রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন

নীলনদের তীরে

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৩

ব্লু নীল, হোয়াইট নীল ও আতবারা— এই তিন নদীর মিলিত জলধারায় পুষ্ট বিশ্বের বৃহত্তম নীলনদ ও তার তীরবর্তী অঞ্চলগুলো দেখব বলে শরতের এক স্নিগ্ধ সকালে দমদম বিমানবন্দর থেকে রওনা দিলাম মিশরের পথে। প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টার আকাশপথ পেরিয়ে দুবাই হয়ে যখন কায়রো পৌঁছলাম তখন সদ্য বিবাহিতা কনে বধূর চলার মতো লাজুক পায়ে সন্ধ্যে নামছে শহর জুড়ে।

বিমান বন্দরের বাইরে আসতেই দেখি আমাদের নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে ফারুক। সুঠামদেহী মিশরীয় যুবক। এই ভ্রমণে ও-ই হবে আমাদের গাইড বা পথ প্রদর্শক।

একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে উঠিয়ে ও আমাদের নিয়ে আসে হোটেলে। রাতটুকু কাটিয়ে পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়ি কায়রো দর্শনে। বাসে যেতে-যেতে ফারুক বলতে থাকে মিশরের ইতিহাস। আরবি শব্দ ‘আল-কাহিরা’ থেকেই কায়রো নামের সৃষ্টি। যার অর্থ ‘বিজয়ী’। মিশর দেশটির উত্তরে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে সুদান, পশ্চিমে লিবিয়া ও পূর্বদিকে লোহিতসাগর।

তিনশ একত্রিশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার এই দেশটি দখল করে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁর নামানুসারেই অঞ্চলটির নাম হয় আলেকজান্দ্রিয়া। তাঁর মৃত্যুর পর সূচনা হয় টলেমি রাজবংশের। যে বংশের সর্বশেষ শাসক ছিলেন রানি ক্লিওপেট্রা।

ইতিহাস শুনতে-শুনতে চলে আসি সাক্কারায়। এখানকার ছ’টি ধাপ বিশিষ্ট স্টেপ পিরামিডটি দেখে রওনা দিই নীলনদের পশ্চিমতীরে অবস্থিত গির্জা অঞ্চলে। এখানেই এক রুক্ষ মরুময় প্রান্তরে কাছাকাছি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন তিনটি পিরামিড ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্ফিংস-এর মূর্তিটি। ঘুরে-ঘুরে দেখি।

সূর্যদেব তখন মাঝ আকাশে। ফারুক জানায়, এবার আমরা যাব কায়রো বিমানবন্দরে। সেখান থেকে বিকেলের বিমান ধরে পৌঁছব লুক্সর। নিকটবর্তী লুক্সর মন্দিরটি দেখে জাহাজে চেপে শুরু হবে আমাদের নীলনদ সফর।

স্ফিংস চত্বর থেকে বাসে করে বিমানবন্দর পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। যেতে-যেতে দেখি প্রশস্ত রাজপথের দু’ধারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে রাশি-রাশি খেজুর গাছের সারি। হলুদ ফলে ভ’রে আছে গাছগুলো।

এক ঘণ্টার উড়ানে আকাশপথ পেরিয়ে যখন লুক্সর পৌঁছই তখন অস্ত সূর্যের শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে পড়েছে শহরটির গায়ে। ওখান থেকে বাসে করে চলে আসি লুক্সর মন্দিরে।

বড় রাস্তার পাশেই বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে মন্দিরটি। মন্দিরের তোরণ থেকে প্রবেশদ্বার পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে অসংখ্য স্ফিংস-এর মূর্তি। এছাড়া মূল মন্দিরে প্রবেশ দ্বারের দু’পাশে বসানো হয়েছে সম্রাট রামেসিসের দু’টি পাথরের মূর্তি।

ভিতরে ঢুকে দেখি বিশাল বড়-বড় থাম ধরে রেখেছে মন্দিরটি। থামগুলোর গায়ে ও মন্দিরের দেওয়ালে অলংকরণ করা ছাড়াও খোদাই করা রয়েছে মিশরীয় দেবদেবীদের মূর্তি। রাতের মায়াবী আলোয় বড় অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে পুরো মন্দির চত্বরটি।

মন্দির দেখা সাঙ্গ করে আবার উঠে বসি বাসে। ফারুক জানায়, এবার আমরা উঠব ক্রুজ়ে। পরবর্তী পাঁচদিন ধরে নীলনদের বুকে ভাসতে-ভাসতে দেখে নেব নদী তীরবর্তী দর্শনীয় স্থানগুলোকে। পঞ্চম দিনে ‘আসোয়ান’ পৌঁছে পরিসমাপ্তি ঘটবে এই ভ্রমণের।

বেশ কিছুটা এগোতেই পৌঁছে যাই জেটিঘাটে। আমাদের বিস্মিত চোখের সামনে আলোয়-আলোয় ঝলমল করতে থাকে নীলনদ। যে স্রোতস্বিনীর কথা বইতে পড়েছি আজ তাকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়ে এক অপরিসীম আনন্দে ভরে ওঠে মন। বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি আপন ছন্দে বয়ে চলা নদীটির দিকে, তারপর এগিয়ে যাই জাহাজে ওঠার জন্য।

চারতলা বিশিষ্ট সুসজ্জিত জাহাজটির নাম ‘আলিশান’। প্রতিতলাতেই প্রশস্ত, পরিচ্ছন্ন ঘর। ঘরে ঢুকে কাঁচের জানলা সরাতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীলনদের এক অনির্বচনীয় রূপ।

জাহাজের ডাইনিং হলটি একদম নিচে। বেসমেন্টে। ওখানে গিয়ে দাঁড়ালেই দেখা যায় বুকের সামনে দিয়ে সবেগে বয়ে চলেছে নীলনদের জল।

রাতের আহার সেরে ফেরার সময় ফারুক জানায়, ভোর চারটেয় আমরা বেরোব ‘বেলুন’ ভ্রমণে। কিছুটা পথ গিয়ে বড় বেলুনে চড়ে নীলনদের তীর ধরে ভাসতে ভাসতে আমরা দেখে নেব মিশর সম্রাটদের সমাধি প্রাঙ্গণ ‘ভ্যালি অব দ্য কিংগস’ ও নীলনদের অসাধারণ সৌন্দর্যকে। তারপর বেলুন ভ্রমণ সাঙ্গ করে বাসে করে রওনা দেব ‘ ভ্যালি অব দ্য কিংগস’-এর পথে।

কথা মতো নির্ধারিত সময়েই রওনা দিই আমরা। তারপর যখন বেলুনে চড়ে নীলনদের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে যেতে থাকি তখন এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে ওঠে মন।

বেলুন ভ্রমণ সেরে বেশ কিছুটা পথ চলার পর পৌঁছই ‘ভ্যালি অব দ্য কিংগস’-এ রুক্ষ পাহাড়ের কোলে প্রাচীন মিশর সম্রাটদের সমাধি প্রাঙ্গণে।

ধূ-ধূ প্রান্তর। সেই রুক্ষ ঊষর ভূখন্ডের এক প্রান্তে টিকিট কাউন্টার। তিনটে মমি দেখার জন্য দর্শনী একশ পাউন্ড। এছাড়া তুতেন খামেনের মমি দেখতে হলে দিতে হয় আরও একশ পাউন্ড। টিকিট কাউন্টার থেকে সমাধি মুখ পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্য রয়েছে ব্যাটারিচালিত সুন্দর গাড়ির ব্যবস্থা।

শুনলাম এই ঊষর প্রান্তরে আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ৬৬টি মমি। তারমধ্যে ৬২টি মিশর সম্রাট বা ফ্যারাওদের। বাকি চারটি কোনও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির।

প্রতিটি মমির সঙ্গেই পাওয়া গিয়েছে মৃত ব্যক্তির প্রতি উৎসর্গ করা খাবার-দাবার, আসবাবপত্র, পোশাক-আশাক ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার।

আমরাও একে-একে চতুর্থ ও নবম রামেসিস, মেরেন্‌পোতা ও তুতেনখামেনের মমিগুলো দেখে রওনা দিই।

এই ভ্যালি অব দ্য কিংগস-এর খুব কাছেই রয়েছে ‘ডেইর-অল-বাহরি’ মন্দির। রুক্ষ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই তিনতলা মন্দিরটি আসলে মিশর সম্রাজ্ঞী হাচেপসুত-এর অন্ত্যেষ্টি মন্দির। প্রায় সাড়ে তিনহাজার বছরের পুরনো হলেও এর নির্মাণশৈলী অসাধারণ।

এরপর আমরা চলে আসি নীলনদের অদূরে লুক্সর-এর বিখ্যাত কার্নাক মন্দিরে। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে মন্দিরটি। আয়তনে যেমন বিশাল, তেমনই অসাধারণ এর স্থাপত্যশৈলী। মন্দিরে প্রবেশপথের দু’ধারে স্ফিংস-এর সারি। দেখে মনে হয় যেন অতন্ত্র প্রহরী। ভিতরে রয়েছে একটি পবিত্র জলাশয়ও।

কার্নাক মন্দির দেখে আবার আমরা ফিরে আসি জাহাজঘাটায়। স্নান-খাওয়া সেরে উঠে আসি জাহাজের ছাদে।

ঠিক বেলা তিনটেয় ছাড়ে জাহাজ। নদীতীরের যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি শুধু সবুজ আর সবুজ। খেত ভর্তি জোয়ার, ভুট্টা, বাজরা ও অসংখ্য কলাগাছের সারি। দেখতে-দেখতে পেরিয়ে যেতে থাকি একের পর এক লোকালয়।

সহসা পশ্চিম আকাশে চোখ পড়তেই চমকে উঠি। দেখি বড় অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে সারা আকাশ। পেঁজা তুলোর মতো ছড়িয়ে থাকা সাদা মেঘের ফাঁকে-ফাঁকে অস্তসূর্যের শেষ আভাটুকু ছড়িয়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অপরূপ সৌন্দর্যের।

জাহাজের ডেকেই দেওয়া হয় চা, কফি, স্ন্যাকস্।

ক্রমে সন্ধে নামে। নীলনদের দুই তীর, সবেগে বহমান জলধারা ক্রমশ আবছা হয়ে আসে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা চলার পর জাহাজ এসে থামে ‘এসনা’ লক ড্যাম-এ।

তাকিয়ে দেখি আমাদের জাহাজটি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে জলের উচ্চতা খুবই কম। অথচ লকগেটের ওপারে জলস্তর রয়েছে অসম্ভব উচ্চতায়। এখানে বিশেষ পদ্ধতিতে জলস্তর সমান ধাপে এনে আবার শুরু হয় যাত্রা। নীলনদ এখানে এতটাই চওড়া যে এপার-ওপার দেখা ভার।

খানিক বাদেই গোল চাঁদ ওঠে আকাশে। তারায়-তারায় ভরে ওঠে সারা আকাশ। মোম গলার মতো চাঁদের গা বেয়ে গলে পড়া আলোর বন্যায় ভেসে যেতে থাকে নীলনদ ও তার দু’পাশের অগণিত বৃক্ষরাজি, জনপদ ও লোকালয়।

ক্রমে রাত বাড়ে। আমরাও রাতের আহার সেরে ঢুকে পড়ি ঘরে। গভীর রাতে শুয়ে-শুয়েই টের পাই অগণিত লোকালয় ও জনপদকে পিছনে ফেলে নীলনদের বুক চিরে জাহাজ চলেছে এগিয়ে।

হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই পর্দা সরিয়ে দেখি ভোর হচ্ছে সবে। দ্রুত ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছাদে উঠতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অরুণিত সূর্যদেবের এক আলোকসুন্দর রূপ।

নীলনদের জল এখানে ঈষৎ সুবজাভ। তীরে খেজুর গাছগুলোর মাথায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে দুধ সাদা বকের ঝাঁক। প্রশস্ত নদীর বুকে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে ছোট-ছোট জেলে নৌকার দল।

দেখতে দেখতে এগোই। বেশ কিছুটা চলার পর আমরা পৌঁছই ‘এডফু’। এখানেই থামে জাহাজ।

বাইরে বেরিয়ে এসে একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রওনা দিই ২৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি আকাশের দেবতা ‘হোরাস’-এর মন্দিরের দিকে। সাধারণের কাছে সেটি ‘এডফু’  মন্দির বলেই পরিচিত। ঘোড়ার গাড়িতে প্রায় মিনিট দশেকের পথ।

এখানে মূল মন্দিরে প্রবেশপথের দু’পাশের দেওয়ালই সুন্দরভাবে চিত্রিত। ভিতরে দেবতা ‘হোরাস’-এর মূর্তি।

ফারুক জানায়, গ্রিক শাসক তৃতীয় টলেমির রাজত্বকালে এই মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হলেও কাজটি শেষ হয় দ্বাদশ টলেমির আমলে। তবে বিশালত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে লুক্সরের কার্নাক মন্দিরের পরই এটির অবস্থান।

‘এডফু’-র মন্দির দেখে আবার ফিরে আসি জাহাজে। ঘরে ঢুকে বহমান নীলনদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য জানলার পর্দাটা সরাতেই দেখি নদীর বুকে ইতস্তত ভেসে চলেছে বেশ কয়েকটি ডিঙি নৌকা। মাছ ধরছে অল্পবয়েসী ছেলের দল। কোথাও বা নীলনদ বাঁক নিয়েছে ধনুকের মতো। তীরের কাছে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বড়-বড় পাথরের চাঁই।

দেখতে-দেখতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চলার পর জাহাজ এসে থামে কোম-ওমবো-তে। ফারুক জানায়, এখানে আমরা দেখব গ্রিক শাসনকালে তৈরি দেবতা ‘সোবেক’ ও ‘হারোত্ররিস’-এর মন্দির। এছাড়া এখানে রয়েছে একটা বড় ক্রোকোডাইল মিউজ়িয়ামও।

জাহাজ থেকে নেমে মাত্র মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথেই পড়ে মন্দির দু’টি। নির্মাণ করেছিলেন গ্রিক শাসক চতুর্থ টলেমি।

বেশ পরিচ্ছন্ন চত্বর। বর্তমানে মন্দিরের বেশ কিছুটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মন্দিরের গায়ে খোদাই করা মূর্তিগুলো আজও অটুট।

এই মন্দির দু’টির খুব কাছেই রয়েছে ক্রোকোডাইল মিউজ়িয়ামটি। ভিতরে একটা বড় টেবিলের উপরে গোটা দশেক কুমিরকে রাখা হয়েছে ‘মমি’ করে। মিশরীয়দের কাছে কুমির দেবতা হিসেবে পূজিত। দেবতা সোবেক—এর মাথাটিও তো কুমিরের।

মিউজ়িয়াম দেখে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসি জাহাজে। তখন বেলা পড়ে এসেছে। নীলনদের জলে, দু-তীরের সবুজ গাছগুলোর মাথায়-মাথায় দিনশেষের আদুরে রোদ আপনমনে লুটোপুটি খাচ্ছে। মাথার উপর ছড়িয়ে থাকা আকাশটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন নীল রং গোলা বালতি উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে আকাশের গায়ে।

আমরা ঘরে ঢোকার আগে ফারুক জানায়, রাত বারোটাতে আমরা বেরিয়ে পড়ব মিশর দেশের একদম দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ‘আবু-সিম্বল’-এর পথে। মোট তিনশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছব শেষরাতে। পুরো যাত্রা পথটাই গিয়েছে সাহারা মরুভূমির মধ্য দিয়ে।

এই আবু-সিম্বল-এই পাশাপাশি রয়েছে সম্রাট দ্বিতীয় রামেসিস ও তাঁর স্ত্রী নেফারতারির মন্দির। প্রতিবছর ২২ ফেব্রুয়ারি ও ২২ অক্টোবর এখানে অনুষ্ঠিত হয় সানফেস্টিভ্যাল। ওই দুইদিন সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি সরাসরি এসে পড়ে মন্দিরের ভিতরে দ্বিতীয় রামেসিস-এর মুখের উপরে। সূচনা হয় সূর্য উৎসবের। যা দেখবার জন্য ওই সময় দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটকের ঢল নামে এখানে।

ঠিক রাত বারোটাতেই বেরিয়ে পড়ি আমরা। গভীর রাতে সাহারা মরুভূমির বুক চিরে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দেখি সারা আকাশ জুড়ে সাদা ফুলের মতো ছড়িয়ে আছে অগণিত তারার দল। সেগুলো এত কম উচ্চতায় যে মনে হয় যেন একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। প্রকৃতির সেই অনির্বচনীয় রূপসুধা পান করতে করতে ভোরবেলায় পৌঁছে যাই ‘আবু-সিম্বল’।

এখানে নীলনদের তীরে বারোশ পঞ্চাশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দু’টি মন্দির বানিয়েছিলেন দ্বিতীয় রামেসিস। একটি তাঁর নিজের ও অপরটি তাঁর প্রিয়তমা পত্নী নেফারতারির নামে। নীলনদের ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পরবর্তীকালে এই মন্দির দু’টিকে নদীতীর থেকে উঠিয়ে এনে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় স্থাপন করা হয়। এখন সেখানেই অবস্থিত রয়েছে মন্দিরদু’টি।

এই মন্দিরের সামনে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে টলটলে নীল জলে ভরা এক সুবিশাল হ্রদ, যেটির পরিচিত নাম ‘লেক নাসের’।

হ্রদটির তীরে কিছুসময় কাটিয়ে আবার উঠে বসি বাসে। ঘণ্টাখানেক চলার পর পৌঁছই নীলনদের ওপর তৈরি আসোয়ান বাঁধটি দেখতে।

বাঁধটি লম্বায় প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। এই বাঁধটি শুধু যে নীলনদের বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাই নয়, মিশরের ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎও পৌঁছে দিচ্ছে।

আসোয়ান বাঁধ দেখে ফিরে আসি জাহাজে। কেবিনে ঢোকার মুখে কর্তৃপক্ষ জানান, যাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য রাত ন’টায় তাঁরা নুবিয়ান উপজাতিদের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন।

এরকমই নাকি হয়। নীলনদের বুকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে যে জাহাজগুলো চালাচল করে সেখানে রাতের দিকে লাউঞ্জে কর্তৃপক্ষ কোনও না কোন সাংস্কৃতিক অুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যেমন আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক হয়েছে নুবিয়ানদের অনুষ্ঠান।

নুবিয়ানরা আমাদের দেশের সাঁওতাল, ওঁরাও কিংবা রাভাদের মতোই একটা উপজাতি। মূলত মিশরের দক্ষিণতম অংশেই এদের বসবাস। শুনলে অবাক লাগে, এই উপজাতির লোকেরা বাড়িতে কুমিরও পোষে। কেননা এরা বিশ্বাস করে কুমির হল সৌভাগ্যের প্রতীক।

ঠিক রাত ন’টাতেই শুরু হল অনুষ্ঠান। নাচে, গানে, অভিনয়ে এক ঘণ্টার মন-মাতানো অনুষ্ঠানটিকে প্রাণবন্ত করে তুললেন নুবিয়ান শিল্পীরা।

অনুষ্ঠান শেষ হতেই ফারুক জানালো, পরদিন সকাল আটটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়ব নুবিয়ান উপজাতিদের একটা গ্রাম পরিদর্শনে।

সেইমতো পরদিন সকালে স্পীডবোটে শুরু হয় আমাদের যাত্রা। দু’চোখ ভরে নীলনদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট চলার পর আমাদের নৌকা ভেড়ে নুবিয়ান গ্রামের কাছে।

বেশ শান্ত, স্নিগ্ধ গ্রামটি। নদীতীরে লাইন দিয়ে পরপর বেশ কয়েকটি দোকান। নুবিয়ানদের হাতে তৈরি ব্যাগ, চাদর, অলঙ্কার, আসন ও নানারকম সৌখিন দ্রব্যাদি বিক্রি হচ্ছে দোকানগুলোতে। কেনাকাটা সারা হলে ফারুক আমাদের নিয়ে আসে একটা নুবিয়ান পরিবারে।

পরিবারের কর্ত্রী মধ্য বয়সিনী। স্বামী, স্ত্রী ও এক পুত্রকন্যা নিয়ে সংসার। বাড়ির ভিতর ঢুকতেই ড্রইংরুম। ড্রইংরুমের দেওয়ালে ঝোলানো বেশ কয়েকটি জীবজন্তুর মমি। কত পুরুষ আগের কে জানে! কয়েক রকম মাছ ও পাখিও দেখলাম শুকিয়ে রাখা হয়েছে দেওয়ালে।

তবে সবচেয়ে অবাক হই যখন দেখি সত্যি সত্যিই ঘরের মধ্যে একটা চৌবাচ্চায় বেশ কয়েকটি কুমিরের বাচ্চা পুষেছেন তারা। কুমিরকে এতটাই সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করেন নুবিয়ানরা।

এক ফাঁকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে য়াই বাড়িটির ছাদে। দেখি পুরো নুবিয়ান গ্রামটাই ছবির মতো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে গ্রামটি দেখি। তারপর আবার স্পীড বোটে চড়ে ফিরে আসি জাহাজে। স্নান, আহার সেরে বাসে করে বেরিয়ে পড়ি শহর দর্শনে।

একটা জেটিঘাটের সামনে এসে দাঁড়ায় আমাদের বাস। বাস থেকে ছোট নৌকায় চেপে পৌঁছোই ‘এজিলিকা’ দ্বীপে তিনশ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে গড়ে ওঠা ‘ফিলে’ মন্দির দর্শনে।

প্রাচীন মন্দির। তবে মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রগুলো এখনও অটুট। মন্দির দর্শন সেরে দ্বীপ থেকে ফিরে আসি। ফারুক জানায়, এবার আমরা যাব নীলনদের উপর নৌকা বিহারে।

নির্ধারিত ঘাটে পৌঁছে দেখি ছোট, বড় অসংখ্য পাল তোলা নৌকা বাঁধা রয়েছে ঘাটটিতে। কয়েকটিতে উঠে যাত্রীরা ইতস্তত ভেসে বেড়াচ্ছেন নীলনদের বুকে। মিশরে এই জাতীয় পাল তোলা নৌকাগুলোকে বলে ‘ফালুকা’।

ফালুকাটি চলতে শুরু করলে একজন মিশরীয় যুবক একটি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সুমিষ্ট সুরে মিশরীয় লোকসঙ্গীত গেয়ে শোনায় আমাদের। গানটির কথা আমরা বুঝিনি বটে, তবে সুরটি মন ছুঁয়ে যায়।

ফালুকায় ভাসতে ভাসতেই নীলনদের দুই তীরে একে-একে দেখে নিই এলিফ্যান্টাইন দ্বীপ, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও আগা খাঁ-র প্রাসাদটিকে।

ঘণ্টাখানেক নৌকা বিহার সেরে ফিরে আসি জাহাজে। লুক্সর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। চাররাত পাঁচদিন কাটিয়ে আমাদের নীলনদ ভ্রমণ শেষ হয় আসোয়ানে।

নিকটবর্তী রেল স্টেশন থেকে রাতের ট্রেন ধরে পরদিন সকালে পৌঁছে যাই কায়রো। ওখানে দু’দিন থেকে অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে রওনা দিই কল্লোলিনী কলকাতার পথে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com