আকাঁবাকা রাস্তা, পাহাড় ও লেকের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রাঙ্গামাটি জেলা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহর পর্যটকের পদচারণায় প্রায় সব ঋতুতেই মুখরিত থাকে। চারদিকে লেক, বন-বনানী,পাহাড়ে সমুদ্রিত,আঁকাবাকাঁ পথ ও কাপ্তায় হ্রদের অকৃত্তিম বিশালতার সমন্বয়ে গঠিত এই জেলায় তাই প্রতিবছর ভ্রমন পিপাসু মানুষ প্রকৃতির সানিধ্য লাভের আশায় ছুটে আসে। শীতকালে এই সংখ্যা দুই-তিনগুন বেড়ে যায়। প্রকৃতি এখানে যেন তার সব রূপ ও সৌন্দর্য উজার করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জেলা হিসেবে পরিচিত এই জেলাতে রয়েছে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভবনা। প্রাকৃতির এই অপরূপ রূপ তাই হাত-ছানি দেয় ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের।
১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাঙ্গামাটি জেলার মর্যাদা পায়। এই জেলার নাম করণের দিক থেকেও রয়েছে ভিন্ন মত। কেউ কেউ মনে করেন হৃদের পানি প্রবাহের সময় লাল রং দেখায় বলে এই জেলার নাম রাঙ্গামাটি। আবার কেউ কেউ মনে করেন মাটির রং লাল বলে এই জেলার নামকরণ হয়েছে রাঙ্গামাটি।
এই জেলায় পাহাড়ি-বাঙ্গালি মিলিয়ে ১৪ টি জনগোষ্ঠী বাস করে। ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া কর্ণফুলি নদী হচ্ছে রাঙ্গামাটির প্রধান নদী। অঞ্চলটি ৪টি প্রধান পর্বতমালা বেষ্টিত। কৃষিজাত পণ্যে রাঙ্গামাটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রধান ফসল কাঠ, কলা, বাঁশ, আনারস,পেঁপে,কমলা,আম সহ নানান কৃষি ও ফলজ ফসল এখানকার অর্থকরী ফসল। এছাড়াও ক্ষুদ্্র-নৃগোষ্ঠীর আপন ঐতিহ্যগত জুম চাষ পদ্ধতি নানান ধরণের কৃষি জাত পন্য উৎপন্ন হয়।
রাঙ্গামাটি জেলার অন্যতম আর্কষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, দেশের প্রথম পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র (কাপ্তায়-রাঙ্গামাটির হ্রদ), সুবলং ঝর্ণা, বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধিস্থল। রাজবনবিহার (বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান ), কাপ্তায় রাঙ্গামাটির ২০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, চারিদিকে হ্রদ বা লেক বেষ্টিত রাঙ্গামাটির আরেকটি স্থান হল আরণ্যক রিসোর্ট, পলওয়েল পার্ক, সংক্ষিপ্ত সময় কাটানোর জন্য আসামবস্তি ব্রিজ সহ রয়েছে ছোট ছোট অনেক পর্যটন কেন্দ্র।
ঝুলন্ত সেতুঃ রাঙ্গামাটি শহরের শেষ প্রান্তে কর্ণফুলি হৃদের উপরে রয়েছে ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতু। হ্রদের দুই পাশের দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করে ঝুলন্ত সেতু দাড়িয়ে আছে। এটি সিম্বল অব রাঙ্গামাটি হিসেবেও পরিচিত পেয়েছে।
সুবলং ঝর্ণাঃ সুবলং ঝর্ণা রাঙ্গামাটি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে বরকল উপজেলায় অবস্থিত। দেশের সবচেয়ে উঁচু ঝর্ণা হিসেবে পরিচিত সুবলং ঝর্ণা বর্ষায় তার প্রাণ ফিরে পায়। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে নেমে আসা পানির পর্যটকদের ভীষণ ভাবে আকর্ষন করে। নৌ পথে যেতে প্রায় সময় লাগে এক ঘন্টা।
মুন্সি আব্দুল রউফের সমাধিঃ মূল শহর থেকে নৌ পথে ১৫ কিলোমিটার দূরে স্বচ্ছজ্বলরাশি দ্বারা বেশিষ্ট ছোট দ্বীপ বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধি। এর চারদিকের প্রকৃতিক পরিবেশ পর্যটকদের বিমোহিত করে।
কাপ্তাই হ্রদঃ কাপ্তাই হ্রদ বা লেক বাংলাদেশের এমনকি দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার বৃহৎতম মনুষ্যসৃষ্ট সাদু পানির হ্রদ। এটি প্রধানত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৃষ্টি হলেও এই জলাধারে প্রচুর পরিমানে মিঠা পানির মাছ চাষ হয়। চাষকৃত মাছ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয়।
আরণ্যক রিসোর্টঃ সেনাবাহিনী কতৃক নির্মিত হলেও এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। লেক আর পাহাড়ের অপরূপ সন্ময়ে গড়ে ওঠা এই রিসোর্ট পর্যটকদের ভিন্ন বিনোদন মাধ্যম।
পলওয়েল পার্কঃ বাংলাদেশ পুলিশবাহিনী নির্মিত পলওয়েল পার্ক ইদানীং ব্যাপক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
রাঙ্গামাটিতে যাতায়াতের ব্যবস্থাঃ ঢাকার কল্যানপুর,সায়দাবাদ থেকে সরাসরি রাঙ্গামাটির গাড়ি পাবেন। নন-এসির বর্তমান ভাড়া ৭৫০ টাকা। হানিফ, শ্যামলী, ইউনিক,ডলফিন সহ অন্যান্য যেকোন গাড়ি পেয়ে যাবেন খুব সহজেই। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় ও বড় দীঘির পার থেকে পাহাড়িকা গাড়িতে করেও আসতে পারেন রাঙ্গামাটিতে। চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটির গাড়ি ভাড়া ১৪০ টাকা।
রাঙ্গামাটির কোথায় কিভাবে থাকবেনঃ থাকার জন্য রাঙ্গামাটিতে রয়েছে বিভিন্ন ছোট বড় হোটেল ও কটেজ। বনরূপা, দোয়েল চত্বর, তবলছড়ি ও রিজার্ভ বাজারে এসব হোটেল পেয়ে যাবেন। যাওয়ার আগে বুকিং বা যাওয়ার পরে সরাসরিও এসব হোটেলে উঠতে পারেন। সাপ্তাহিক বা সরকারি ছুটির দিনে ভ্রমণের আগে নিজের পছন্দ অনুযায়ী অবশ্যই বুকিং নিশ্চিত করুন। কারণ বাড়টি পর্যটকের চাপে পছন্দের রুম না পেলে আনন্দ ভ্রমণে বিষাদের ছাপ নেমে আসতে পারে।
রাঙ্গামাটির ভিন্ন ধরণের পণ্যঃ রাঙ্গামাটিতে আসলে আপনি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ পাবেন। জেলার তবলছড়ির টেক্সটাইল মার্কেটে খুব সুলভ মূল্যে পেয়ে যেতে পারেন হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি, বিভিন্ন ঐতিহ্যগত পণ্য, অলংকার, বার্মিচ আচার আর ভ্রমণ স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য নিজের পছন্দের কিছু পণ্য।
প্রকৃতির কোমল পরশে সজীব হয়ে ওঠা অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য হাজার হাজার পর্যটকের পদচারণায় প্রতিবছর মুখরিত হয়ে ওঠে রাঙ্গামাটি। সৌন্দর্যের এক অপরূপ লিলাভূমি হিসেবে রাঙ্গামাটির পার্বত্য জেলা এখনো দূষনমুক্ত। পরিবেশ দূষনের এই ভয়াভয় সময়ে রাঙ্গামাটি একটি পরিবেশ বান্ধব শহর। নৈর্সগিক পার্বত্য এই অঞ্চল আছে বলেই সমতল ও পাহাড়ের বৈচিত্র বোঝা যায়। আর বৈচিত্রময় এই জেলার কারণে বাংলাদেশের সৌন্দর্র্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা যায়। তাই দেশকে জানুন, বেশি বেশি ভ্রমণ করুন ও দেশের পর্যটনখাতকে সমৃদ্ধ করুন।