আর কদিন বাদেই মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। আর ঈদ উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে দীর্ঘ সরকারি ছুটি। যদিও এই ৯ দিনের ছুটির আওতায় পড়ছেন না বেসরকারি কর্মজীবীরা। গতকাল থেকে বেসরকারি খাতের অফিসের ছুটি হয়েছে। এবারও ঈদের বন্ধে অভ্যন্তরীণ পর্যটন ঘিরে ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন নানা প্রস্তুতি। দেশীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় পর্যটকদের সঙ্গে নিরাপত্তাজনিত কিছু অপ্রীতিকর ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এ খাতে। এ ছাড়া দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান পাহাড়ের অনেক স্থানে যাওয়া নিষিদ্ধ রয়েছে। তার পরও এবার পর্যটন ব্যবসায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, এবার আগের চেয়ে পর্যটক বাড়বে। এবার ছুটিও বেশি। এ ছাড়া দেশের পর্যটন এলাকাগুলোর প্রস্তুতিও ভালো। তিনি বলেন, পর্যটন খাতটি দিন দিন বড় হচ্ছে। ফলে কিছু সমস্যা থাকবেই। তার পরও আগের চেয়ে পর্যটকের সংখ্যা বেশি হবে বলে আশা করছি।
পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের বন্ধে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের উপস্থিতি দেখা যাবে কক্সবাজারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এখন পাহাড়ের অনেক পর্যটন স্পট সরকারিভাবে বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে। এই জায়গায় যেসব পর্যটক যেতেন, তারা কক্সবাজার বা সিলেটে যাবেন।
কালবেলার কক্সবাজার প্রতিনিধি এম আর মাহবুব জানিয়েছেন, দেশীয় পর্যটনের রাজধানী কক্সবাজার ঈদ আনন্দে বেড়াতে আসা লাখো পর্যটক বরণ করতে এরই মধ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন চলছে কক্সবাজারের পর্যটন স্পটগুলোর হোটেল-রেস্তোরাঁ সংস্কারের সবশেষ কাজ। ঈদের টানা ছুটি উপলক্ষ করে কক্সবাজারের আবাসিক হোটেলের শতভাগ রুম আগাম বুকিং শেষ। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণপিপাসু মানুষের উপচে পড়া ভিড় হবে ঈদে। হোটেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ভ্রমণের জন্য সমুদ্র শহরকে বেছে নিয়েছে। এতে টানা ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায় ছন্দপতন ঘটেনি। ফলে ব্যবসায়ীরা মহাখুশি।
সূত্র জানায়, বর্তমানে কক্সবাজার শহরের ৫ শতাধিক আবাসিক হোটেল ও কটেজে প্রায় দুই লাখ পর্যটকের রাত যাপনের সুবিধা রয়েছে। এসব হোটেলে ২৫ থেকে ৩০ হাজার পর্যটনকর্মী নিয়োজিত রয়েছেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া মুখপাত্র) মো. জসিম উদ্দিন জানান, কক্সবাজার দেশীয় পর্যটনের রাজধানী হওয়ায় এবার ঈদের ছুটিতে পর্যটক এবং লোকাল মিলিয়ে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ আসবে। ঈদকে সমনে রেখে কক্সবাজারে জনমানুষের নিরাপত্তা বাড়াতে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজির ৫০ সদস্যের একটি টিম ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশের সদস্যের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। কক্সবাজার পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্ঘটনা, ছিনতাই, পর্যটক হয়রানি রুখতে কক্সবাজার পুলিশ বদ্ধপরিকর। তা ছাড়া যেসব সিসি ক্যামেরা অচল হয়ে পড়েছিল, তা সচল করা হয়েছে। বিশেষ করে কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনে সিসি ক্যামেরায় সবকিছু লাইভ চলছে। এরই মধ্যে ছিনতাইকারী, ডাকাত, সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চলমান রয়েছে। অনেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত কক্সবাজার পুলিশ প্রশাসন।
পর্যটক বরণে ব্যবসায়ীরা নানা উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কালবেলার বান্দরবান প্রতিনিধি সৈকত দাশ। তিনি জানান, মেঘলা, নীলগিরি, নীলাচল ও চিম্বুকে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় হতে পারে—এমনটাই আশা ব্যবসায়ীদের। বান্দরবান শহরের নিকটবর্তী ও আলীকদম এলাকার পর্যটন স্পটগুলো এরই মধ্যে খুলে দেওেয়া হয়েছে। তবে আমিয়াখুমসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি স্পট নিরাপত্তাজনিত কারণে বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে কেএনএফ সহিংসতার ঘটনায় বান্দরবানের অন্য দুটি উপজেলা রুমা ও থানচির পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। যার কারণে ওই দুটি উপজেলার পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
বান্দরবান রেসিডেন্সিয়াল হোটেল রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার ঈদের টানা ছুটি উপলক্ষে হোটেল-রিসোর্টগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। ছুটিতে এবার প্রচুর পর্যটক বান্দরবানে আসবে। তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে অনেক পর্যটনস্পট বন্ধ ছিল। এখন ৯০ ভাগ পর্যটনস্পট খোলা আছে। বান্দরবান সদরে ৭০টি হোটেল আছে। এর ধারণক্ষমতা ছয় হাজারেরও অধিক।
টানা ছুটিতে হ্রদ-পাহাড়ের শহর রাঙামাটি ও মেঘের রাজ্য সাজেকে পর্যটক বরণে প্রস্তুত পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে হোটেল-মোটেলে অগ্রিম বুকিং শুরু হয়েছে। মেঘের রাজ্য সাজেকে নতুন সাজসজ্জায় পর্যটকদের জন্য ৯১টি কটেজ-রিসোর্ট ও রাঙামাটি শহরে ৫৪টি আবাসিক হোটেল প্রস্তুত করা হয়েছে।
রাঙামাটি প্রতিনিধি মিশু দে জানান, নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে হোটেল-মোটেল, কটেজ-রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, ট্যুরিস্ট বোটসহ পর্যটন স্পর্টগুলো। এরই মধ্যে আবাসিক হোটেল-মোটেলে বুকিং শুরু হয়েছে। শুধু পর্যটন করপোরেশনের হলিডে কমপ্লেক্সে অগ্রিম বুকিং ৬০ শতাংশ কক্ষ। তেমনি রাঙামাটি শহরের ৫৪টি আবাসিক হোটেলেও শুরু হয়েছে অগ্রিম বুকিং, যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান রাঙামাটি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির কর্তারা।
তবে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি থাকার পরও অগ্রিম বুকিংয়ে ভাটা চলছে মেঘের রাজ্য সাজেকে। সম্প্রতি সাজেকে আগুনে ৩৫টি রিসোর্ট পুড়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা প্রচার হয়েছে দেশ-বিদেশে। এতে পর্যটকদের ধারণায় এসেছে সাজেকের প্রায় সব কটেজ-রিসোর্ট পুড়ে গেছে, যার কারণে টানা ছুটি থাকা সত্ত্বেও অগ্রিম বুকিংয়ের ক্ষেত্রে এবার ভাটা চলছে বলে মনে করছেন সাজেক কটেজ-রিসোর্ট মালিক সমিতির নেতারা।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া জানান, দীর্ঘ এক মাস পর্যটক খরা কাটিয়ে ঈদুল ফিতর সামনে রেখে পর্যটন ব্যবসায় আশার আলো দেখছে পর্যটন সংশ্লষ্টিরা। ঈদের টানা ছুটিতে আলুটিলার রহস্যময় সুড়ঙ্গ, রিছাং ঝরনা, তৈদুছড়া ঝরনা, হেরিটেজ পার্ক, হর্টিকালচার সেন্টারসহ মনোমুগ্ধকর পর্যটন কেন্দ্রগুলো মুখর হয়ে উঠবে হাজার হাজার পর্যটকে। ঈদ সামনে রেখে এরই মধ্যে খাগড়াছড়ির হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলো বুকিং শুরু হয়ে গেছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় পর্যটকদের নিরাপদে ভ্রমণের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ট্যুরিস্ট পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এদিকে, পর্যটক বরণে প্রস্তুত হয়েছে সিলেট ও শ্রীমঙ্গল। ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম পছন্দের জায়গা সিলেট। ঈদে সিলেটের স্পটগুলোয় পর্যটকের ভিড় আশানুরূপ হওয়ার প্রত্যাশা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। বিশেষত, হজরত শাহজালাল ও শাহপরাণ মাজার, চা বাগান, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর, উৎমাছড়া, জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, লালাখালসহ অন্যান্য জনপ্রিয় পর্যটন স্পটে ঈদের ছুটির দিনগুলোয় ভিড় থাকবে। এরই মধ্যে হোটেল-রিসোর্টগুলোর ৮০ শতাংশের বেশি রুম বুকিং হয়েছে বলে জানা গেছে।
জৈন্তা হিলস রিসোর্টের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তোফায়েল আহমদ বলেন, আমার রিসোর্টে ৩০টি রুম রয়েছে। এর মধ্যে কাপল ১৬টি ও ডাবল বা ফ্যামিলি রুম ১৪ আছে। এরই মধ্যে ১৭টি বুকিং হয়েছে, যা গত দুই ঈদের তুলনায় বেশি। এবার পরিবার-পরিজন নিয়ে ভ্রমণের সংখ্যাটা বেশি হবে মনে হয়। তিনি আরও বলেন, ঈদে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য স্পেশাল ছাড় দেওয়া হবে।
পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট সিলেটের অন্যতম ট্রাস্টি আব্দুল করিম কিম কালবেলাকে বলেন, এবারের ঈদ ছুটিতে অসংখ্য পর্যটকের সিলেট আসার সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যাপ্ত আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও পর্যটন এলাকাগুলোয় সড়ক যোগাযোগ আরামপ্রদ নয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো যথাযতভাবে সংস্কার করা হয়নি। যাতায়াত খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে, চায়ের দেশ সিলেটের শ্রীমঙ্গলের পর্যটন ব্যবসায়ীরাও ভালো ব্যবসার আশায় বসে আছেন। হোটেল-রিসোর্টগুলোর ৭০ শতাংশের বেশি বুকিং হয়ে গেছে।
এ ছাড়া এবারের ঈদে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং বাঘ-হরিণের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের সুন্দরবন পর্যটকদের উপস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কালবেলার কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি ফরহাদ হোসেন জানান, কয়রা উপজেলা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণের অন্যতম পর্যটন স্পট হলো সুন্দরবনের শেখেরটেক, কালাবগী ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র, নির্মাণাধীন কেওড়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র, শিবসা নদীর তীরে রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ৪০০ বছর আগের স্থাপনা, নীলকমল, কাটকাটা পর্যটন স্পট পর্যটক বরণে প্রস্তুত। এবার ঈদে টানা ৯ দিনের ছুটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ গতি পাবে বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। লম্বা ছুটিতে ভ্রমণপিপাসুরা যান্ত্রিক শহরের ক্লান্তি একটু দূর করতে ছুটে আসবেন। ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের অন্যতম মিলনমেলা হবে সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার কয়রায়। পর্যটকদের আতিথেয়তার পসরা সাজিয়ে অপেক্ষায় ব্যবসায়ীরা।
সুন্দরবন উপকূল ও সুরক্ষা বলয় কমিটির সভাপতি, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার এম আনোয়ার হোসেন জানান, তারা এবার ঈদে সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ স্টেশন থেকে অনুমতিপত্র (পাস) নিয়ে কেওড়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র ও কাটকাটা লঞ্চঘাট থেকে খুব কম সময়ে এক দিনের জন্য সুন্দরবনের শেখেরটেক, শিবসা নদীর তীরে রাজা প্রতাপদিত্যের প্রচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, গব বাগান, গহিন সুন্দরবনের শেখের খাল, বনের মধ্যে ৪০০ বছরের পুরোনো স্থাপনা ও সুন্দরবনের নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করবেন।
তিনি বলেন, খুলনা জেলা শহর থেকে এসে চুকনগর-পাইকগাছা হয়ে কয়রা থেকে খুব কম সময়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করা যায়। কয়রায় নির্মাণাধীন একমাত্র পর্যটন স্পট কেওড়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রের কাজ শেষ হলে এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের দ্বার উন্মোচিত হবে।
এ ছাড়া ভোলার বিভিন্ন চর, মিরসরাইয়ের বিভিন্ন স্পট, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন স্পটে পর্যটক উপস্থিতি আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।