1. [email protected] : চলো যাই : cholojaai.net
পোল্যান্ডে ভূগর্ভে সুবিশাল শহর বানিয়েছিল জার্মানরা
মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:৪৫ পূর্বাহ্ন

পোল্যান্ডে ভূগর্ভে সুবিশাল শহর বানিয়েছিল জার্মানরা

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পোল্যান্ডের ছোট্ট গ্রাম পনিয়েভো। চারপাশে শান্ত-নিরিবিলি গ্রামীণ দৃশ্য। দেশের সমতলের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানে বিস্তীর্ণ ফসলের খেত, খোলা আকাশ আর মাঝেমধ্যে সবুজ বনভূমি। ওপরে প্রথম দেখায় সবকিছুই সাধারণ মনে হয়। কিন্তু মাটির নিচে লুকিয়ে আছে অন্য এক জগৎ—জার্মান নাৎসিদের গড়া ভূগর্ভস্থ শহর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে জার্মানির পূর্ব সীমান্ত সুরক্ষায় হিটলার নির্মাণ শুরু করেন বিশাল এক দুর্গের। নাম দেওয়া হয় ফেস্টুংসফ্রন্ট ওডার-ভার্টে-বোগেন, সংক্ষেপে অস্টভাল। ওডার আর ভার্তা নদীর মাঝের এই করিডর তখন ছিল জার্মানির অংশ। বার্লিনের নিরাপত্তার জন্য কৌশলগতভাবে জায়গাটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ছবি: সিএনএন—এর সৌজন্যে
ছবি: সিএনএন—এর সৌজন্যে

১৯৩৫ সালে এই শহর তৈরির পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়, এক বছর পর শুরু হয় নির্মাণকাজ। হিটলার নিজে এসে প্রকল্প উদ্বোধন করেন। পরিকল্পনা ছিল প্রায় ৫০ মাইল দীর্ঘ প্রতিরক্ষা লাইন বানানোর। শুধু কেন্দ্রীয় অংশেই ব্যবহৃত হয় দুই মিলিয়নের বেশি ঘনফুট কংক্রিট। সেখানে আশ্রয় নিতে পারত হাজারো সৈন্য। কিন্তু ১৯৩৮ সালে জার্মানির দৃষ্টি ঘুরে যায় পশ্চিমে, ফ্রান্সের দিকে। কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এক বছর পর পোল্যান্ড আক্রান্ত হলে অস্টভালের কৌশলগত গুরুত্বও শেষ হয়ে যায়।

তবু এটি থেকে যায় নাৎসি যুদ্ধযন্ত্রের অংশ হিসেবেই। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়ার লাল ফৌজ মাত্র ৩ দিনে জার্মানির এই প্রতিরক্ষা লাইন দখল করে নেয়। তার আগেই নাৎসিরা ভূগর্ভস্থ শহর ত্যাগ করে। এরপর কয়েক বছর, এই শহর পোলিশ সেনারা ব্যবহার করলেও ষাটের দশকে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সামলানো সম্ভব হয়নি। জায়গাটি আবার ফেলে রাখা হয়।

আজ অস্টভাল নতুন রূপ নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় এবং স্থানীয় উদ্যোগে এটি ডার্ক ট্যুরিজমের অন্যতম কেন্দ্র। ২০১১ সালে মিনেজিরেজ ফোর্টিফায়েড রিজন মিউজিয়াম চালু হয়। প্রায় ১৯ মাইল লম্বা সুড়ঙ্গ ঘুরে দেখার সুযোগ পান পর্যটকেরা।

ছবি: সিএনএন—এর সৌজন্যে
ছবি: সিএনএন—এর সৌজন্যে

বাইরে থেকে প্রবেশদ্বারের বাঙ্কার দেখতে খানিকটা কার্টুনের মতো—সবুজ রঙের মাশরুম-আকৃতির গম্বুজে ঢাকা। ভেতরে ঢুকলেই অন্য এক জগৎ। ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে, তবে আশ্চর্যভাবে বাসযোগ্য। নাৎসিদের উদ্দেশ্যই ছিল সৈন্যদের দীর্ঘদিন এখানে রাখা। তাই সবকিছু পরিকল্পিতভাবে বানানো। ইউনিফর্ম পরা ম্যানিকিন দাঁড়িয়ে আছে কক্ষ আর করিডরে, যেন একসময়কার দৈনন্দিন জীবনের ছবি ভেসে ওঠে চোখে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর মূল শ্যাফট। গভীর খাদ নেমে গেছে মাটির নিচে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে পৌঁছানো যায় প্রশস্ত সুড়ঙ্গে, যেখানে রেললাইন আর পাইপ বিছানো। ১৩০ ফুট নিচে, ট্রেন ও সামরিক যান চলার মতো প্রশস্ত করিডরে দাঁড়ানো অভিজ্ঞতা একই সঙ্গে রোমাঞ্চকর ও ভীতিকর।

এখন এর আসল অধিবাসী বাদুড়। নাৎসিরা চলে যাওয়ার পর এই প্রাণীগুলো সুড়ঙ্গগুলো আবিষ্কার করে। স্থায়ী তাপমাত্রার কারণে জায়গাটি হয়ে ওঠে শীতনিদ্রার আদর্শ আশ্রয়। প্রতিবছর শরৎকালে প্রায় ৪০ হাজার বাদুড় এখানে ভিড় জমায়। ১২ প্রজাতির বাদুড় শীতকালে ঘুমিয়ে থাকে সুড়ঙ্গের অন্ধকারে।

ছবি: সিএনএন—এর সৌজন্যে
ছবি: সিএনএন—এর সৌজন্যে

সত্তরের দশক থেকে বিজ্ঞানীরা তাঁদের উপস্থিতি নথিবদ্ধ করছেন। আজ দর্শনার্থীরা ভেতরে ঢুকলে অন্ধকার থেকে হঠাৎ উড়ে বেরোয় বাদুড়, দেয়ালে ঝুলে ঘুমিয়ে থাকে কেউ কেউ। বাদুড়দের বিশ্রামের জন্য শীতকালে দর্শনার্থীর প্রবেশও সীমিত করা হয়।

কিন্তু বাদুড়রাই একমাত্র নয়, আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত এখানে জন্ম নেয় এক ভিন্ন সাব কালচার—‘বাংকার পিপল’। সুড়ঙ্গের ভেতর তারা বিভিন্ন ‘বিপ্লবী পার্টি’ করেছে, বিয়ে করেছে, কর্তৃপক্ষবিরোধী স্লোগান তুলেছে। তবে এখানে দুর্ঘটনার ইতিহাসও আছে। এ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত পাঁচজন। দেয়ালজুড়ে তাদের রেখে যাওয়া গ্রাফিতি এখনো রঙিন করে রেখেছে ধূসর করিডরগুলো।

ছবি: সিএনএন—এর সৌজন্যে
ছবি: সিএনএন—এর সৌজন্যে

এখন পর্যটকদের জন্য আছে তিন ধরনের ট্যুর—ছোট, বড় আর এক্সট্রিম। চাইলে ভূগর্ভস্থ ইলেকট্রিক ট্রেনে ঘুরে দেখা যায়, এমনকি সোভিয়েত যুগের সাঁজোয়া যানেও চড়ার অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়।

অস্টভাল আজ পোল্যান্ডের লুবুশ অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। তবে এর বাইরেও চমক আছে। আঞ্চলিক রাজধানী জিয়েলোনা গোরা আঙুরখেত আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে পরিচিত ‘পোলিশ টাসকানি’ নামে। প্রতি সেপ্টেম্বর উইনোবরানি ওয়াইন ফেস্টিভ্যালে জমজমাট হয় পুরো শহর। আর শভিয়েবোদজিন শহরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু যিশুখ্রিষ্টের মূর্তি, রিওর বিখ্যাত মূর্তির চেয়ে উঁচু।

অল্প দূরত্বেই এখানে জুড়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা—নাৎসি সুড়ঙ্গের অন্ধকারে নামা, ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাদুড় কলোনি দেখা, যিশু মূর্তির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হওয়া আর দিনের শেষে স্থানীয় ওয়াইনের গ্লাস হাতে নেওয়া।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Developed By ThemesBazar.Com