উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তানের আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী এরবিল। জাগ্রোস ও তোরোস পাহাড়বেষ্টিত এই অঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। তবে আজ থেকে ৯১ বছর আগে একটি সড়ক তৈরির পর এর প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। ‘হ্যামিল্টন রোড’ নামে সড়কটি বদলে দেয় পুরো কুর্দিস্তানের চিত্র।
এরবিল থেকে ইরান-ইরাক সীমান্ত পর্যন্ত জাগ্রোস পর্বতমালাজুড়ে ১৮৫ কিলোমিটার প্রসারিত এই সড়ক। এটি শুধু পশ্চিম এশিয়ার দর্শনীয় স্থান নয়, প্রকৌশলের সবচেয়ে সাহসী কীর্তিগুলোরও একটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করে ব্রিটিশরা। চার বছর (১৯২৮-১৯৩২) ধরে নির্মাণের পর প্রধান প্রকৌশলী এম হ্যামিল্টনের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়। বৈরী আবহাওয়া, মহামারি ও দাঙ্গার মধ্যে এটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এজন্য হ্যামিল্টন ও তাঁর কর্মীদের বীর মনে করেন কুর্দিরা।
এরবিল থেকে সড়কের ২৭ কিলোমিটার গেলে বনমান গ্রাম। শহর, মল ও মসজিদ পেরিয়ে এসে এই গ্রামে দেখা মেলে খানজাদ দুর্গের। দুর্গটির অবস্থান ইরবিল ও শাকলাওয়ার মধ্যবর্তী সড়কে। ১৬ শতকে রাজকুমারী খানজাদের ভাই মীর সুলাইমান ছোট পাহাড়ে এই দুর্গ তৈরি করেন। আত্মজীবনী ‘রোড থ্রু কুর্দিস্তান’গ্রন্থে খানজাদ দুর্গের কথা বলেছেন হ্যামিল্টন।
উত্তর-পূর্ব দিকে ৪০ কিলোমিটার গেলে শাকলাওয়া। সড়ক নির্মাণকালে এটি ছিল ছোট্ট গ্রাম, আর আজ হ্যামিল্টন রোডের সবচেয়ে বড় শহর। পশ্চিমারা জাগ্রোস পর্বতমালা নিয়ে গবেষণা ও হালগার্ড পর্বত আরোহণ করতে আসেন। হ্যামিল্টন রোড কুর্দিস্তানে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও পর্যটক টানতে সাহায্য করেছে।
মানুষের উচ্চতার সমান উঁচু পাথরের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণের জন্য তিনি কুর্দি, আরব ও ফরাসি শ্রমিকদের নিয়ে দল গড়েন। এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক অ্যাসিরিয়ান খ্রিষ্টান, জরিপকারী বাঙালি হিন্দু ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ছিলেন আর্মেনিয়ান ইহুদি। ইংল্যান্ড থেকে সরঞ্জাম এনে ঘুটঘুটে অন্ধকার পাহাড়ে হারিকেন জ্বালিয়ে হ্যামিল্টন ও ১ হাজার শ্রমিক দিনরাত কাজ করেছিলেন। এ সময় চিতা বাঘের গর্জন শোনা যেত। কয়েক মাস ধরে তীব্র গরম ও ঠান্ডা সহ্য করে গিরিখাতের মধ্যে ছিদ্র ও বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকেন তাঁরা। অবশেষে গিরিখাতের গোলকধাঁধার মধ্যে পথ আবিষ্কার করেন। সেই সঙ্গে তৈরি করেন পাঁচটি নতুন নদী সেতু।
মাউন্ট হালগার্ডের চোমন শহর থেকে সড়কটি প্রশস্ত হয়েছে এবং ঢালু হয়ে আস্তে করে নেমে গেছে। আরও সামনে উঁচু চারণভূমিতে মোটা লেজওয়ালা ভেড়া চরতে দেখা যায়। সড়কটি ভেড়ার মাংস ও চর্বির জন্য কৃষকদের নতুন বাজার নিয়ে এসেছে।
ইরান-ইরাক সীমান্তের কাছে হাজি ওমেরান শহরটি অসম্পূর্ণ মনে হয়। সেখানে ৫ শতাধিক পরিবারের মধ্যে অনেকেই অস্থায়ী বাসিন্দা। তারা তীব্র শীত থেকে বাঁচতে জায়গাটি বেছে নেয়। হাতেগোনা কয়েকজনই মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও তুষারের মধ্যে বসবাসের সাহস রাখে। তবে শীতের ভোগান্তি শেষে বসন্ত, গ্রীষ্ম ও শরতে কুর্দিস্তানের আসল সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়। এসব সময়ে সেখানে গেলে দেখা যাবে, ‘কুর্দি স্বর্গে’ যাওয়ার জন্য হ্যামিল্টন কী দারুণ সড়ক তৈরি করেছেন।
কাজ শেষ হওয়ার পর কুর্দিস্তানের প্রেমে পড়েন হ্যামিল্টন। এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর দলকে বিদায় জানাতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যান। কোনো কথা না বলে তিনি লিখেছিলেন, ‘জনহীন তুষারঘেরা চূড়ার প্রান্ত, চাঁদের পাহাড়ের মতো নিষ্ফলা– এসব ছবি আমার স্মৃতিতে চিরকাল বেঁচে থাকবে।’ সূত্র: বিবিসি।