এ বছরের প্রথমার্ধে অনলাইন ভ্রমণ প্ল্যাটফর্ম ‘আগোরা’র এক জরিপে দেখা গেছে, জাপান ও থাইল্যান্ডের পরে এশিয়ায় বেশি ‘রিপিট ভিজিটর’ পায় ভিয়েতনাম।
ভিসা নীতিই কি এনেছে পরিবর্তন
২০২৩ সালের আগস্টে ভিয়েতনাম পর্যটন ভিসার মেয়াদ ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৯০ দিন করেছে। সেই সঙ্গে দিয়েছে একাধিকবার প্রবেশের অনুমতি। ২০২৪ সালের মার্চে দেশটির সরকার ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, নরওয়ে, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সুইডেন ও যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জন্য ২০২৮ সাল পর্যন্ত ভিসা ছাড়ের ঘোষণা দেয়। আগস্টে আরও ১২টি ইউরোপীয় দেশের নাগরিকদের জন্য ৪৫ দিনের জন্য ভিসা ছাড় চালু হয়।
পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিয়েতনামে বারবার পর্যটক আসার অন্যতম কারণ হলো গত কয়েক বছরে করা ব্যাপক ভিসা সংস্কার। দেশটির একতরফা ভিসা ছাড় পাওয়া দেশের সংখ্যা পৌঁছেছে ৩৯টিতে। এ ছাড়া আসিয়ানের সদস্যদেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ভিসা ছাড়ও বিদ্যমান রয়েছে। ভিয়েতনামের বিলাসবহুল হোটেল চেইন দ্য আনাম গ্রুপের কমার্শিয়াল ডিরেক্টর মার্টিন কেয়ারনার এমনটাই বলেছেন ইভিএন এক্সপ্রেসকে। তিনি বলেন, ভিসা ছাড় দেওয়ার বিষয়টি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। অর্থাৎ সরকার বিদেশি পর্যটকদের স্বাগত জানাতে আগ্রহী এবং তাদের যাত্রাকে আরও সহজ ও আরামদায়ক করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পর্যটন অবকাঠামোর উন্নয়ন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভিয়েতনাম সরকার বিমানবন্দর টার্মিনাল সম্প্রসারণ ও সংস্কারের কাজ করেছে। হ্যানয়, হো চি মিন সিটি ও দা নাংয়ের মতো শহরে রাতের বিনোদন জোন চালু হওয়ায় বাড়তে থাকা পর্যটকের চাহিদা পূরণ করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শহরগুলোতে দেখা মিলছে আধুনিক স্কাইস্ক্র্যাপার, উন্নত বিমানবন্দর, রাতের বিনোদন এলাকা। এই বিষয়গুলো বিদেশি পর্যটকদের জন্য তৈরি করেছে আরও আকর্ষণীয় পরিবেশ।
সাশ্রয়ী ব্যয়
ভিয়েতনামে বারবার আসার অন্যতম বড় কারণ সাশ্রয়ী ব্যয়। এখানে পাওয়া যায় সাশ্রয়ী খরচে বিলাসবহুল অভিজ্ঞতা। আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি ভিয়েতনামের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের প্রভাষক ড. হেইজিন পার্ক বলেন, ‘ভিয়েতনামের ফাইভ স্টার হোটেল ও রিসোর্টে থাকার খরচ সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা সিউলের তুলনায় অনেক কম, অথচ সেবার মান প্রায় একই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে খাবার, যাতায়াত ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের দৈনন্দিন খরচও অনেক কম। এ বিষয়গুলো দেশটিকে শুধু বিলাসী পর্যটকদের জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি ভ্রমণকারী এবং বাজেট-সচেতন পর্যটকদের জন্যও উপযোগী করে তুলেছে।’
অন্যান্য দেশের তুলনায় ভিয়েতনামে থাকার খরচ, যাতায়াত, খাবার ও বিনোদনের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কম; বিশেষ করে যাঁরা সীমিত বাজেটে ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের জন্য ভিয়েতনাম হতে পারে এক আদর্শ গন্তব্য।
অতিথিপরায়ণ ভিয়েতনামের জনগণ
প্রাকৃতিক দৃশ্য, ঐতিহাসিক স্থান আর সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ ভিয়েতনামের মানুষের কারণেই পর্যটকেরা বারবার ফিরে যায় দেশটিতে। ভিয়েতনামিরা বিদেশি পর্যটকদের সব সময় হাসি আর উষ্ণতা দিয়ে স্বাগত জানায়। তারা প্রায়ই পর্যটকদের নিজ বাড়িতে খাবার ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়িত করে। এই খোলামেলা মনোভাব ও বর্ধিত পরিবারভিত্তিক সংস্কৃতি দেশটিকে করে তুলেছে উষ্ণ ও মানবিক অভিজ্ঞতার দেশ। এসব স্মৃতি ভ্রমণকারীদের হৃদয়ে দীর্ঘদিন গেঁথে থাকে। ফলে পর্যটকেরা ঠকে যাওয়ার যে সামান্য ঘটনার মুখোমুখি হয়, তা ভুলে যায় দ্রুতই।
স্ট্রিট ফুড
ভিয়েতনামের স্ট্রিট ফুডের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাজা উপাদান, সুগন্ধি মসলা ও নানা হার্ব দিয়ে তৈরি করা হয় দেশটির বিখ্যাত ফো, বান মি, গোই কুয়োনসহ জনপ্রিয় অনেক খাবার। একবারের সফরে সবকিছু চেখে দেখা প্রায় অসম্ভব। এ কারণে অনেকে কেবল খাবারের টানে বারবার ফিরে যায় ভিয়েতনামে।
তবু আছে সীমাবদ্ধতা
জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পাশাপাশি পর্যটন বিশেষজ্ঞরা ভিয়েতনামের সীমাবদ্ধতার কথাও মনে করিয়ে দেন। তাঁদের মতে, উন্নয়নের কিছু দিক এখনো বাকি। বিদেশি পর্যটক টানতে হলে ভিয়েতনামকে কিছু মূল সমস্যার সমাধান করতে হবে। এগুলোর মধ্যে আছে সেবার মানে স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে ড. পার্ক বলেন, স্বল্প মেয়াদে পরিষেবার মান, স্বাস্থ্যবিধি ও পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ালে ভালো ফল আসবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে একটি জাতীয় পর্যটন কৌশল তৈরি করা জরুরি। পরিবহনব্যবস্থার দুর্বলতা, স্বাস্থ্যবিধি ও শহরের পরিচ্ছন্নতার ঘাটতির দিকে বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। একজন পর্যটক যেন তার আগমন থেকে প্রস্থান পর্যন্ত ভ্রমণজুড়ে আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
উন্নয়ন সব দেশে একবারে হয় না। ভিয়েতনাম সে বিষয়ে চেষ্টা করে চলেছে। দেশটি কত দ্রুত নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে, সেটাই এখন দেখার।
সূত্র: ইভিএন এক্সপ্রেস, আই ট্যুর