আসছে নতুন বছর। এই নতুন বছরকে ভিন্নভাবে বরণ করে নেয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা। তেমনি একটি উৎসব হলো ‘বৈসাবি’। ‘বৈসাবি’ আসলেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের গানের সুর আর নাচের তালে তালে সবাই মিশে একাকার হয়ে যায়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় গানের সুর আর নূপুরের ছন্দ। চারদিকে বয়ে যায় উৎসবের আমেজ। সব মিলে বৈসাবির রঙে রঙিন হয়ে ওঠে পাহাড়।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় এ উৎসব চলে প্রায় অর্ধ মাসব্যাপী। পার্বত্যাঞ্চলে ১০ ভাষাভাষি ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিজু-সাংগ্রাই-বৈসাবি-বিষু অর্থাৎ বৈসাবির আমেজে রাঙ্গামাটি এখন উৎসবের নগরী। আর প্রায় প্রতিদিন বসে পাহাড়ি পল্লীগুলোতে জমজমাট আসর। উৎসবে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি ছাড়া যোগ দেন দূর দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকরাও। ধর্ম, বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সম্প্রীতির মিলনে পাহাড়ে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। উৎসব মুখর হয়ে ওঠেছে পাহাড়ি জনপদ। আপনি চাইলে সহজেই ঘুরে আসতে পারেন পাহাড়ের প্রাণের উৎসবে।
চাকমারা এ উৎসবকে ‘বিঝু’, ত্রিপুরাদের ভাষায় ‘বৈসুক’, মারমাদের ভাষায় ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যাদের ভাষায় ‘বিসু’ এবং অহমিয়াদের ভাষায় বলা হয় ‘বিহু’। তবে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা- এই তিন নৃগোষ্ঠীর উৎসবের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে পাহাড়িদের এই উৎসবের নামকরণ হয়েছে ‘বৈসাবি’। তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা ‘ফুল বিঝু’, দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিঝু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যা পোজ্যা দিন’ বলে। ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে ‘হারিকুইসুক’ দ্বিতীয় দিনকে ‘বুইসুকমা’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘বিসিকাতাল’ নামে অভিহিত করে থাকে।
বৈসুক : ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় উৎসব বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্রের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন উদযাপন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথম দিনকে তারা বলে ‘বিসিকাতাল’। উৎসবের প্রথম দিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। গৃহপালিত সব প্রাণী ছেড়ে দেওয়া হয় খুব ভোরে। পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ছেলেমেয়েরা। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরয়া’ নৃত্য দল গ্রামের প্রতি ঘরের উঠোনে নৃত্য পরিবেশন করে। প্রতি ঘরের উঠোনে ‘গরয়া’ নৃত্য শেষে শিল্পীদের মুরগির বাচ্চা, চাউল প্রভৃতি দেওয়া হয়। এসব পেয়ে নৃত্যশিল্পীরা গৃহস্থকে আশীর্বাদ করেন। নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরয়া দেবতার পূজা করেন। এই লোকনৃত্যে ১৬ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারেন।
বিঝু : পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা সংখ্যায় বেশি। বিঝু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনূভূতি আর মোহনীয় আবেশ। এই উৎসবে সাড়া পড়ে যায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ‘ফুলবিঝু’। এই দিন বিঝুর ফুল তোলা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। পরে সে ফুল দিন শেষে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিঝুর সময় ছোট ছেলেমেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের সম্ভাষণ করেন এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান-চাল ছিটিয়ে খেতে দেওয়া হয়। এই সময় ঘরে ঘরে রান্না হয় ‘পাজোন’। এটি চাকমাদের বিখ্যাত খাবার। হরেক রকম সবজি দিয়ে রান্না করা হয় এই পাজোন। এই উৎসবে সবার প্রিয় খাবার এটি। ছেলেমেয়েরা ঘিলা খেলা, গুদু (হা-ডু-ডু) খেলায় মেতে ওঠে। তারা আকাশপ্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে। বয়স্করা ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ পান করে। বিঝু উৎসবের সময় কোনো প্রাণী হত্যা করা হয় না। তবে নববর্ষের দিন মজার মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছরই ভালো খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস করে তারা।