শতাব্দীর পর শতাব্দী, যুগের পর যুগ ধরে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে, বিস্ময়ে অভিভূত করেছে অসংখ্য স্থান আর স্থাপনা। কোনটি মানুষের তৈরি, কোনটা বা আবার সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক। বহু পুরনো কিংবা অতি সাম্প্রতিক মানুষের তৈরি অনেক স্থাপনাই মানুষকে দিয়েছে চিন্তার খোরাক, বিস্ময়ের প্রণোদনা। ২০০১ সাল থেকে সুইস কর্পোরেশনের নিউ7ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন পৃথিবীর আশ্চর্যজনক স্থান ও স্থাপত্যগুলোকে তালিকাভুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারই প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক জরিপে উঠে আসা সপ্তাশ্চর্যের গল্প জানব আজ।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন। প্রযুক্তি ও নানা দিক দিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে এশিয়ার এই দেশটি। চীনা দেশ ও তাদের সভ্যতার ইতিহাস বেশ পুরনো। সেই পুরনো ইতিহাসের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই স্থাপনা। চীনের প্রথম সম্রাট কিং সি হুয়াং শত্রুর হাত থেকে নিজের সাম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য প্রাচীর নির্মাণ শুরু করেছিলেন প্রায় তিন হাজার বছর আগে। বহু বছরের আর বহু মানুষের শ্রমের ফসল এই প্রাচীর।
বর্তমানে চীনের সীমানা ঘেষে প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার ব্যাপী ছড়িয়ে আছে এই প্রাচীরটি। বিভিন্ন সময় বহু শাসক এর সংস্কার করেন। সর্বশেষ মিং রাজবংশের শাসনামলে (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) ব্যপকভাবে স্নগস্কার করে এই সুদীর্ঘ স্থাপনার।
ব্রাজিলের সাবেক রাজধানী রিও ডি জেনিরো। এই শহরের কর্কোভাদো পাহাড়ের চুড়ায় দুই হাত প্রসারিত করে শহরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে যিশুর মূর্তি। প্রায় ২৪০০ ফুট উচু এই চূড়ায় পৌছানোর উপায় সড়কপথে নয়তো কেবল রেলে চড়ে।
পর্তুগালের কাছ থেকে ব্রাজিলের স্বাধীনতা লাভের প্রথম শতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য ১৯২১ সালে তাকে মূর্তিটি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় ফরাসি ভাস্কর পল ল্যান্ডোস্কিকে। ১৯৩১ সালে শেষ হয় গ্রানাইটের তৈরি এই মূর্তিটির নির্মাণকাজ। পাহাড়, জলাশয় আর শহরের কোলাহলে মোড়া রিও ডি জেনিরো শহরেরই শুধু না, বিশ্বের সবচাইতে দর্শনীয় জায়গাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭০০০ ফুট উপরে আন্দিজ পর্বতশ্রেণীর মধ্যে একটি ছোট পাহাড়ের চূড়া । পেরুর এই পাহাড়ি এলাকায় ১৩০০ শতকের দিকে ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়। এ অঞ্চলেই উপকথার প্রথম ইনকা মাংকো কাপাক কোস্কো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময় এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল এই কোস্কো শহর। এটি পনেরো শতকের দিকে নির্মিত হয়, কিন্তু স্পেন দ্বারা ইনকারা পরাজিত হলে তখন এই অঞ্চল পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে।
কয়েক শত বছর অজ্ঞাত থাকার পর ১৯১১ সালে হাইরাম বিঙহাম নামে এক মার্কিন ঐতিহাসিক এটিকে আবার সমগ্র বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন। শহরটিতে প্রায় ১৪০টি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় আচার পালনের স্থান, উদ্যান, সেচ ব্যবস্থা এবং আবাসিক ভবন। প্রতি বছর বহু পর্যটক প্রাচীন এই শহরে ভিড় করলেও বর্তমানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
‘চিচেন ইতজা’ মেক্সিকোর প্রাচীন এক শহরের কেন্দ্রবিন্দু। প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই শহরটি ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতাব্দীর মাঝে মায়া লোল্যান্ডের উত্তরে গড়ে ওঠে। ১০৫০ সালের মধ্যে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে আঞ্চলিক রাজধানীতে পরিণত হয়।
ইতজা হলো মায়া সভ্যতার সময় গুয়েতেমালার একটি জাতি। এই ইতজাদেরই বসতি ছিলো এই অঞ্চলে। তাদের দেবতা কোয়াটজালকোটলের মন্দির এল ক্যাসিলো, বল কোর্ট ও তার পাশের টেম্পল অব দ্য বিয়ার্ডেড ম্যন, ছাদে ঢাকা টেম্পল অব দ্য ওয়ারিয়রস, ছোট পিরামিড ও বর্গাকার ভবন- সব মিলিয়েই মায়া সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন এই স্থাপনা।
গ্লাডিয়েটর সিনেমা যারা দেখেছি তারা হয়তো এই দৃশ্যের সাথে পরিচিত যেখানে সিংহের সাথে লড়াই করে বাঁচতে হয় বন্দি যোদ্ধাদের। প্রাচীন রোমের রাজা ও অভিজাতদের মনোরঞ্জনের জন্য নির্মিত একটি উন্মুুক্ত থিয়েটারই এই কলোসিয়াম। এখানে গ্লাডিয়েটররা মল্লযুদ্ধ করে রক্তাক্ত হতো আর আমোদিত হতেন অভিজাতরা। ৭২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ভেসপাসিয়ানের সময় এই অনুপম স্থাপত্যটির নির্মাণ শুরু হয়। ৮০ খ্রিস্টাব্দে তার উত্তরসূরি টিতাসের সময় শেষ হয়েছিল এর নির্মাণ।
রোমের সবচেয়ে স্থায়ী এবং পুরাতন নির্দশন হল কলোসিয়াম। ছবিসূত্র- nomadicmatt.com
এই প্রাচীন এম্ফিথিয়েটারটির ধারণক্ষমতা ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার। মধ্যযুগে নানা অনুষ্ঠানের জন্য এই এম্ফিথিয়েটারের ব্যবহার ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে স্থাপনাটি ব্যবহার করা হতো বসতবাড়ি, কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি নানা কাজে। ভূমিকম্প এবং পাথর চোরদের কারণে কলোসিয়ামের অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে আবেদন হারায়নি এতটুকুও।
ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় যমুনার তীরে অবস্থিত এক বিস্ময়কর স্থাপনা এটি। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মুমতাজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে যা সম্পূর্ণ হয়েছিল প্রায় ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। সৌধটির নকশা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, উস্তাদ আহমেদ লাহুরীকে তাজমহলের মূল নকশাকারক হিসেবে ধরা হয়।
মার্বেল পাথরে তৈরি সমাধিসৌধ, সুঊচ্চ মিনার আর সামনের জলশয় ও বাগান- সব মিলিয়ে এক অনাবিল সৌন্দর্যের প্রতীক এই তাজমহল। অসংখ্য শ্রমিকের বহু বছরের শ্রম ও স্থাপত্যবিদ্যা ও শৈল্পিকতার অসামান্য নিদির্শন দেখতে প্রতি বছর লাখো মানুষ আগ্রায় ভিড় করে।
বর্তমান জর্ডানের দক্ষিণ-পশ্চিমের হুর পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। নাবাতিয়ান জাতির রাজধানী ছিলো পেত্রা শহর। এখান দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক রাস্তা গিয়েছিলো। শহরটি মূলত সেই বাণিজ্য পথকে কেন্দ্র করেই বানানো হয়েছিলো। পথের যাত্রীদের নির্ভর করে শহরটি হয়ে উঠেছিলো রমরমা। শহরটির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক গুহা। পাথর কেটে কেটে তৈরি গুহাগুলোই চলাচল করার রাস্তা। গুহার পাশেই রয়েছে কঠিন পাথরের গায়ে নকশা করা সেই প্রাচীন দালানগুলো।
রোমানরা সমুদ্র পথেও বাণিজ্য শুরু করলে পেত্রার জৌলুস কমতে ধ্বংস শুরু হয়। প্রথমে রোমানরা, পরে আরবরা পেত্রার দখল নিতে ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। প্রথম ক্রুসেডে ও তারপরে এক ভুমিকম্পে পেত্রা চুড়ান্তভাবে ধব্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে জোহান লুডিগ বারখাট ১৮১২ সালে এই প্রাচীন নগর আবিষ্কার করলে বিশ্ববাসীর নজরে আসে।