শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৪:৪২ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

পাল্টে গেছে গ্রামীণ জীবন

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২১

যাদের ছেলেবেলা গ্রামে কেটেছে তাদের মনোজগতে গ্রামীণ জীবনের যে চিত্র গেঁথে আছে তা এক কথায় অপূর্ব আর অসাধারণ। এখনো হৃদয়ে ভেসে ওঠে সাদামাটা সহজ-সরল, নিখাদ জীবনের গল্পগাথা। যেখানে বক্রতার কোনো স্থান নেই। প্রতারণা, ভণ্ডামি আর চাতুরীর প্রবণতা বিরল। জীবন-জীবিকার তাগিদে সেই গ্রামীণ জীবনের পাট চুকিয়ে যারা শহরবাসী হয়েছেন, ডেরা বেঁধেছেন নগরে, তাদের অন্তরে অটুট রয়েছে গ্রামীণ জনপদের অম্ল-মধুর স্মৃতি, মানে নস্টালজিয়া।

উপরে বর্ণিত সব কবিতায় শব্দে নির্মিত শরীরে ছড়িয়ে আছে এক প্রগাঢ় ভালোবাসা, কিন্তু সে ভালোবাসা কোনো নির্বস্তুক বায়বীয় কল্পনাবিলাস নয়। যে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন এ সব কবি, সে বাংলাদেশ শরীরী হয়ে ওঠে শুধু প্রকৃতিতে নয়, ইতিহাসেও। এ কথা ঠিক যে, সেই ইতিহাসের গায়ে আছে উপকথার আবরণ, কখনো বা অতিকথাও, কিন্তু সেই উপকথা, রূপকথা, আর অতিকথার মানুষজন নিয়েই জেগে ওঠে এক বাংলাদেশ, সে বাংলাদেশে নেই কোনো নাগরিক আকাশরেখা, তা শুধু ভরে থাকে আম কাঁঠালের গন্ধে, হিজলের ছায়ায়, সেখানে আজো যেন সপ্তডিঙা মধুকরের যাওয়া আসা। তবে সাহিত্যে যে গ্রামবাংলার যাপিত জীবনের সন্ধান মেলে, খুঁজে পাওয়া যায়, তা বিগত যৌবনা। তার শরীরে ভাটার টান পড়েছে। এমন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নে কারো কারো মন খারাপ করে। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম, নির্দয়। এখানে ভাবাবেগের জায়গা কোথায়?

বৈষয়িক উন্নতির সাথে সাথে জটিল-কুটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে গ্রামের মানুষজনও। নিকট অতীতের ঐতিহ্যগত সরল জীবন সেই ঘূর্ণাবর্তে নিমজ্জমান। হলফ করে বলা যায়, প্রযুক্তির প্রভাব এর জন্য বহুলাংশে দায়ী। তবে এটিই পুরো সত্য নয়। এটি আংশিক সত্য। গোলকায়নের এই যুগে গ্রামীণ জীবনেও আছড়ে পড়েছে বৈশ্বিক ঢেউ। সেই ঢেউয়ের তোড়ে প্রভাবিত গ্রামের মানুষের যাপিত জীবন। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চাওয়া-পাওয়ার প্রকৃতি গেছে বদলে। গত চার দশকের ব্যবধানে চেতনার ভিত্তিভূমি অল্পে তুষ্ট থাকার মানসিকতা, মানে সাদামাটা জীবনে সবার অলক্ষ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তাদের চলন-বলনই তা বলে দেয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও লোপ পেয়েছে সরলতা। উল্টো দানা বেঁধেছে অর্থ উপার্জনের তীব্র বাসনা।

কিন্তু তাদের জানা নেই যে, শুধু কামনা-বাসনা থাকলেই সম্পদ অর্জন সম্ভব নয়। আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে চাই যোগ্যতা-দক্ষতা। সম্পদ কুক্ষিগত করতে সমকালীন যে বিদ্যাবুদ্ধি দরকার; তাতে ঘাটতি রয়েছে তাদের। প্রযুক্তির বদৌলতে অন্যের জৌলুশপূর্ণ যাপিত জীবন দেখে আত্মগ্লানিতে ভোগার এই বোধ ভোঁতা। ইন্টারনেট, ডিশ, স্মার্টফোনের মাধ্যমে যে আড়ম্বরপূর্ণ জীবন দেখে ধাঁধায় পড়েছে তারা, তার অভিঘাতে অবধারিতভাবে নিজেকে বঞ্চিত ভাবাই স্বাভাবিক। না পাওয়ার যাতনায় মনে জন্ম নিয়েছে অন্যের প্রতি ঈর্ষা ও ঘৃণা। ফলে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতা। সেই বিষবাষ্পে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কের বাঁধন। প্রতিক্রিয়ায় গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনকে গ্রাস করছে হিংসার সংস্কৃতি। ফলে জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে হাঙ্গামা। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জনক প্রযুক্তি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রযুক্তি এখানে অভিশাপ হয়ে হাজির। এ থেকে মুক্তি সুদূরপরাহত।

মূলত গ্রামের মানুষ বৈষয়িক যোগ্যতা অর্জন না করেও ভোগী জীবনের প্রত্যাশী। সেই কাক্সিক্ষত ভোগের উপাদান আয়ত্তে আনতে অন্যকে ঠকিয়ে যেনতেনভাবে হাতিয়ে নিতে চায় অর্থ। নীতিনৈতিকতা সেখানে অবান্তর। যেন ফালতু বিষয়। অবশিষ্ট থাকে শুধু আকাক্সক্ষা পূরণের তীব্র বাসনা। অবশ্য এই উপসর্গ গ্রামে অনুপ্রবেশ করেছে লুটেরা অর্থনীতির হাত ধরে। এর জন্য বর্তমান দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিই দায়ী।

রাজনীতির করাল গ্রাসে গ্রামীণ জীবনও বহুধাবিভক্ত। কায়েমি স্বার্থ ঠাণ্ডা মাথায় নিজেদের স্বার্থ টিকানোর পাকাপোক্ত ব্যবস্থায় মত্ত। এতে অবশ্য, গোষ্ঠী স্বার্থ শতভাগ সংরক্ষণ করতে পারছে শাসক শ্রেণী। যাতে সারা দেশে লুটেরা অর্থনীতির সুবিধা ষোলোআনা ঝোলায় তোলা যায়। ভোগে কোনো টান না পড়ে। ফলে গ্রামেও তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক টাউট-বাটপাড় শ্রেণী। গ্রামীণ জনপদে বিষবাষ্প ছড়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। যেহেতু বাংলাদেশ এখনো আক্ষরিক অর্থেই একটি বৃহদায়তন গ্রাম; সেহেতু গ্রামীণ মানুষের চৈতন্যের পরিবর্তন সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের পরিবর্তন। এই পরিবর্তন ইতিবাচক হলে সাদরে গ্রহণ করতে কোনো দোষ নেই। সঙ্কোচেরও কিছু নেই।

কিন্তু পরিবর্তনটা মোটা দাগে নেতিবাচক। ফলে এটি জনমানসের বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। এতে করে আগে যেখানে জমিজমা নিয়ে গ্রামে রক্তারক্তি, হাঙ্গামার ঘটনা ঘটত। চর দখলে লাঠিয়াল বাহিনীর প্রয়োজন পড়ত। এখন তা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক লাঠিয়ালদের দাপটে সবার ত্রাহি অবস্থা। অন্যকে দেখানোর প্রবণতা গ্রামীণ জীবনে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা কালবৈশাখীর গতি পেয়েছে। বিপজ্জনক এ প্রবণতা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ; ঐতিহ্যগত সাদামাটা জীবনে ফেরা। সেই পথে চলার শক্তি জোগাবে শুধু জ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রটির সাধারণীকরণ। সবাই যাতে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ হয় এমন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। কাজটি সহজ নয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com