না শীত,না গরম। প্রকৃতির এমন আবহে গিয়েছিলাম দেশের একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে।
তখন ফেব্রুয়ারির শেষ, দ্বীপের পর্যটন মৌসুমও প্রায় শেষের দিকে। কোলাহলমুক্ত দ্বীপকে দেখা ও কিছু ভালো সময় কাটানোর জন্যই এ সময়টা বেছে নেওয়া। টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকে জাহাজে উঠে গাঙচিল দেখতে দেখতে ভাবছিলাম নীল জলের দ্বীপের বালিয়াড়িতে আমরা হাঁটছি, বেশ সুনসান সাগরসৈকত। এ ভ্রম কাটতে খুব বেশি দেরি হলো না, জাহাজ থেকে নামার পরে দেখা গেল কল্পনার চিত্রকল্পের উল্টো চিত্র।
যে শহরে আমাদের নিত্য বসবাস, সেখানে কী যানজট দেখেছি ? এখানে যেন তার চেয়েও বেশি। জাহাজের জেঠি ঘাট থেকে হেঁটে সেন্টমার্টিন বাজারে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য! এ যেন আরেক কারওয়ানবাজার। এত লোকের ভিড়ে কানে যেন কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল। এ কান্না নীল জলের দ্বীপের। দ্বীপ যেন বলছিল আমি আর এই ভার বইতে পারছি না, ‘আমাকে মুক্তি দাও’। যেমনটা বলছে পরিবেশ অধিদপ্তরও। দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন সরকার ঘোষিত একটি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হলেও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন এবং পর্যটকদের অসচেতনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, পরিবেশ ও প্রতিবেশবিরোধী আচরণের কারণে সেন্টমার্টিনের বিরল প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে প্রায়। ’
দ্বীপে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল পশ্চিম দ্বীপ লাগোয়া একটি ইকো-রিসোর্টে। জাহাজ থেকে নেমে কিছুটা পথ হেঁটে আমরা উঠেছিলাম একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় (টমটমে)। যেতে যেতে কথা হয়েছিল চালকের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন গত দুুই বছর আগেও এ দ্বীপে কোনো অটোরিকশা ছিল না। ভ্যানে চলাফেরা করতো পর্যটক এবং স্থানীয়রা। এখন এ দ্বীপে টমটম রয়েছে ২০০টিরও বেশি।
যেতে যেতেই আমরা দ্বীপের চারপাশটা দেখছিলাম, আমাদের রিসোর্টটা যেহেতেু জাহাজ ঘাট এবং সেন্টমার্টিন বাজার থেকে কিছুটা দূরে, ভেবেছিলাম রিসোর্টে যাওয়ার পথে হয়তো সেন্টমার্টিনের গ্রামটা দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। যেতে যেতে শুধু আবাসিক, অনাবাসিক হোটেল আর রেস্তোরাঁই চোখে পড়েছে।
আধ ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছালাম আমাদের রিসোর্টে। রিসোর্টের নাম ছিল নোনাজল ইকো-রিসোর্ট। রিসোর্টটা দেখে কিছুটা আশাবাদী হলাম। এখানে রড, ইট, সিমেন্টের পরিবর্তে বাঁশ, কাঠ ও টিনের ব্যবহার করা হয়েছে। যা অনেকটাই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে নেওয়া। তবে, হতাশ হয়েছি রিসোর্টটির উদ্যোক্তা ইমরানুল আলমের দেওয়া তথ্য জেনে। তিনি জানালেন ৮/১০ বছর আগে দ্বীপে ৩০/৪০টি হোটেল রিসোর্ট থাকলেও এখন সেখানে হোটেল-রিসোর্টের সংখ্যা ১৫০টিরও বেশি।
সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বিরল জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারসহ দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ক্ষমতা বলে দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। মোট ১৪টি কার্যক্রম গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে বলা হয় এসব ‘বিধিনিষেধের লঙ্ঘন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ’।
সংকটাপন্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্বেগ অবশ্যই যথার্থ। কিন্তু বার বার ঘোষণা আসে তার বাস্তবায়ন হয় না। দ্বীপের এখানে ওখানে নানা সতর্কবাণী চোখে পড়লেও তা মানতে দেখা যায়নি কাউকেই। এগুলো মানাতে বাধ্য করতেও কাউকে দেখা যায়নি। আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি দ্বীপের সংকটের কথা। ১৯৯৯ সালেই সরকার এ দ্বীপকে একটি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই তুলনায় কাজের কাজ কিছুই চোখে পড়েনি। উল্টো দ্বীপে দিন দিন বাড়ছে পরিবেশ বিপর্যয়।
দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য দিন দিন ধ্বংস হতে চলেছে। সে আশঙ্কার কথা পরিবেশবিদরা ও বিশেষজ্ঞরা অনেক আগ থেকেই বলছেন। এ অবস্থার জন্য যে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন দায়ী-এ কথাও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলেছে বার বার। এজন্য পর্যটন নিয়ন্ত্রণের সুপারিশও দিয়েছেন অনেকে।
এক সময় সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল ছোট নৌ-যান, স্পিডবোট, ট্রলার বা সি-ট্রাক। এখন সেখানে সংযোজিত হয়েছে অভিজাত জাহাজ। দ্বীপটিতে থাকার মতো হোটেল, মোটেল বা বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল কম। তা এখন বাড়ছে কয়েকগুণ।
সিদ্দিকুল আলম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, বেশি সময় লাগেনি গত ১০ বছরেই দ্বীপে হোটেল-মোটেলের সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। যাতায়াত ও বাসস্থানের সুবিধা হওয়ায় পর্যটকের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।
টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে এ দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। টেকনাফ উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এখন সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নয় হাজার। যা ২০/২৫ বছর আগে ছিল ৫ হাজার।
স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গারা বিভিন্নভাবে এ দ্বীপে স্থায়ী আবাস শুরু করেছে, এর ফলশ্রুতিতে দ্বীপে দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে।
রফিকুল আলম নামে আরেক বাসিন্দা জানান, প্রতিদিন এই দ্বীপে ১০ থেকে ১২ হাজার পর্যটকের আনাগোনা হয়। দ্বীপের ঠিক দক্ষিণে ‘ছেঁড়াদিয়া’ নামে আরেকটি ছোট দ্বীপ রয়েছে। এ ছোট দ্বীপটিতে জনবসতি নেই। দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ প্রবালসহ বিভিন্ন ধরনের পাথর। নানা রঙের, নানা আকৃতির পাথরই ছেঁড়াদ্বীপের সৌন্দর্য। তবে, এখানে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
স্থানীয়রা আরও জানান, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছে সেখানে। সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন প্রচুর পর্যটক দ্বীপে রাতযাপন করেন, পর্যটকের কারণেই দ্বীপের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে যায় প্রতিদিন। এ বিপুল সংখ্যক মানুষের চাপ ছোট এ দ্বীপটি নিতে পারছে না। এর ফলশ্রুতিতে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। সংকট দেখা দিয়েছে খাবার পানির। নিচে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ সুপেয় মিঠা পানির স্তর। দ্বীপের সবখানে ক্ষতিকারক প্লাস্টিকসহ নানা ধরনের বর্জ্য ফেলছেন পর্যটকরা, দ্বীপের সৈকত ও সমুদ্রও নোংরা, দূষিত করা হচ্ছে।
ছেঁড়াদ্বীপ-যেখানে যাওয়া সাধারণ পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ সেখানে গিয়েও দেখা যায়, পরিবেশ বিপর্যয়ের করুণ দৃশ্য। ছোট দ্বীপটিতে প্রতিদিন যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। ফেলছে প্লাস্টিক ও নানা বর্জ্য! এছাড়াও সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়েছে তৈরি হচ্ছে থাকার হোটেল। সৈকতের বালিয়াড়ি থেকে নেওয়া হচ্ছে নির্মাণের জন্য বালু এবং পাথর। দ্বীপের সৈকতে মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যানসহ যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক বাহন নিষিদ্ধ হলেও চলছে প্রতাপের সঙ্গেই।
পর্যটকরা নানাভাবে শব্দ দূষণ করছেন। এভাবে পরিবেশ বিনষ্ট ও বিপন্ন করায় সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুকসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য এখন বিলুপ্ত বা ধ্বংস হওয়ার পথে।
সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল ও পরিবেশবিদরা বলছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে সমুদ্রে দু-মাইলের মধ্যে এখন জীবিত প্রবাল দেখা যায় না দূষণের কারণে।
পরিবেশবিদরা মনে করেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিপুলসংখ্যক পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ আওয়ার সি এর মহাসচিব মো. আনওয়ারুল হক বলেন, অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে দ্বীপ পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে। এ দ্বীপে পর্যটকের ধারণক্ষমতা দুই হাজার। সেখানে প্রতিদিন দ্বীপে অবস্থান করে ১০ থেকে ১২ হাজার পর্যটক। পর্যটকদের ফেলা বর্জ্যের কারণে সাগর তীরের প্রাণ ও জীববৈচিত্র্য আশঙ্কাজনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাগরে মাছ কমে যাচ্ছে। দেশের একমাত্র কোরাল আইল্যান্ড এই দ্বীপ। এখানে এক সময় বিভিন্ন দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা এলেও এখন আর আসে না। রাতের বেলায় হোটেল রিসোর্টগুলোর আলোর কারণে কাছিম আর ডিম পাড়ে না। এক সময় এ দ্বীপে প্রচুর শৈবাল চোখে পড়তো। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকের কারণে সেই শৈবাল এখন আর চোখে পড়ে না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো এ দ্বীপ বিলীন হয়ে যাবে। দিন দিন ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে দেশের অমূল্য সম্পদ এই দ্বীপটি।