শীতকালে ভ্রমণ মানেই যেন সমুদ্র। হালকা শীতল আবহাওয়া, সমুদ্রের শান্ত ঢেউ আর মৃদু গর্জন সে তো বিশ্রাম আর শান্তির আরেক নাম। আমাদের দেশে শীত ঋতুটা আসে ছুটির সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। স্কুল-কলেজ বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়েও থাকে শীতকালীন ছুটি। জানুয়ারির এই সময়টাতেও ছুটির সে আমেজ কাটেনি। তাই পরিবার নিয়ে অথবা বন্ধুরা সবাই মিলে ঘুরে আসতে পারেন সেন্ট মার্টিন। সমুদ্রের এই নীল একবার দেখলে আজীবন চোখে লেগে থাকবে তার মায়া।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝে অসংখ্য প্রবাল রাশি মিলে মিশে একাকার হয়ে তৈরি করেছে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। টেকনাফ থেকে নাফ নদী পেরিয়ে জাহাজ যখনি সমুদ্রে প্রবেশ করবে আপনি হারিয়ে যাবেন নীলের এক অসীম আবেশে। দ্বীপের যত কাছে যেতে থাকবেন আপনি, তত মনে হতে থাকবে ‘কখন নামব, কখন ছুটে যাব সমুদ্রের জলে!’ তবে সেন্টমার্টিনে এমন দৌড় দিলে ভুলই হবে আপনার। যেমন আছে চোরাবালির ভয় তেমনি আছে অসংখ্য কোরাল। তাই সাবধানে এগোনোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
সেন্টমার্টিন ভ্রমণকারী বেশীরভাগ মানুষই মূলত আসেন কক্সবাজারে বেড়াতে। সেখান থেকে সেন্ট মার্টিনে এসে মাত্র ৩ ঘন্টা বেড়িয়ে ফিরে যান আবার। সেন্ট মার্টিনে জাহাজ আসে ১২টায়, আবার সেই জাহাজ ফেরে ৩টায়। স্বল্প সময়ের এমন ভ্রমণে চেনা যাবে না এই দ্বীপকে। কারণ নারকেল জিঞ্জিরার আসল সৌন্দর্য্য ফুটে ওঠে বিকেলে। ৩টার জাহাজে আপনি যখন ছেড়ে যাচ্ছেন দ্বীপ তখনই নীল রঙ ধরেছে সমুদ্র। সেই রঙ আরও গাঢ় হচ্ছে, হচ্ছে আরও সুন্দর।
সমুদ্রকে পরিপূর্ণরূপে উপভোগ করতে অন্তত ২টি দিন থাকুন। ছোট্ট এই দ্বীপটি আপনাকে ভরিয়ে রাখবে মজার মজার সব অভিজ্ঞতায়। এখানে সবচেয়ে মজার বিষয় হল, জায়গাটি যেহেতু মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা আর কম পর্যটকেরাই রাত্রিযাপন করেন এখানে তাই বেশীরভাগ সময়ই আপনি উপভোগ করতে পারবেন একান্ত নিরবতা।
বালিতে ঢাকা সেন্টমার্টনের বিচ ধরে হেঁটে যেতে পারেন অনেকটা। এখানে অনিরাপত্তা বলে কিছু নেই। স্থানীয়রখুবই অতিথিপরায়ণ। দ্বীপের পেছনের দিকটা আরও নিরব, শান্ত। এখানে কোন একটা বেঞ্চিতে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় এক জীবন। জোয়ারের সময় কিছুটা উত্তাল হয় সমুদ্রের ঢেউ, তবে বেশিরভাগ সময়ই থাকে শান্ত। সেই শান্তি ছুঁয়ে যায় মানুষের মন, প্রশান্ত করে আত্মাকে।
সমুদ্রকে দেখা ছাড়াও সময়কে উপভোগ্য করতে আরও অনেক কিছু করতে পারেন আপনি। যেমন: স্কুভা ডাইভিং। বেসরকারি উদ্যোগে এই ডাইভিং এর প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে বছর ২ যাবৎ। আপনি সাঁতার না জেনেও ডাইভিং করতে পারবেন। তবে সমুদ্রে নামার আগে স্বল্প সময়ের একটি প্রশিক্ষণ নিতে হবে আপনাকে। এছাড়া সাইকেল ভাড়া করে সাইকেল চালাতে পারেন।
সেন্টমার্টিনের আরেক মজা সামুদ্রিক মাছে। তরতাজা মাছ রান্না হয় নানানভাবে, করা হয় বারবিকিউ। হোটেলগুলোতে গিয়ে নিজের পছন্দমত মাছটি বেছে নিতে পারেন। তারপর আপনি যেভাবে খেতে চান তাৎক্ষণিক সেভাবেই তৈরি করে দেওয়া হবে আপনাকে। তবে আগেই বলে রাখছি, সেন্ট মার্টিন ফাস্ট ফুড বা গ্রীল চিকেন খাওয়ার জায়গা নয়। সমুদ্রের কাছে গিয়ে সমুদ্রের খাবারই খেতে হবে। কাঁকড়া, লবস্টার, চিংড়ীও পাবেন এখানে। আর হ্যাঁ, মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীর বাইরে খেতে পারেন মন ভরে যত ইচ্ছা ডাব!
সেন্টমার্টিন যাবেন আর ছেঁড়া দ্বীপ যাবেন না তাই কি হয়? সেন্ট মার্টিন থেকে প্রতিদিন বিকেলে বড় ইঞ্জিন নৌকা যায় ছেঁড়া দ্বীপে। না, সেখানে কেউ থাকে না। ভ্রমণকারীদের নিয়েই হয় সেই যাত্রা। যেতে পারেন স্পীডবোটেও। ছেঁড়া দ্বীপের কাছাকাছি যেতে দেখতে পাবেন বড় একটি পাথর। স্থানীয়রা একে বলে মৌসুমি পাথর। নায়িকা মৌসুমি নাকি তার প্রথম সিনেমার শুটিং করতে এসেছিলেন এখানে আর এই পাথরটিতেই বসতে হয়েছিল তাকে। সেই থেকে এর এমন নাম। ভাটা থাকলে ছেঁড়া দ্বীপ থেকে হেঁটেই ফিরতে পারবেন আপনি মূল দ্বীপে। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে সরাসরি সেন্ট মার্টিন যেতে হলে তাহলে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ, ইউনিক পরিবহন এবং সেন্টমার্টিন পরিবহনসহ বেশ কিছু বাস সরাসরি টেকনাফ ঘাটের উদ্দেশ্যে রাত ৬:৩০-৮:৩০ এর মধ্যে ছেড়ে যায়। তারপর ঘাট থেকে কয়েকটি জাহাজ ছাড়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে সকাল ৯টায়। যা দ্বীপে পৌঁছায় ১২ টার মধ্যে। এটি আবার ফিরে আসে ৩ টার দিকে সেন্ট মার্টিন থেকে। তবে অফ সিজনে (এপ্রিল এর মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) জাহাজ চলে না। তবে ট্রলার ছাড়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে সারা বছরই।
আর কেউ যদি কক্সবাজার থেকে যান, তাহলে সকালে টেকনাফের উদ্দেশ্যে বাস, মাইক্রো, চান্দের গাড়ি ছাড়ে। অনেক প্যাকেজ অফার ও থাকে । যেই হোটেলে থাকবেন কক্সবাজারে, তাদের কাছে বললেও তারা ব্যবস্থা করে দিবে। তবে তাদের কাছে শুধু ট্রান্সপোর্ট এর সুবিধা ও আলাদা করে নেয়া যায়। যেমন শিপ এর টিকেট আর সকালে টেকনাফ যাবার সহায়তাটুকু নিতে পারবেন।
খরচ:
বাস নন এ সি- ৯০০-১২০০ টাকা, এসি ১৬০০-২০০০ টাকা । তবে আসার টিকেট সেন্ট মার্টিন থেকে কাটলে প্রতি টিকেটে ৫০-৬০ টাকা তারা চার্জ হিসেবে বেশি রাখবে।
রিসোর্ট- রিসোর্ট এর ভাড়া সিজন এর সময় কোন নির্দিষ্ট নেই তেমন, ট্যুরিস্ট এর উপর নির্ভর করে রিসোর্ট মালিকরা ভাড়া বাড়ায় কমায়। তবে সিজনে ১৫০০-২০০০ টাকার কমে রুম পাওয়া কষ্ট সাধ্য, যদি না সেখানে পরিচিত কেউ থাকে। আর অফ সিজনে ৭০০-১২০০ টাকায় পাওয়া যাবে সি রিসোর্টগুলো। আর রিসোর্টের প্রতি রুমে ৪ জন করে আরামে থাকা যায়। চেক আউট সময় ১১ টা।
ছেঁড়া দ্বীপ:
ছেঁড়া দ্বীপ যাবার জন্য ট্রলার ভাড়া ১৬০-২০০ টাকা করে, আর রিজার্ভ নিলে ১৫০০-৪৫০০ টাকা নেয় নৌকার আকার আর যাত্রীর উপর ভিত্তি করে।
শীতের পাখি গাঙচিল হয়ে মন ভাসিয়ে দিন সমুদ্রে। তবে প্রকৃতির কাছে গিয়ে নিরবতা বজায় রাখুন। অন্যকেও উপভোগ করার সুযোগ দিন। সেন্ট মার্টিনে ধূমপান নিষিদ্ধ, একইসাথে যেকোন প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এসব ব্যাপারে সচেতন থাকুন। আমাদের সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই।