ঈদ নিয়ে আমাদের প্রবাসীদের মাঝে একটা কথা বেশ প্রচলিত, “আরে, আমাদের প্রবাসীদের আবার কীসের ঈদ!” প্রবাসে আসার আগে এই কথাটার মর্ম কোনদিন বুঝিনি, কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি।
আমি একজন ইতালি প্রবাসী, কিন্তু তার আগে আমি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে ছিলাম। সে অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে বলতে পারি, প্রবাসের ঈদ দুই ধরনের হয়। যেমন মধ্যপ্রাচ্যের ঈদ আর ইউরোপ-আমেরিকার ঈদ। তাই দুই দেশের ঈদ উদযাপন নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করি।
কাতারে যখন ছিলাম, তখন ঈদ ছিল ভিন্নরকম। সেখানে ঈদের ছুটি পাওয়া যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১-২ দিন আগে থেকে। আবার এই ঈদের ছুটি ২-৩ দিন থেকে ৮-১০ দিন পর্যন্ত হয়। ঈদের আগের রাতে আমরা কেউ ঘুমাতাম না, অবধারিত অন্যদেরও ঘুমাতে দিতাম না।
ঈদের আগের সারা রাত আমরা দলবেঁধে আড্ডা দিতাম, কেউ তাস খেলত আবার কেউ কেউ পরেরদিনের ‘বিশেষ’ রান্নার বন্দোবস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় বাজার করতে যেত। এই ‘বিশেষ’ রান্না আবার আহামরি কিছু নয়, কিন্তু তাতেই আনন্দ। সকালে মসজিদে যাওয়ার সময় সেমাই রান্না করা হবে আর দুপুরের ‘বিশেষ’ বিরিয়ানি, এইটুকুই।
এসবের মাঝে রাত ৩টার পর ধীরে ধীরে শুরু হত আমাদের গোসল পর্ব। গোসল শেষে সবাই যার যার মত নতুন-পুরনো পাঞ্জাবি পরে আতর বা সুগন্ধি মেখে মসজিদে ফজর নামাজ পড়তে চলে যাই। কারণ ফজর নামাজের পরপরই ঈদের নামাজ শুরু হয় সেখানে। নিজেদের পছন্দের মসজিদে ঈদের নামাজ শেষ করে প্রথম কাজ কোলাকুলি। এই কোলাকুলি চলে আবার উন্মুক্তভাবে, পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে।
তারপরের পর্ব হয় সেলফি আর গ্রুপ ছবি তোলা নিয়ে। সেই পর্ব শেষ করে বাসায় আসা আর একেকজন মোবাইল নিয়ে একেকভাবে বাড়িতে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর পর্বের মাঝে শুরু হয় বাড়িতে রেখে আসা ঈদের স্মৃতির দুয়ার খোলা পর্বের। এই পর্বে নতুন প্রবাসী হলে, কারো কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে যায়। আবার কেউ হাউমাউ করে কান্না করে। আর যারা পুরনো তারা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বাড়িতে জানায়, ‘আমরা ঈদে খুব মজা করছি’।
কথার ফাঁকে ফাঁকে চলে আবার বিরিয়ানি রান্না। এর মধ্যে সারারাত নির্ঘুম থাকা কেউ কেউ একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ ঘুমানো চলে এবং কিছুক্ষণ পর রুমের মুরুব্বি কেউ একজন হাঁকডাক মেরে সবাইকে ডাকে, ‘এই বিরিয়ানি রেডি, সবাই উঠে পড়’।
হাসি মজায় বিরিয়ানি খেয়ে সবাই আরেকদফা ঘুমিয়ে বিকেলে উঠে গোসল সেরে কয়েক গ্রুপ হয়ে বের হয়ে যাওয়া। এই কয়েকটি গ্রুপের একটি যাবে সিটি সেন্টার মলে। না, কেনাকাটা করতে নয়, স্রেফ ঘোরাঘুরি করতে যাওয়া। এক গ্রুপ যাবে কোন পার্কে, আর আরেক গ্রুপ যাবে সমুদ্র পাড়ে। তারপর রাত হলে ধীরে ধীরে সবাই যার যার মত রুমে ফিরে আসে। কাতারে এভাবেই আমাদের ঈদ শেষ।
একটা জিনিস এখনো বিশ্বাস করি, কাতারে ঈদের অন্যতম উপাদান- পরিবার না থাকলেও কীভাবে যেন ভিন্ন ভিন্ন জেলার, ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষেরাই একেকটা পরিবার হয়ে যায়।
এবার আসি ইতালিতে আমার প্রথম ঈদের অভিজ্ঞতায়। সেই ঈদের দিন ভোরবেলা আমার কাজের দায়িত্ব ছিল ভোর ৫টায়। ঘুম থেকে উঠে ডিউটি পোশাক পরে বের হলাম। মন খারাপ নিয়ে পথে যেতে যেতে ভাবছি, আজ ঈদ। কিন্তু সারা রাস্তায় ঈদের ‘ঈ’-ও কেন দেখতে পাচ্ছি না!
এক ঘণ্টার বেশি সময় বাসে চড়ে কাজে গেলাম, কিন্তু কোথাও এমন কিছু দেখলাম না যাতে মনে হয় আজ ঈদ। আমি যেখানে কাজ করি সেখানে অনেকেই মুসলমান। কিন্তু কারো মধ্যে ঈদের বিন্দুমাত্র আমেজ নেই, আমি অবাক হয়ে গেলাম। সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ততা দেখে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
যাই হোক, অফিস শেষ করে বাসায় আসতে আসতে বিকেল ৫টা বেজে গেছে। বাসায় এসে কিছু খেয়ে মোবাইলটা হাতে নিতে নিতে আমার খেয়াল হলো, পুরো একটা ঈদের দিন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু একজন মানুষের সাথেও ‘ঈদ মোবারক’ বলে কোলাকুলি হলো না।
সেদিন এতটুকু বুঝলাম, মধ্যপ্রাচ্যের ঈদে পরিবার না থাকলেও একটা ঈদের আমেজ ছিল। একটা ঈদ ঈদ ভাব ছিল। কিন্তু ইতালিতে এসে বুঝলাম এখানে অনেক কিছু থাকলেও, ঈদটাই নেই।
সব প্রবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।