখ্য পর্যটনস্পটের মধ্যে অন্যতম এটি। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়কের ৪৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয় নীলগিরি পৌঁছাতে। বাংলার দার্জিলিং খ্যাত চিম্বুক পাহাড় থেকে থানচি উপজেলা সড়কে আরো ২৬ কিলোমিটার। পর্যটন স্পট নীলগিরিতে মেঘ আর রোদের মধ্যে চলে লুকোচুরি খেলা। কখন এসে মেঘ আপনাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে বুঝার অবকাশ নেই।
ঘন মেঘের চাদরে হারিয়ে যেতে নীলগিরি হচ্ছে উপযুক্ত স্থান। নীলগিরি পর্যটন স্পটে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থাও আছে। সেনা নিয়ন্ত্রিত নীলগিরিতে গড়ে তোলা কটেজগুলোও দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। আকাশনীলা, মেঘদূত এবং নীলাতানাসহ বিভিন্ন নামে সাজানো কটেজগুলোর ভাড়াও খুব বেশি নয়। শুধু থাকা নয়, খাওয়া-দাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে নীলগিরিতে। মনে হয় থাইল্যান্ডের কোনো শহরে অবস্থান করছি। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দুচোখ যেদিকে যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এ যেন অন্যরকম অনুভূতি। মেঘ ছুঁয়ে দেখতে চান। তবে এখনি ছুটে আসুন বান্দরবানে। স্বপ্নীল নীলগিরি পর্যটন স্পট দেখে যেতে ভুলবেন না।
মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স
অনেক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ একটি নাম মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। এখানে বিশাল লেকের ওপর আকর্ষণীয় দুটি ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। ঝুলন্ত সেতু মানেই ঝুলন্ত সেতু। যা দেশে বিরল ঘটনা। দেশের কোথাও এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিত্ত বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে ক্যাবল কার, ট্যুরিস্ট ট্রেইন, শিশুপার্ক, সাফারি পার্ক, চিড়িয়াখানা, স্পিডবোটে ভ্রমণের সুবিধা এবং রাত্রি যাপনের জন্য রেস্ট হাউজ। এ ছাড়া কমপ্লেক্সে ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোলা চা বাগান মেঘলা পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণে। পর্যটকদের সুবিধার্থে মেঘলা পর্যটন স্পটে নিচে নামতে রাস্তার পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় সিঁড়িও। মেঘলা পর্যটন স্পটের চতুর পাশে রয়েছে ছোট ছোট গোলঘর এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও। সব মিলিয়ে মেঘলা পর্যটন স্পটটি অপূর্ব। এক টিকেটে এত কিছু দেখার সুযোগ আর কোথাও নেই একমাত্র মেঘলা ছাড়া।
শৈল প্রপাত ঝর্ণা
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সৃষ্টি শৈল প্রপাত। বান্দরবান-রুমা এবং থানছি সড়কের ৫ মাইল নামকস্থানে প্রাকৃতিক এই ঝর্ণার অবস্থান। শহর থেকে শৈল প্রপাতে যেতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। শৈল প্রপাত ঝর্ণার হিমশীতল পানি সর্বদা বহমান। মনমাতানু এ দৃশ্য স্মৃতিতে ধরে রাখার মতো। রাস্থার পাশে শৈল প্রপাতের অবস্থান হওয়ায় এখানে দেশি বিদেশি পর্যটকদের ভিড় বেশি দেখা যায়। এখানে পর্যটকদের জন্য স্থানীয় পাহাড়ি বম জনগোষ্ঠী কোমর তাঁতে বুনা কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে। এ ছাড়া বান্দরবানে উৎপাদিত মৌসুমি ফলমূল সবসময় পাওয়া যায় এখানে। শহর থেকে চাঁদের গাড়ি এবং সিএনজি ভাড়া নিয়েও শৈল প্রপাতে যাওয়া যায়। অনেকে হেঁটেও শৈল প্রপাতে চলে যায়। শহরের অদূরে শৈলপ্রপাতের স্বচ্ছ পানি বয়ে চলছে অবিরাম ধারায়।
বৌদ্ধধাতু স্বর্ণজাদী মন্দির
প্রায় ১৬০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন বৌদ্ধ ধাতু স্বর্ণ জাদী। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি তীর্থ স্থান হলেও পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। বান্দরবানে বসবাসরত ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ ১৪টি সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছেও বৌদ্ধ ধাতু স্বর্ণ জাদী পবিত্র স্থান। এটি সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। যতই কাছে যায় ততই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পাহাড়ের চূড়ায় এত সুন্দর বৌদ্ধ ধাতু স্বর্ণ জাদী নিয়ে নানা রহস্য সৃষ্টি হয় মনে। দূর থেকে দেখলেই মনে হয় কাছে যায়। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে পর্যটকদের স্বর্ণ মন্দির। জেলা শহরের মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে বালাঘাটা এলাকায় গড়ে উঠেছে বুদ্ধ ধাতু জাদি (স্বর্ণ জাদী)। যাকে সংক্ষেপে লোকজন জাদি বা স্বর্ণ মন্দির বলেই সম্বোধন করে। এটিকে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ জাদি বলা হয়। এর নির্মাণশৈলী, কারুকার্য, স্বর্ণখচিত অবকাঠামো যে কারোই মন কাড়ে।
লাখ লাখ ধর্মীয় নারী-পুরুষের কাছে এটি যেমন পবিত্র স্থান, তেমনি এটি পর্যটকদের কাছেও অত্যন্ত দর্শনীয় স্পট হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ধর্মানুরাগী ও পর্যটকদের ১২৩টি সিড়ি বেঁয়ে উঠতে হয় বৌদ্ধ জাদীতে। মিয়ানমার, শ্রীলংকাসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে আনা শ্রমিক এবং শিল্পীরা নির্মাণ করেছে এই বৌদ্ধ ধাতু স্বর্ণ জাদি। এটি নির্মাণে সময় লেগেছে প্রায় এক বছর। জাদিতে রয়েছে ছোট, বড় প্রায় শতাধিক বৌদ্ধ মূর্তি। এসব মূর্তির কিছু স্থানীয়ভাবে নির্মাণ করা হলেও বেশির ভাগ মূর্তি আনা হয়েছে শ্রীলংকা, চীন, মিয়ানমার, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। বৌদ্ধ জাদি এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে একটি ছোট পুকুর। পুকুরের মাঝখানে ধ্যানরত বৌদ্ধমূর্তি সদৃস পাথুরে প্রাকৃতিক মূর্তি, উচ্চতর পর্বতের ডগায় পরীর দীঘি দেবতার পুকুর বলেও খ্যাতি অর্জন করেছে। দেবতার এই পুকুরের পানি পান করলে নানা রোগ বালাই দূর হয় এমন বিশ্বাস স্থানীয় বৌদ্ধ, হিন্দু ধর্মানুরাগীদের। স্বর্ণ জাদি দর্শনে আসা লোকজন বোতল বা পাত্রে করে নিয়ে যায় দেবতার পুকুরের পানি। প্রতি বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বৌদ্ধ ধাতু জাদী এলাকায় বসে মেলা। সপ্তাহ এবং মাসব্যাপী চলে এই বৌদ্ধ ধাতু জাদী মেলা।
চিম্বুক বাংলার দার্জিলিং
চিম্বুক পাহাড়ের পরিচিতি সারাদেশে। ইদানীং বাংলার দার্জিলিং খ্যাত চিম্বুকের পরিচিতি প্রসারিত হয়েছে বিদেশেও। শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় তিন হাজার ২০০ ফুট। চিম্বুক পাহাড়কে ঘিরেই পাহাড়ি মুরুং (ম্রো) জনগোষ্ঠীর বসবাস। জেলায় সবকটি উপজেলার সাথে টেলিযোগাযোগের ব্যবস্থা রক্ষার জন্য চিম্বুকে বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড একটি বেইজ স্টেশন ও টাওয়ার স্থাপন করেছে। পর্যটকদের দৃষ্টিতে এ টাওয়ার খুবই আকর্ষণীয়।
চিম্বুকের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়। এখান থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত দেখা যায়। শীত ও বর্ষায় চিম্বুক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মেঘ স্পর্শ করা যায়। মুহূর্তের মধ্যে মেঘের পাল্টে যাওয়া সাদা-কালো-রঙিন খেলার দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ইচ্ছে করলে মেঘে গা ভাসিয়ে দিয়ে হারিয়ে যাওয়া যায়। দেখবেন মুহূর্তেই মেঘ এসে আপনার গাঁ ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। চিম্বুককে বাংলার দার্জিলিং বলে অনেকে। চিম্বুক পাহাড়ের দুই পাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। দুচোখ যেদিকে যায় শুধু পাহাড়ের সমুদ্র। বাংলার দার্জিলিং খ্যাত চিম্বুকে যাওয়ার পথে দৃশ্যগুলো খুবই চমৎকার। যাওয়ার পথের দৃশ্যগুলো উপভোগ না করলে চিম্বুকে দেখার কিছু নেই। যাত্রা পথের দৃশ্যগুলোই মূলত বেশি আকর্ষণীয়।
প্রাকৃতিক জলাশয় বগালেক
নীল জলের প্রাকৃতিক জলাশয় কিংবদন্তি বগালেক। লেক সৃষ্টির পেছনে রয়েছে অনেক অজানা কাহিনী। পাহাড়িরা এটিকে দেবতার লেক বলেও চিনে। পাহাড়ের ওপর সান বাঁধানো বেষ্টনিতে প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে বগালেকের অবস্থান। এই লেকের পানি দেখতে নীল রঙের। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২০০-৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি বগালেক। বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বগালেক। লেক সৃষ্টির পেছনে অনেক কিংবদন্তির কথা লোক মুখে শোনা যায়। বগালেকের সৌন্দর্য দেখার জন্য পর্যটকদের ভিড়ও দিন দিন বাড়ছে। তবে বর্ষা মৌসুমে বগালেকে যাতায়াত করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শুষ্ক মৌসুমে বগালেকেমোটরসাইকেল কিংবা জিপগাড়িতে করেও যাওয়া যায়। কিংবদন্তি বগালেক যেতে হলে সাথে শুকনো খাবার, পানি, টর্চলাইট ও জরুরী ওষুধ সাথে রাখা দরকার। শীতকালে গরম কাপর সঙ্গে নেয়ার কথা ভুলে গেলে চলবে না। পর্যটকদের রাত্রিযাপনের সুবিধার্থে বগালেকে জেলা পরিষদের রেস্ট হাউজ এবং স্থানীয়ভাবেও আরো দুটি গেস্ট হাউজ রয়েছে। রাতে চোলার বিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত হয় রেস্ট হাউজের প্রতিটি কক্ষ। চাঁদের আলোয় কিংবদন্তি বগালেকের সৌন্দর্য আরো স্মৃতিমধুর।
রুমা রিজুক ঝর্ণা
প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি রুমা জলপ্রপাত। সব মৌসুমেই সচল রুমা জলপ্রপাতের স্বচ্ছ পানি ঝড়ে পড়ে সরাসরি নদীতে। নদী পথে রুমা থেকে থানছি যাওয়ার পথে রুমা জলপ্রপাতের (রিজুক ঝর্ণা) এ দৃশ্য চোখে পড়ে। রিজুক, রেমাক্রি ওয়াহ এবং তেছরী প্রপাত-তিন অপরূপা অরণ্য কন্যার নাম। প্রথমটি সহস্র ফুট উঁচু থেকে সাঙ্গু নদীর বুকে ঝড়ে পড়া এক বিশাল ও প্রবল ঝর্ণাধারা। অপর দুটি জলপ্রপাত। সাঙ্গু নদীর তীরে জলপ্রপাত থেকে সারাবছরই ঝমঝম শব্দে পানি ঝড়ে পড়ে। পাহাড়ের ওপর থেকে জলপ্রপাতের ঝর্ণার পানি ঝড়ে পড়ার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো। জলপ্রপাত রুমা উপজেলার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণে। রুমা থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় সহজেই জলপ্রপাত এবং ঝর্ণায় যাওয়া যায়। রিজুক ঝর্ণা নিজস্ব গতিতে সব মৌসুমেই থাকে সচল। রিজুক ঝর্ণার হিমশিতল স্বচ্ছ পানি খুবই ঠান্ডা। রিজুক ঝর্ণা ইতিমধ্যে পর্যটকদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ (পর্বত চূড়া)
দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ নিয়ে নতুন করে বির্তক দেখা দিয়েছে। বই পুস্তক এবং সরকারি তথ্যমতে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জরিপ চালিয়ে দেখা যায় সবচেয়ে বড় পর্বত হচ্ছে তাজিংডং বা বিজয়। এই পর্যন্ত বই পুস্তকেও তাই লেখা রয়েছে। তাজিংডং (বিজয়) পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ট হতে প্রায় তিন হাজার ৪০০ ফুট। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়া কেওক্রাডং পাহাড়ের উচ্চতা তিন হাজার ১৭২ ফুট। দুটি পর্বত চূড়ায় রুমা উপজেলায় অবস্থিত। রুমা থেকে তাজিংডং (বিজয়) চূড়ার দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার এবং কেওক্রাডং পাহাড়ের দূরত্ব রুমা উপজেলা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। হেঁটে যেতে হয় পর্বতচূড়াগুলোতে। তবে শুষ্ক মৌসুমে জিপগাড়িতে করে তাজিংডং চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু বই পুস্তক এবং সরকারি জরিপকে ভুল প্রমাণিত করল ন্যাচারাল অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব ও নর্থ আল পাইন বাংলাদেশের সদস্যরা। বান্দরবান সফরে এসে ২০০৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর দলনেতা ওয়াদুদ মহসীন রুবেলসহ ক্লাবের সাত সদস্য সাকা হাফং বা ত্ল্যাং ময় পাহাড়ের চূড়ায় উঠেন এবং জিপিআরএস যন্ত্রের সাহার্যে সাকা হাফং বা ত্ল্যাং ময় পাহাড়ের উচ্চতা নির্ণয় করেন। একই সাথে তারা কেওক্রাডং পাহাড়ের উচ্চতাও নির্ণয় করেন। নির্ণয় করে দেখা গেছে, কেওক্রাডং পাহাড়ের উচ্চতা তিন হাজার ১৭২ ফুট এবং সাকা হাফং বা ত্ল্যাং ময় পাহাড়ের উচ্চতা ৩৪৮৮ ফুট।
দেখা যায় কেওক্রাডংয়ের চেয়ে সাকা হাফং বা ত্ল্যাং ময় পাহাড় ২৭৬ ফুট উঁচু। পাহাড়ি বম সম্প্রদায়ের ভাষায় পাহাড়টির নাম ত্ল্যাং ময়। এর বাংলা অর্থ পাহাড় সুন্দর। আর ত্রিপুরা পাহাড়িদের ভাষায় সাকা হাফং। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে পূর্বের চূড়া। অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের সদস্য মহসীন ও সাজ্জাদ জানান, স্থানীয় গাইডের সহায়তায় তাঁরা মিয়ানমার সীমান্তবর্তী থানচি উপজেলার দূর্গম শালুকিয়াতে পৌঁছান। তারপর প্রায় তিন ঘন্টা পায়ে হেটে তারা সাকা হাফং বা ত্ল্যাং ময় পাহাড়ের চূড়ায় উঠেন। সাকা হাফং বা ত্ল্যাং ময় পাহাড়ের চূড়ায় উঠা দ্বিতীয় ব্যাক্তি হচ্ছেন এডভেঞ্চার ক্লাবের (এক্সিট্রিস্ট) সদস্যরা। এরআগে বিট্রিশ পর্বতারোহী জিং ফালেন প্রথম সাকা হাফং বা ত্ল্যাং ময় স্বপ্ন চূড়ায় উঠেন এবং চূড়ার উচ্চতা নির্ণয় করেন। অপরদিকে রোয়াংছড়িতে রয়েছে আরো একটি বড় পর্বত। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত শিপ্পি পর্বত। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে শিপ্পি পাহাড়ের উচ্চতা ৩০২৮ ফুট। বম ভাষার শব্দ শিপ্পি (রামজু) পাহাড়ের বাংলা অর্থ বড় পাহাড়। রোয়াংছড়ি শহর থেকে পাহাড়িদের রনিনপাড়া হয়ে প্রায় ৮ ঘণ্টা হাঁটতে হবে শিপ্পি পর্বত পৌঁছাতে। শিপ্পি পর্বত থেকে ভারতের মিজোরাম, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো সহজেই দেখা যায়।
প্রান্তিক লেক
সবুজের মাঝখানে প্রাকৃতিক লেক, নাম প্রান্তিক লেক। প্রায় আড়াই একর পাহাড়ি এলাকাজুড়ে প্রান্তিক লেকের অবস্থান। বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের হলুদিয়ার সন্নিকটে প্রান্তিক লেক অবস্থিত। অপূর্ব সুন্দর লেকের চারপাশ নানান প্রজাতির গাছগাছালিতে ভরপুর। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলেও প্রান্তিক লেক এখনো অবহেলিত। পর্যটন স্পট হিসেবে প্রান্তিক লেকের পরিচিতি কম হলেও লেকের সৌন্দর্য সত্যি দৃষ্টি নন্দন। এখানে পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য আকষর্ণীয় টাওয়ার। ছোট ছোট অসংখ্য ইটের তৈরি ব্যান্স। চলচিত্র নির্মাতাদের কাছে স্থানটি খুবই পছন্দনীয়। জেলা শহর থেকে প্রান্তিক লেকের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। প্রান্তিক লেক যাওয়ার পথে রয়েছে মনমাতানো অনেক দৃশ্য।
ন্যাচারাল পার্ক
প্রকৃতিকে চিনতে ঘুরে আসতে পারেন ন্যাচারাল পার্কে। প্রকৃতিকে চেনা, প্রকৃতিকে জানা এবং প্রকৃতির সাথে সময় কাটানোর উপযুক্ত স্থান এটি। বান্দরবান-চট্টগ্রাম সড়কের হলুদিয়া এলাকায় পার্কটি অবস্থিত। জেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। প্রায় ৫০ একর জায়গার ওপর বেসরকারিভাবে গড়ে উঠেছে ন্যাচারাল পার্ক। প্রায় শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ, বনজ এবং ওষুধী বৃক্ষ রয়েছে এখানে। ন্যাচারাল পার্কে ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোলা ক্ষুদ্রায়াতনে চা বাগান পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে। এখানে বনাঞ্চলের ভিতরে ভিতরে রয়েছে অসংখ্য মাচাংঘর বা গোলঘর। পর্যটকদের বিশ্রামের সুবিধার্থে তৈরি ছোট ছোট গোলঘরগুলোও ন্যাচারাল। আর্টিফিশিয়াল কিছু নেই এখানে। ন্যাচারাল পার্কে অবাধে বিচরণ করে হরিণ, বানর, খরগোশসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী। মনোরম পরিবেশে প্রিয়জনের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে প্রতিদিন শত শত পর্যটক ভিড় জমায় ন্যাচারাল পার্কে। বিশেষভাবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য ন্যাচারাল পার্ক উপযুক্ত একটি স্থান। ন্যাচারাল পার্কের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো। শতাধিক প্রজাতির বৃক্ষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ মিস করবেন কেন?। ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসুন ন্যাচারাল পার্কে।
জীবননগর
বান্দরবান-থানছি সড়কের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার ৫২ কিলোমিটার পয়েন্টে জীবননগর অবস্থিত। এখান থেকে বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পূর্ণ মাত্রায় উপভোগ করা যায়। দেশের উঁচু পাহড়ের ওপর দিয়ে নির্মিত রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছাতে হয়। চিম্বুক থেকে জীবননগরে দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। জীবননগর থেকে ছোটবড় অনেক পাহাড় দেখা যায়। জীবননগরের মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে রয়েছে প্রাকৃতিক ঝর্ণা। সারাবছর ঝর্ণার পানি ঝড়ে পড়ে। জীবননগরে ঘন কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের কিরণ প্রকৃতির অপরুপ সৌর্ন্দয। এ দৃশ্য স্মরণীয় করে রাখার মতো। এখানেও মেঘ আর রোদের মধ্যে চলে লুকোচুরি খেলা। ঘন মেঘের চাদরে স্বল্প সময়ের জন্য নিজেকে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ মিলে এখানে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন
প্রকৃতির অপরূপ দান উপবন পর্যটন স্পট, এখানে বনের মাঝে লেক। আর লেকের ওপর আকর্ষণীয় ঝুলন্ত সেতু। মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্সের ঝুলন্ত সেতু দুটির চেয়ে লম্বা উপবন ঝুলন্ত সেতু। বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় উপবন অবস্থিত। উপজেলা সদর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে উপবনে রয়েছে বিশাল একটি লেক। লেকের চারপাশ নানান রকমের গাছগাছালিতে ভরপুর। প্রকৃতির ঠাণ্ডা বাতাস ও পাখির কলকাকলির শব্দে প্রাণ জুড়িয়ে যায় এখানে। পর্যটকদের সুবিধার্থে লেকের চতুরদিকে রয়েছে ছোটছোট গোলঘর। কোলাহল মুক্ত পরিবেশে কিছুক্ষণ সময় কাটার জন্য উপবন উপযুক্ত স্থান।
লামা মিরিঞ্জা
বান্দরবানের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে একটি মিরিঞ্জা। বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় অবস্থিত মিরিঞ্জা পর্যটন স্পট। লামা-আলীকদম সড়কের ১৬ কিলোমিটার পয়েন্টে মিরিঞ্জা পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে মিরিঞ্জা পর্যটনের উচ্চতা প্রায় এক হাজার ৫০০ ফুট। এটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় স্থান। এখান থেকে পাহাড়ের কোলঘেঁষে প্রবহমান মাতামহুরী নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথ ও লামা উপজেলা স্বচক্ষে দেখা যায়। এ ছাড়া অনুকূল আবাহাওয়ায় বঙ্গোপসাগরসহ মহেষখালী দ্বীপ দেখা যায়। সবুজে ঘেরা মিরিঞ্জা পর্যটন স্পটে রয়েছে আকর্ষণীয় টাওয়ার, পাহাড়ি পথে ঘুরে বেড়াতে অসংখ্য সিঁড়ি। এ ছাড়া টাওয়ারে টাওয়ারে রয়েছে উঁচু সংযোগ সিঁড়ি এবং বেশকিছু গোলঘর। শিশুদের বিনোদনের জন্য মিরিঞ্জায় রয়েছে শিশুপার্ক। অনেক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় মিরিঞ্জা পর্যটনে। অবশ্য গাড়িতে উঠার রাস্তাও রয়েছে।
থানছি নাফাকুম/বড়পাথর
রহস্যময় থানচি উপজেলা ভ্রমণ দারুণ রোমাঞ্চকর। বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শিখড়ে রয়েছে দুর্গম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থানচি। পাহাড়, আকাশ, নদী ও ঝর্ণা এখানে মিলেমিশে একাকার। সবুজ পাহাড়ের গায়ে পরগাছার মতো জড়িয়ে আছে সাদা মেঘ। ভাগ্য সহায় হলে যাত্রাপথে রাস্তায় মেঘ এসে ধরা দিতে পারে আপনাকে। জেলা সদর থেকে থানচি উপজেলার দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার। পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঁচু-নিচু রাস্তায় ছুটে চলে গাড়িগুলো। হঠাৎ নিচের দিকে তাকালে শিউরে উঠে গা, কত উঁচু দিয়ে চলাচল করছে গাড়ি। যাত্রীবাহী বাস এবং জিপগাড়ি দুটোরই ব্যবস্থা রয়েছে। বাসে থানচিতে যেতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। রেমাক্রীমুখ থেকে নাফাকুম ঝর্ণা ভ্রমণের উদ্দেশে যাত্রা শুরু। পাহাড়ের ঢালে ঢালে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটার রাস্তা। দূরত্ব প্রায় ১১-১২ কিলোমিটার। নেই নাফাকুম যাওয়ার কোনো রাস্তাও। ভ্রমণ পিপাসুরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বন-জঙ্গল মারিয়ে নাফাকুমে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে ছোট ছোট কয়েকটি খাল-ছড়াও পার হতে হয় পর্যটকদের।
তবে চলাচলে রাস্তা এবং থাকার কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও ভ্রমণে নিরাপত্তা স্বার্থে পর্যটকদের সঙ্গে একজন স্থানীয় গাইড নেওয়ারও নিয়ম রয়েছে প্রশাসনের। নাফাকুম ঝর্ণার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে ভ্রমণের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে নিমেষেই। তবে অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে নাফাকুমে নানা রকমের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে ভ্রমণ পিপাসুরা। নাফাকুমে বিশেষ বিশেষ জায়গায় প্রশাসনের নেই কোনো সতর্ক দৃষ্টি। পর্যটকরা সতর্ক দৃষ্টি না থাকায় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে পড়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। নাফাকুম ঝর্ণায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়া প্রশাসন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নাফাকুম ঝর্ণার সৌন্দর্য বর্ধনে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেনি। নাফাকুম ঝর্ণার স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের ওপর থেকে ঝড়ে পড়ে নিচে। ঝর্ণার খরস্রোতে পা পিছলে কেউ পড়ে গেলে কোথাও আটকা পড়ে প্রাণ বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। পা পিছলে পড়লেই চলে যাবে গভীর খাদে। সম্পূর্ণ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমণ পিপাসুরা নাফাকুমের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যায়।
সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভ্রমণ
বান্দরবান শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি সাঙ্গু নদীর দু-কূলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপরূপ। নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত বোটে চড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করার মজাই আলাদা। নদীপথে ভ্রমণ করলে নদীর তীরে পাহাড়িদের বিশেষ কায়দায় তৈরি টংঘরগুলো দেখা যায়। সেই সাথে উঁচু পাহাড়ের কূল ঘেঁষে বয়ে চলা সাঙ্গু নদীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ায় মতো। শহর থেকে একটু দূরে ভাটির দিকে শীতামুড়া পাহাড় প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি দেখে ভোলার নয়। এ ছাড়া উজানে তারাছা রেঞ্জের নৈসর্গিক সৌন্দর্য সত্যি অসাধারণ। নদী পথে ভ্রমণের জন্য শহরের বাজার সংলগ্ন সাঙ্গু ব্রিজের নিচে এবং কালাঘাটা এলাকায় পাওয়া যায় নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত বোট। চুক্তিভিত্তিক মূল্যে মাঝিরা পর্যটকদের নৌপথে ভ্রমণের সুবিধা দিয়ে থাকে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি এসি-ননএসসি বাসে আসতে পারবেন বান্দরবান। তবে চট্টগ্রাম হয়ে বান্দরবান আসতে হলে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে আসতে হবে। এখান থেকে আধা ঘণ্টার ব্যবধানে আপনি পাচ্ছেন পূরবী-পূর্বাণী নামে দুটি বাস সার্ভিস। বাসের ভাড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকা। বাসে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত। আর নিজস্ব এবং ভাড়ায় চালিত রিজার্ভ গাড়ি নিয়েও বান্দরবান আসতে পারবেন। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম থেকে সময় লাগবে আরো কম। তবে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের গাড়িতে করে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কেরানিহাট রাস্তারমোড়ে নেমে গিয়ে পৃথক গাড়িতে করে বান্দরবান আসতে পারবেন। কেরানিহাট থেকে বান্দরবানের দূরত ২৩ কিলোমিটার। সময় লাগে ৪০ মিনিট থেকে একঘণ্টা।
কোথায় থাকবেন
বান্দরবানে পর্যটকদের থাকার জন্য বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট এবং গেস্টহাউজ আছে। হলিডে ইন রিসোর্টে এসি-ননএসি দুই ধরনের রুম ভাড়া পাওয়া যায়। এ ছাড়া তাবুতে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। এখানে থাকতে প্রতিদিন রুম প্রতি গুনতে হবে দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। পালকি গেস্ট হাউজ হচ্ছে জেলা শহরের মধ্যেই পাহাড়ের উঁচুতে এসি-ননএসি দুই ধরনের রুমেই থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে। এখানে থাকতে হলে প্রতিদিন গুনতে হবে- এক হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। ভেনাস রিসোর্টেও পর্যটকদের থাকার জন্য অনেক আকর্ষণীয় কটেজের ব্যবস্থা রয়েছে। সঙ্গে খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে। এখানে থাকতে হলে প্রতিদিন গুনতে হবে দুই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। পর্যটন মোটেলেও পর্যটকদের স্বপরিবারে রাত্রিযাপন এবং খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে রাত্রিযাপনে গুনতে হবে রুমপ্রতি দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত।
কীভাবে ঘুরে বেড়াবেন
বান্দরবানের বিভিন্ন পর্যটন স্পট ঘুরে বেড়াতে ভাড়ায় চালিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ি পাওয়া যায়। তবে দুই একজনের জন্য রিজার্ভ পর্যটকবাহী গাড়িগুলোর ভাড়া অনেকটা বেশি। সেক্ষেত্রে দলবল নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে বান্দরবান ঘুরে বেড়াতে এলে খরচ অনেকটাই সাশ্রয়ী হয়। সিএনজি এবং মহেন্দ্র গাড়িতে করেও পর্যটন স্পটগুলো সহজে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব। এ ছাড়া বেশির ভাগ পর্যটন স্পটের রুটে বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। সেগুলোতে করে যাতায়াত করলে খরচ আরো কমবে। তবে সময় লাগবে একটু বেশি।
বান্দরবানে কী কী কিনতে পাওয়া যায়
পাহাড়িদের কোমর তাঁতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের কাপড়-চোপড় এবং বাঁশ কাঠের তৈরি হস্তশিল্পের বিভিন্ন রকমের শোপিস। পাহাড়িদের আতিথেয়তা এবং ভালোবাসাও সঙ্গে নিয়ে যাবেন।
জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় দুর্গমাঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রশাসনের তালিকাভুক্ত গাইডের মাধ্যমে নির্ধারিত ফরমে নাম-ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর এবং ভ্রমণের স্থানগুলো লিখে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ফরমটি জমা দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়েছে। তবে নীলগিরি, চিম্বুক, নীলাচল, মেঘলা, স্বর্ণমন্দিরসহ আশপাশের স্পটগুলো ভ্রমণে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তায় দর্শনীয় স্থানগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মিজানুল হক চৌধুরী বলেন, পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি স্থান বান্দরবান। শুধু শীত নয়, বর্ষায় পাহাড় আরো সবুজ এবং বৈচিত্র্যময়। পর্যটনশিল্পের অনেক উন্নয়ন হয়েছে এ জেলায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা এবং আবাসন ক্ষেত্রেও নতুন নতুন বেশকিছু কটেজ, হোটেল-মোটেল এবং গেস্ট হাউজ হয়েছে। নীলাচলের পর এবার শৈল প্রপাতের সৌন্দর্য বর্ধনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শীতে পর্যটকদের বাড়তি চাপের কথা মাথায় রেখে পর্যটকের নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় ভ্রমণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।