বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৯ অপরাহ্ন

নেই দালাল, নেই ঘুষ: পাসপোর্ট অফিসের নতুন অধ্যায়ের শুরু

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪
কিছু মাস আগেও পাসপোর্ট অফিসগুলোতে ঘুষ এবং দালালের উপস্থিতি সাধারণ ঘটনা ছিল। দ্রুত সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প ছিল না।

ঢাকার আগারগাঁওয়ে ডিভিশনাল পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে এসে চমকে যান নুর মোহাম্মদ। প্রবাসী এই ব্যক্তির জন্য এটি ছিল একটি অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা, কারণ সেখানে কোনও দালালের মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে।

নুরের মতোই অফিসের বাইরে অপেক্ষা কক্ষে বসে বেশিরভাগ সেবাগ্রহীতা সময় কাটাচ্ছিলেন, কেউ সঙ্গীদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন, আবার কেউ স্মার্টফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেখছিলেন।

অফিসের নিচতলায় সেবাগ্রহীতারা তাদের পাসপোর্ট জমা দেওয়া বা গ্রহণ করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অফিসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আনসার বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত নুর মোহাম্মদ বর্তমানে বাংলাদেশে ছুটিতে এসেছেন এবং পাসপোর্ট নবায়নের জন্য অফিসে আসেন। এটি তার জন্য একটি স্বস্তির মুহূর্ত ছিল। কারণ তিনি কোনো দালালের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি সেবা পেয়েছেন।

নুর মোহাম্মদ এবার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে এসে তার পুরনো অভিজ্ঞতার বিপরীতে, এবার নির্ধারিত সময়ের আগেই তার শেষ করেছেন। এবং এর জন্য তাকে কোনো অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়নি।

তিনি বলেন, “শেষবার আমি এখানে এসেছিলাম প্রায় পাঁচ বছর আগে। সেবা পেতে তখন আমাকে একজন দালালকে ‘স্পিড মানি’ দিতে হয়েছিল।”

কিছু মাস আগেও পাসপোর্ট অফিসগুলোতে ঘুষ এবং দালালের উপস্থিতি সাধারণ ঘটনা ছিল। দ্রুত সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প ছিল না। দেশে মোট ৭২টি পাসপোর্ট অফিস রয়েছে, যার মধ্যে ৬২টি আঞ্চলিক অফিস।

তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক সেবাগ্রহীতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করেছেন, পাসপোর্ট অফিসগুলোর সেবা অনেক পরিবর্তিত হয়েছে এবং বর্তমানে পরিস্থিতি অনেক ভাল হয়েছে।

কিছু মাস আগেও পাসপোর্ট অফিসগুলোতে ঘুষ এবং দালালের উপস্থিতি সাধারণ ঘটনা ছিল। ছবি: টিবিএস

মিরপুরের বাসিন্দা রিফাত (ছদ্মনাম) তার মায়ের সাথে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট নবায়ন করতে আসেন। “পাসপোর্ট পাওয়ার নির্ধারিত তারিখ ছিল ৯ ডিসেম্বর। তবে আমি সেটা তার দুই সপ্তাহেরও আগেই পেয়ে গেছি, কিছুই কোনো অতিরিক্ত টাকা না দিয়েই,” তিনি বলেন। তবে তার কোনো অভিযোগ না থাকলেও তিনি জানান, অফিসের কর্মকর্তাদের আচরণ তার মায়ের কাছে কিছুটা “অসংবেদনশীল” মনে হয়েছে।

অন্য এক সেবাগ্রহীতা আবু নায়েম বলেন, তিনি কোনো দেরি বা ঘুষ ছাড়াই সেবা পেয়েছেন। তিনি বলেন, “এটা আমার দ্বিতীয়বারের মতো এখানে আসা। প্রথমবার যখন এসেছিলাম, তখন অনেক দালাল আমাকে তাদের সেবা নেওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম, যতই ঝামেলা হোক না কেন, আমি তাদের সেবা গ্রহণ করব না।” তিনি আরো জানান, “এইবার কোনো দালাল ছিল না এবং পুরো প্রক্রিয়াতে কোনো ঝামেলা ছিল না।”

আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আহমেদ আশিকুর রহমান বলেন, “আমরা ঘনিষ্ঠভাবে পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করি, যাতে কোনো প্রতারক বা দালাল প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে থাকা মানুষের ক্ষতি করতে না পারে।”

তিনি অফিসের বাইরে দালালের কার্যকলাপের সিসিটিভি ফুটেজ দেখালেন, যেখানে একজন দালাল লোকজনকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছিল। পরবর্তী ফুটেজে দেখা যায়, ওই দালালকে আনসার বাহিনী একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে এবং পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

তবে তিনি জানান, কিছু জটিলতা এখনও রয়ে গেছে।

মতিউর রহমান (ছদ্মনাম) পাসপোর্টে সংশোধনীর জন্য গিয়েছিলেন। তাকে জানানো হয়, সংশোধনীর জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স লাগবে। তার অভিযোগ- তার গ্রামের বাড়ি জামালপুর থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে তাকে সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং ঢাকায় তিনি যে এলাকায় থাকেন, সেখানকার থানায় আরও তিন হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল।

তবে তার ডকুমেন্টগুলো (নথি) ফেরত আসার পর পাসপোর্ট অফিস জানায়, তারা এখনও জামালপুর ক্লিয়ারেন্সের তথ্য পায়নি। “আমি জামালপুরের পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেন, তিনি ক্লিয়ারেন্স পাঠিয়ে দিয়েছেন,” মতিউর বলেন।

তিনি আরও বলেন, “অবশেষে, আমি একজন দালালের কাছে গিয়েছিলাম এ সমস্যার সমাধানের জন্য। তাকে আরও পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলাম এবং আবার অফিসে এসে আপডেট নিয়েছিলাম। কিন্তু উত্তর আগের মতোই ছিল।”

তবে এখনো কিছু দালাল কাজ করছেন এবং সাধারণত নিম্ন আয়ের বা অশিক্ষিত মানুষদের লক্ষ্য বানান। অন্যদিকে, যারা সাধারণত শিক্ষিত বা উচ্চবিত্ত, তারা দালালদের দ্বারা তেমন প্রভাবিত হন না।

আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, “আমরা এই অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য একটি ছোট টিম। অফিস সময়ের মধ্যে আমাদের নানা কাজের চাপে থাকলেও, আমরা যতটুকু সম্ভব প্রতারণামূলক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি। গত কয়েক মাসে আমরা বেশ কয়েকজন প্রতারক ও দালালকে চিহ্নিত করে পুলিশে সোপর্দ করেছি।”

পাসপোর্ট আবেদন ও যাচাইকরণ প্রক্রিয়া এখনও জটিল

কাগজে ই-পাসপোর্টের আবেদন প্রক্রিয়া বেশ সহজ মনে হলেও, বাস্তবে অনেকেই নানা জটিলতার মুখোমুখি হন। প্রয়োজনীয় সব তথ্য অনলাইনে পূরণ করার পর, আবেদনকারীকে নির্ধারিত তারিখে সব কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয় এবং ফি পরিশোধ করতে হয়।

তারপর নির্ধারিত দিনে পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয়। সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়– অনলাইন আবেদনপত্রের কপি, পেমেন্ট রসিদ, বাসস্থানের বিদ্যুৎ, গ্যাস বা ওয়াসা বিলের কপি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং পুরোনো পাসপোর্ট (যদি থাকে)। আসল কাগজপত্রও সঙ্গে নিতে হয়। এরপর পাসপোর্ট কর্মকর্তা ছবি, আঙুলের ছাপ এবং চোখের স্ক্যান নিবেন এবং একটি রসিদ দেবেন, যেখানে পাসপোর্ট সংগ্রহের তারিখ উল্লেখ থাকবে। এসএমএস বা ইমেইলের মাধ্যমে অবহিত হওয়ার পর, রসিদ দেখিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করা যাবে।

তবে অনেকে অভিযোগ করেছেন, অনলাইনে আবেদন করার সময় যেসব কাগজপত্রের কথা বলা হয়েছিল, তা ছাড়া আরও কিছু কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে, যেগুলোর কোনো উল্লেখ ছিল না। অনেকেই পুরো প্রক্রিয়াতে প্রশাসনিক জটিলতা ও দ্বৈততার জন্য ফেঁসে গেছেন।

নিজের ১০ বছর বয়সী ভাতিজার পাসপোর্ট নবায়ন করতে আসা এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ও বাবা-মায়ের স্বাক্ষর থাকা সত্ত্বেও কর্মকর্তারা তাকে আবার মা-বাবাকে নিয়ে আসতে বলেছেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আমি তো আগে সব কাগজপত্র জমা দিয়েছি। তারা প্রথমবার পাসপোর্ট তৈরি করার সময় উপস্থিত ছিল। এবার কেন তাদের আবার উপস্থিত হতে বলছে?”

কিন্তু সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান এটির সাথে একমত হননি। তিনি বলেন, “নিয়ম থাকার কারণেই এমনতা হয়েছে। এবং আমরা প্রথমে এগুলো তৈরি করি না। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে সেবা দিতে হয়। তাই যারা সেবা নিচ্ছেন, ধৈর্য ধরে নিয়ম মেনে চলতে হবে।”

যদিও পাসপোর্ট অফিসে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, তবে এখনও কিছু জটিলতা রয়ে গেছে, যেটি অনেকের জন্য সমস্যা তৈরি করছে। এর মধ্যে একটি সমস্যাজন বিষয় হলো পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স অনেক সময় খুব দীর্ঘ সময় নেয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ কর্মকর্তাদের “স্পিড মানি” দিতে হয় ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা হাসান সামির বলেন, “আমি কোনো অতিরিক্ত টাকা বা দালালের সাহায্য ছাড়াই পাসপোর্ট পেয়েছি। তবে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিতে অনেক বেশি সময় লেগেছে, যার ফলে কয়েকদিন দেরি হয়েছে।”

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com