শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১২ অপরাহ্ন
Uncategorized

প্রকৃতির প্রতিশোধই সত্য হলো

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০২৪

ছোটবেলায় ধুয়োজারির গান শুনতে যেতাম। বয়াতি গাইতেন : ‘গুরু গুরু বলে ডাকি গুরু রসের গোলা-আ-আ, ও রে এমন দোয়া দিলে গুরু তুমি কাঁধে দিলে ঝোলা।’ এত বছর ধরে লিখছি, কিন্তু আজ কলম ধরতে কেন জানি সংকোচ বোধ করছি। দুপুরের আগেই আমার ছাত্রছাত্রীরা তাদের বিজয় আমাকে ফোনে জানিয়েছে। সার্বিক সহযোগিতার জন্য আমাকে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছে। আমি নিভৃতচারী, নিভৃতেই রয়ে গেছি। বিজয়োল্লাসে যাইনি। কেউ কেউ অনেক জায়গায় এটাকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে আখ্যায়িত করছে। কেউ আবার ‘দ্বিতীয় বিজয়’ দিবসও বলছে। আমি কোনোটাতেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। হতে পারে এদেশের আপসহীন ছাত্রছাত্রীরা ও সাধারণ মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে। একটা অগণতান্ত্রিক সরকার বছরের পর বছর জনগণের বুকে চেপে বসে যে মিথ্যাচার ও লুটপাট করে চলছিল, অথচ বিরোধী দল তাদের কোনোভাবেই গদিচ্যুত করতে পারছিল না, এদেশের অকুতোভয় ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষ তা পেরেছে, তাই দ্বিতীয় বিজয় দিবস। এতে আমি আনন্দিত হইনি, বরং দুটি কারণে কষ্টে ও ভয়ে আছি।

একটি হচ্ছে : যে শত শত ছাত্র ও সাধারণ নিরীহ মানুষ এতে প্রাণ দিয়েছে, তাদের কথা স্মৃতি থেকে মুছতে পারছি না; চোখে ভাসছে, তাই হাসতে পারছি না। যারা চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে, তাদের কথাও ভাবছি। বারবার তাদের পরিবারের কথা ভেবে মনটা কাতর হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া যেসব মানুষকে হত্যা করে লাশ গায়েব করার উদ্দেশ্য নিয়ে বেওয়ারিশ বলে কোথাও কবর দেওয়া হয়েছে, অতি তাড়াতাড়ি খোঁজ করলে এখনো হয়তো শনাক্ত করা যাবে। সামাজিক মিডিয়ায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে কিছু কবর দেখলাম। সেখানেও খোঁজ করা যেতে পারে। এতে অন্তত লাশের মোটামুটি সংখ্যাটা জানা যাবে। রায়েরবাজার বধ্যভূমির কথা মনে হলে তা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়া আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে যোগাযোগ করে অনেক লাশের খোঁজ করা যেতে পারে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

এ পরিবর্তন যদি ইতিবাচক হয়, মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে, তবেই তাকে সমর্থন করি। আমি তো কৈশোরের শেষ প্রান্ত থেকে আশায় আশায় দিন গুনছি, এখন এক পা কবরে চলে গেছে। এদেশের উন্নতির পরিবেশ দেখে মরতে পারব তো? আমার মনে হয়, এদেশের উন্নতিটা যদি নিজে করে দেখিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে মনে সান্ত্বনা খুঁজে পেতাম। আমার মতো সাধারণ একজন মাস্টার সাহেবের সে যোগ্যতাও তো নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে একদল এসে নির্বাচন করে দিয়ে সরে যাবেন। আবার যাহা পূর্বং, তাহাই পরং। দেশ পরিচালনায় আমার কিছু সেট নীতিমালা দীর্ঘ বছর ধরে মনে জড়ো হয়েছে। কিছু কথা পত্রিকাতেও লিখেছি। আমি জানি সেটা অব্যর্থ। এ পত্রিকাতেই বিস্তারিত লিখব। আমার দায়িত্ব আমি পালন করে যাব। বাস্তবায়নের দায়িত্ব পদধারীদের। যে দলই হোক বা ব্যক্তিই হোক, মিথ্যা, দুর্নীতি ও ভাঁওতাবাজির সঙ্গে কোনো আপস নেই।

সোমবার একটা লেখা পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম, যা মঙ্গলবার (০৬.০৮.২০২৪) প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। সেখানে সরকারি দলের উদ্দেশে যা লিখেছিলাম, তার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরছি। কেউ এখান থেকে সত্য খুঁজে নিতে পারেন। লিখেছিলাম : “এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল প্রথম থেকেই যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে, আমি তার সঙ্গে সহমত জানাতে পারছি না। তারা প্রথমেই ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের রামদা, কিরিচ, চাপাতি হাতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দমনে নামাল কেন? জানতে হবে, ‘বাঁদরের বাঁদরামি সব জায়গায় নয়’। আমার এসব বিস্বাদ কথা অনেকের পছন্দ হবে না জানি। কারণ রাজনীতিকদের চোখ একটা, আমার তো দুটো, একথা আমি সব সময় বলি। এ পরিস্থিতিতে এদেশের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য কী কী করণীয়, তা আমার এবং আমার মতো সাধারণ নাগরিক, দেশপ্রিয় অনেক সুশিক্ষিত, সরাসরি কোনো দলভুক্ত না যারা, তাদের জানা। ছোট্ট একটি সুন্দর দেশ, এদেশ নির্মোহ ও অহিংসভাবে পরিচালনা করা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এমন কোনো কঠিন কাজ নয় বলে জানি।

এ বিষয়ে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের কথা স্মরণ করি। এ পরিস্থিতির মতো এতটা অরাজক অবস্থা কিন্তু তখন হয়নি। তারপরও এরশাদ সরকার অল্প আন্দোলনে ক্ষমতা ছেড়েছিলেন। তাতে তিনি ভালোই করেছিলেন; অন্তত তার এদেশেই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ছিয়ানব্বইয়ে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে বিএনপিও ক্ষমতা ছেড়েছিল। আবার বিএনপি এখনো এদেশে রাজনীতি করে যাচ্ছে। বরিশালে গিয়ে একটা আঞ্চলিক কথা শিখেছিলাম, ‘যে সয়, সে রয়’। এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল অনেক ভুল করে চলেছে, যার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ খেসারত দেশ ও ইতিহাসের কাছে তাদেরকেই দিতে হবে। অনেক বছরের পুরোনো একটা শিক্ষণীয় ঘটনা অতি সংক্ষেপে বলি, অনেকটাই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে : শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি তখন ভারতের ক্ষমতায়। তিনি কোনো এক প্রদেশের জনসভায় ভাষণ দিতে গেলে বিশৃঙ্খল উত্তেজিত জনসাধারণ তার দিকে মারমুখী হয়ে তেড়ে আসছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রক্ষা করতে পারছে না।

তিনি গুলি ছোড়ার অনুমতি দিলেন না। মঞ্চের পেছনে বাঁশ বাঁধা। তিনি তার নিচ দিয়ে মাথা ও কোমর নুয়ে পেছন দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন। অনেক সাংবাদিক সে অবস্থার ছবি তুলে পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন; পরে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো গুলি ছোড়ার অনুমতি দিতে পারতেন; বিশেষ ক্ষমতা আইনে রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন, তা করলেন না কেন? তিনি তার কারণ বলেছিলেন। আমার পুরোটা মনে নেই। তিনি পরের নির্বাচনে সে রাজ্যে বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় এসেছিলেন। জনসাধারণ তাকে আবার ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। এদেশে যারা যেমন রাজনীতি করেন, সব দলের মন-মানসিকতা, কর্মকাণ্ড, নেতা-নেত্রীদের ‘চাটার দল’ পোষার পরিণতি আমাদের মোটামুটি জানা। অনেক দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীর সততা, কথার গুরুত্ব, লোভ-লালসা, ধরাকে সরা জ্ঞান করা, ডাহা মিথ্যা কথন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মোসাহেবি, দেশপ্রেম সবই প্রায় আমার মতো অনেকের জানা। এসব ‘চাটার দল’ সঙ্গে নিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। দলের মধ্যেও দোষ ধরিয়ে দেওয়ার কিছু লোক থাকা দরকার। সমালোচনা করলেই সে বা তারা খারাপ, তা নয়। দীর্ঘ কর্মজীবনে এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এসব বিবেচনায় এখন সমঝে চললে ক্ষমতাসীন দলের পরবর্তীকালে আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা অনেকটাই সহজসাধ্য ছিল।

এ অবস্থার জন্য দায়ী ফ্যাক্টরগুলো অতি সংক্ষেপে বলি। তারা কোনো সমালোচনাকে ভালোভাবে বিবেচনা করতে পারে না। আমিও সমালোচনা করি। ক্ষমতাসীন দল ও কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়; সিস্টেম, পরিস্থিতি, কর্ম ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে। এ ক্ষমতাসীন সরকারের এ টার্মে প্রায় দেড় যুগ হতে চলল কর্মকাণ্ড ক্রমেই খারাপের দিকে গেছে। উদাহরণ কয়েকটা দিচ্ছি, যেমন-হরিলুটের ব্যাংক ব্যবসা, সর্বৈব মিথ্যাচার, অব্যবস্থা-অবিচার, দেশব্যাপী দুর্নীতির হোলিখেলা, নির্ভেজাল দলবাজি, দেশব্যাপী দুষ্কৃতকারীদের দলভুক্তকরণ, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের স্বার্থকে বহিঃশক্তির কাছে বিকিয়ে দেওয়া, অফিস-আদালত ও সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ, ‘গুমকাণ্ড’ করে বিরোধী মত দমন, প্রকাশ্য নানা অভিনব পন্থায় বারবার গণতন্ত্র চুরি, হাজার হাজার ‘বালিশকাণ্ড’, ‘ছাগলকাণ্ড’, ‘বেনজীর গংকাণ্ড’, ‘মতিউর রহমান গংকাণ্ড’, ‘এমপি আনার হত্যাকাণ্ড’, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি-এমন আরও শত শত ঘটনা।

এসব কাণ্ডকারখানায় জনজীবন অতিষ্ঠ, দেশ কোষাগারশূন্য, সম্বল বিদেশি ঋণ, ঋণ করে ঘি খাওয়া আর উন্নয়নের বাহানা ও বিজ্ঞাপন; বাকিটা সিস্টেম লস, ‘চাটার দল’ প্রতিপালন। সবই নির্ভেজাল বাস্তবতা। এসব কোনো কিছুই দেশ ভালো চলছে প্রমাণ করে না। খোলা সামাজিক মাধ্যমের এ যুগে প্রত্যেক সচেতন মানুষই ভালো-মন্দ বোঝেন ও জানেন। ক্ষোভগুলো দীর্ঘদিনে মানুষের মধ্যে দলমতনির্বিশেষে পুঞ্জীভূত হয়েছে। এখন তা বিস্ফোরিত হচ্ছে। ফল খাওয়ার লোভে গাছে তোলা লোক অনেক আছে, কিন্তু নিরাপদে নামিয়ে আনার লোকের সংখ্যা নগণ্য। সব দলকেই তেপ্পান্ন বছর ধরে দেখে আসছি; অন্যায় কাজে কেউ কম, কেউ বেশি, কেউবা অসহনীয় বেশি। এটা আমার সব দলের প্রতি আত্মবিশ্লেষণের কথা। নিজেদের আমরা খোলা মনে জিজ্ঞেস করতে পারি। আমি জানি আমি ভুল বলিনি।

ক্ষমতাসীন দল ছাত্রছাত্রী, বিরোধীপক্ষ ও সাধারণ মানুষের এ গণরোষ ও বিক্ষোভ সামলাতে পারবে কি না আমি সন্ধিহান। এ পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের অতি কাছের ও দূরের সমব্যথী অনেক দেশই রসদ ও শৃঙ্খলা-বাহিনী নিয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে। এটা ক্ষমতাসীন দলের জন্য আপাতত সহায়ক বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হতে পারে। তবে এর মধ্যে অনেক অপাঙ্ক্তেয় পরিণতি লুকিয়ে আছে। আমি আন্দোলনকারী অনেকের মুখে দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে বলতে শুনেছি। আমি একমত হতে পারি না। আমি বলি, এটা অন্যায়-অত্যাচার, মিথ্যাচার, আইনহীনতা, লুটপাট ও দুরাচারবৃত্তি, নির্বিচার নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমী সব পেশার স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের দেশ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন। ক্ষমতাসীন দলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এটা আমি আশা করি।’’

গত সোমবারের আমার এ লেখা তাদের স্বভাবের জন্য প্রযোজ্য হলেও পরিণতির জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ তারা পালিয়ে গেছেন। আমি জানি, পতিত সরকার যথাসাধ্য ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে গেছে। অন্য কোনো দেশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি, নাকি পতিত সরকারই সাহায্য চায়নি-এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তিনি পালিয়ে না গেলেও পারতেন। তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে এত ভয় কেন? তিনি গেলেন, তবে পিতার পথ অনুসরণ করে আগস্ট মাসেই গেলেন। পিতাকে কলঙ্কিত করে গেলেন। দেশে মিষ্টির দোকানে সব মিষ্টি বিক্রি শেষ। যে দেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন, সেদেশেই আবার গেলেন। মাঝখানে রেখে গেলেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রী গুম ও গণহত্যার কলঙ্কের দাগ।

তিনি গেলেন কোটি কোটি মানুষের অকথ্য গালি নিয়ে; দেশের মাথায় ঋণের বিশাল বোঝা চাপিয়ে, কোষাগার শূন্য করে, লুটেরা গোষ্ঠীকে দেশ লুট করার সুযোগ করে দিয়ে, প্রতিটি সেক্টরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকিয়ে। উপরিগতভাবে যে যা-ই বলুক, দেশ ও সমাজের এ ক্ষত অনেক গভীর। চিকিৎসা অতটা সোজা নয়! ভবিষ্যৎ ইতিহাস এর সঠিক মূল্যায়ন করবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি এ জনমে হেসে মরতে পারব কি না, জানি না। লালনের গান মনে আসে : ‘আশা সিন্ধু তীরে বসে আছি সদাই, আশা সিন্ধু তীরে…’।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com