দিনে দিনে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। প্রায়ই আঘাত হানছে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাতে প্রতিবছর ক্ষয়ক্ষতিও কম হচ্ছে না। প্রকৃতির এই রণমূর্তির জন্য মানুষকেই বেশি দুষছেন বিজ্ঞানীরা। বলছেন, মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের জেরে আজ পরিবেশ ও জলবায়ুর এই নাজুক দশা। এই সংকট কাটাতে নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ব। যেমন পরিবেশের দুর্গতি কমাতে উড়োজাহাজের বদলে এখন ট্রেনে যাতায়াতের দিকে ঝুঁকছে ইউরোপের দেশগুলো।
ইউরোপের নির্ঝঞ্ঝাট ট্রেনযাত্রার বিরাট সুনাম। উড়োজাহাজের চেয়ে ট্রেনে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্বনের নিঃসরণও কম। তাই ট্রেন ব্যবহারে আরও উৎসাহী হচ্ছে ইউরোপ। বিভিন্ন বিমান পরিবহন সংস্থা থেকেও ইতিবাচক সাড়া এসেছে। যেমন নেদারল্যান্ডসের কেএলএমের মতো কয়েকটি উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠান ট্রেনে যাত্রী পরিবহনের ব্যবসায় ঝুঁকছে। আর দেশের ভেতরে যেসব শহরে ট্রেনে যাতায়াত করা যায়, এমন কয়েকটি যাত্রাপথে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধের চেষ্টা করছে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া।
প্রশ্ন উঠবে, কেবল উড়োজাহাজ থেকে কতটুকুই–বা আর ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ হয়? সারা বিশ্বে নিঃসৃত কার্বনের প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ আসে উড়োজাহাজ থেকে। আপাতদৃষ্টে মনে হবে বেশ কম। কিন্তু কার্বনের পাশাপাশি উড়োজাহাজ থেকে ক্ষতিকর আরও নানা গ্যাস বেরোয়, জলবায়ুতে যার বড় প্রভাব আছে।
আরেকটি আশঙ্কা জাগানো পরিসংখ্যান তুলে ধরা যাক। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপে প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে উড়োজাহাজ থেকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের ফলে এই হার অনেকটা কমে গেলেও, আবারও তা বাড়তে শুরু করেছে। মনে করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কার্বন নিঃসরণকারী উৎসগুলোর একটি হবে উড়োজাহাজ।
ইউরোপে স্বল্প দূরত্বে উড়োজাহাজের বদলে ট্রেনে যাত্রা শুরুর এই পথচলা শুরু ‘ফ্লাইট শেম’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলনের লক্ষ্য কার্বন নিঃসরণকারী উড়োজাহাজের চলাচল কমিয়ে আনা। আর বিকল্প হিসেবে ট্রেন, বাস বা জাহাজে যাতায়াতে মানুষকে উৎসাহিত করা। তবে এই আন্দোলনের হাত ধরে শিগগিরই যেসব জায়গায় বদল চলে আসবে, এমন কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন ফ্রান্সে চলতি বছরে একটি আইন করা হয়েছে। ফ্রান্স সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরিবেশ রক্ষায় দেশটির ভেতরে স্বল্প দূরত্বের আটটি যাত্রাপথে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর বদলে চলবে ট্রেন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মনীতির কারণে আইনটির তেমন একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না
ফ্রান্সের আইনটি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্দেশনা দেয়, দুটি শহরের মধ্যে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করার আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে যাতে ট্রেনে করে দুটি শহরের মধ্যে আড়াই ঘণ্টার ভেতরে যাওয়া যায়। এ ছাড়া ট্রেন চলাচলের সময়সূচি এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন যাত্রীরা তাঁদের গন্তব্যে অন্তত আট ঘণ্টা অবস্থানের সুযোগ পান। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই নির্দেশনার ফলে দেখা গেছে, আটটির মধ্যে মাত্র তিনটি যাত্রাপথে উড়োজাহাজ বন্ধের সুযোগ পাবে ফ্রান্স। অবশ্য ২০২০ সাল থেকেই ওই সব যাত্রাপথে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল।
উড়োজাহাজ থেকে ট্রেনের দিকে শুধু ফ্রান্সই মুখ ফেরাচ্ছে, এমন নয়। ২০২০ সালে একই পথে চলতে শুরু করেছে অস্ট্রিয়া সরকারও। দেশটির সরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইনসকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, ট্রেনে করে যেসব স্থানে তিন ঘণ্টার কম সময়ে যাওয়া যায়, সেই পথে তারা ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে না। একই বছরে ৩৫০ কিলোমিটারের কম যাত্রাপথের সব ফ্লাইটে ৩০ ইউরো করে কর আরোপ করা হয়।
ইউরোপের অন্যান্য দেশও স্বল্প দূরত্বে যাত্রাপথে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধের কথা ভাবছে। যেমন যেসব যাত্রাপথে আড়াই ঘণ্টার কম সময়ে ট্রেনে যাতায়াত করা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ সেসব পথে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধের পরিকল্পনা করছে স্পেন।
তবে শুধু স্বল্পপাল্লার উড়োজাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা পরিবেশ সুরক্ষায় কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২২ সালে ইউরোপিয়ান রিজিওনাল এয়ারলাইনস অ্যাসোসিয়েশনের (ইআরএ) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০০ কিলোমিটারের কম যাত্রাপথে যদি উড়োজাহাজের বদলে অন্য কোনো যানবাহন ব্যবহার করা হয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে কার্বন নিঃসরণ মাত্র ৫ শতাংশ কমবে। কারণ, স্বল্পপাল্লার চেয়ে দূরপাল্লার উড়োজাহাজগুলো বেশি কার্বন নিঃসরণ করে।
সম্প্রতি এ নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপোর্ট জিওগ্রাফি নামের একটি সাময়িক পত্র। সেখানে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ৫০০ কিলোমিটারের কম যাত্রাপথে চলাচল করে ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ ফ্লাইট। সেগুলো মাত্র ৫ দশমিক ৯ শতাংশ জ্বালানি খরচ করে। অন্যদিকে ৪ হাজারের বেশি কিলোমিটার যাত্রাপথে চলে ৬ দশমিক ২ শতাংশ উড়োজাহাজ। সেগুলো ৪৭ শতাংশ জ্বালানি পোড়ায়।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবান্ধব যানবাহনের পক্ষে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (টিঅ্যান্ডই) বেসামরিক উড়োজাহাজবিষয়ক পরিচালক জো ডারডিনি। তাঁর ভাষ্যমতে, দূরপাল্লার উড়োজাহাজ কার্বনের বড় উৎস। তবে ইউরোপের সরকারগুলো বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত সমস্যা থেকে নজর সরাতে উড়োজাহাজ চলাচলের নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করা উচিত নয়।