ব্যাংকক শহরটির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এই ‘চাও ফ্রেয়া’ নদী। ‘সাফান তাকসিন’ হলো সেই নদীর একটি পাড় অথবা স্টেশন। এভাবে বেশ কয়েকটি স্টেশন বা পাড় রয়েছে। নদীর রূপালি স্রোতে আছড়ে পড়ছে কিছু প্রতিচ্ছবি। তৈরি হচ্ছে দৃশ্যকল্প। প্রাণবন্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে এখানেই প্রথম কথা হলো বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্টে সিদ্দিক ভাইয়ের মাধ্যমে পাওয়া গাইড সুপীনের সঙ্গে।
কলারলেস ব্লাউজ আর স্বল্প স্কার্ট পরিহিত সুপীন সিনাওয়াত্রা যেন হৃদয়হরণকারিণী। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে জানালো, নৌকাই থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহি পরিবহনযান। নৌকা ভাড়া জনপ্রতি ২০ বাথ। শহর থেকে ঘণ্টাখানেক দূরত্বে নদীর অন্য পাড়ে রয়েছে ভাসমান বাজার। লোকেরা প্রাত্যহিক চলাচলে নৌকাকে সাশ্রয়ী মনে করেন।
কৌতূহল থেকেই বাজারটি ঘুরে দেখার ইচ্ছে পোষণ করি। ‘দামনয়েক সাদুয়াক’ নামের বাজারটি বেশ বিচিত্র। থাইদের প্রথম দিককার ঐতিহ্যবাহি সব তৈজসপত্র যেমন আছে, তেমনি রয়েছে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য কাঠের তৈরি সামগ্রী। সেখানে স্তরে স্তরে খুঁজে পাওয়া গেল সুভ্যেনির, স্থানীয় শিল্পীদের পেইন্টিং, কাঠের হুক্কা থেকে শিশুদের খেলনা। কচ্ছপ থেকে কানের দুল।
মেঘহীন আকাশ, উষ্ণ সমুদ্র মিলিয়ে ব্যাংককের অক্টোবর মাসটা সত্যিই অসাধারণ। এই মাসেই থাইরা জলদেবতার উৎসবে মেতে ওঠেন। এখানকার লোকেরা প্রথমে পদ্মের আকারে একটি ছোট নৌকা কলাপাতা থেকে তৈরি করেন। তারপর সেই নৌকায় জুড়ে দেওয়া হয় দীপ্তিমান সব বাতি, যা জলে ভেসে নদীর দেবতাদের শ্রদ্ধা জানায়। থাইদের পৌরাণিকগাথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে আজ রাতে যেন আমি ফিরে যাচ্ছি আমার শৈশবে। সেই কবেকার দাদীমার গল্প! মনে পড়ে যেখানে ‘সৈকত ছাড়িয়ে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়েছিলো যে জেলে, অনেক দূরে…অনুজ্জ্বল তার নৌকায় রাখা লণ্ঠনের শেষ আলোকবিন্দু…!’বিকেলে সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে নেমেই একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে পৌঁছেছিলাম সুকম্ভিট রোড। যেখানে এক হাজার বাথে তিন তারকা একটি হোটেলে দুই রাতের নৈশযাপন চুক্তি সম্পন্ন করি। ব্যাংকককে বলা হয় ‘প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শহর’ বা ‘নিষিদ্ধ বিনোদনের শহর’। এর বাইরে আছে এর আদুরে মেজাজ আর মায়াবি প্রকৃতির হাতছানি। পর্যটকরা লোভ সামলাতে হিমশিম খান, ছুটে আসেন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে।
সুপীনকে জানালাম, আমার হাতে সময় কম। সেজন্য এবারে শুধু ব্যাংকক শহরটাই ঘুরে ঘুরে দেখবো। মুচকি হাসিতে হাত নেড়ে বিদায় নিলো সুপীন। পরের দিনও অপার বিনোদনের বাক্স খুলে আনন্দ দেখাতে জগৎ চেনাতে সে হচ্ছে আমার যাত্রাসঙ্গী। ক্লান্ত যুগপৎ রোমাঞ্চিত আমি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিই।
ফুটপাতে এক মধ্যবয়সী নারী কড়াইয়ের ভেতর কী যেন গরম করছেন। সামনে ছোট ছোট টেবিল চেয়ারের আধিক্য। পর্যটকরা দেখি সমানে গোগ্রাসে গিলছেন। জানলাম, এখানে থাইদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার ‘প্যাড থাই‘ রান্না হচ্ছে। ‘প্যাড থাই’ কথাটির অর্থ চালের নুডুলস। প্রতি প্লেটের দাম ৬০ বাথ। এতোই পরিচ্ছন্ন পরিবেশ যে মনে হলো স্ট্রিট ফুড গ্রহণে এখানে স্বয়ং দেবতারাও আপত্তি করবেন না!
চমৎকার শারীরিক গঠনের অধিকারী প্রায় স্বল্পবসনা পরিবেশিকার বয়স অত্যন্ত কম মনে হলো। মুক্তার মতো হাসি ছড়িয়ে তিনি যখন খাবার নেড়ে একটু-আধটু সস মিশিয়ে দিলেন; তখন কিন্তু আন্তরিকতার দাবানলে পরিবেশটা আরও মহার্ঘ হয়ে উঠলো। বুঝলাম, থাই খাবার মানেই সিদ্ধ কোনো কিছু আর তাতে অনিবার্য সস!
লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর সিনেমা ‘দ্য বিচ’ যেখানে শুটিং হয়েছিলো, সেই খাওসান রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুপীন জানালো, দেশটিতে কর্মজীবির ৫৭ শতাংশই নারী। পুরুষরা এখানে অলস প্রকৃতির হলেও থাই নারীরা অত্যন্ত কর্মঠ। পুরুষরা জানেন শুধু কেরানিগিরি, দালালি আর গাড়ির ড্রাইভিং। বাচ্চা লালন-পালনসহ সংসার পরিচালনার আর্থিক দায়িত্ব একজন থাই নারী স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেন।
চলতি পথে চোখ জুড়াচ্ছে নানা রকমের পাব, নাইট ক্লাব, সস্তা বিয়ার, ইতালিয়ান কাফে, মানি একচেঞ্জ, ফলের দোকান আর ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া বেশ কিছু হিজড়া ললনাদের দেখে দেখে। ব্যাংকক এসেছেন অথচ হিজড়াদের দেখা পাননি এটা ঘটে থাকলে তা হবে দুর্লভ ঘটনা। দূর থেকে এদের রূপ আপনাকে আকৃষ্ঠ করবে, কিন্তু কাছে গেলে দেখবেন ‘লেডি বয়’!
খাওসান রোডে হঠাৎ পেশিবহুল পুরুষদের একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেলে; সুপীন উচ্চারণ করলো ‘মুয়ে থাই’! ব্যাংককে এসে মায়াবী চেহারার নারীদের কোমলতায় অনেকেই হারিয়ে যান, ভুলে যান থাইদেশে বক্সিংও যে একটি শিল্পকলা! ব্যাংকক বা থাইদেশের এই ‘মুয়ে থাই’ সম্পর্কে আরও জানতে দেখতে পারেন একটি মুভি, নাম ‘ঙ-বাক: মুয়ে থাই ওয়ারিওর’। ভাগ্য ভালো হলে খাওসান রোডের প্রশস্ত রাস্তায়ও দেখা মিলবে ‘মুয়ে থাই’ যোদ্ধাদের। তুলে নিতে পারবেন নগদ সেলফি।
‘মুয়ে থাই’ যোদ্ধাদের গল্প মিলিয়ে যাবার আগেই সুপীন জানতে চায় রাজা, রাণী, রাজ্যসভা দেখার মতো ধৈর্য্য আছে কিনা? ইতিহাসের প্রতি দায় এবং ঐতিহ্যের প্রতি অবিচল আগ্রহ থেকেই জানালাম, হ্যাঁ। এবারে হোক তাহলে ‘গ্র্যান্ড প্যালেস’ দর্শনের পালা। একটানা দেড়শ বছর যা ছিলো থাই সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু।
সেই সময়কার প্রতিপত্তিশালী রাজা প্রথম রমা এর নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন ১৭৭২ সালে। ১৮০০ সালের শেষের দিকে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া এই আলিশান প্রাসাদটি সম্পর্কে জানতে পর্যটকের আগ্রহের কোনো কমতি নেই; বেশ ভিড়। এই প্যালেসের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘টেম্পল অব দ্য এমারল্ড বুদ্ধ’। দুটি দৈত্যাকার মূর্তি নয়, এ যেন অতন্দ্র প্রহরী! ভালোবেসে মূর্তিদ্বয় চীনা বণিকরা উপহার হিসেবে রাজাকে দিয়েছিলো, থাই রাজাকে।
মূর্তিদ্বয় এই মন্দিরের আধ্যাত্মিক প্রকৃতি আর চির ঐতিহ্যের স্থাপত্যশিল্প থেকে একেবারেই ভিন্ন। এখান থেকে এগোতেই দেখা হলো ‘ওয়াট অরুণ’, যাকে বলা হয়ে থাকে ‘সূর্যোদয়ের মন্দির’। এর ঠিক উল্টোদিকে, ওয়াট ফো, শায়িত বুদ্ধমূর্তি। জনশ্রুতি, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বুদ্ধ মূর্তি।
আমার ভেতরে খেলা করে, প্রতিটি ধর্মের গভীর ছুঁয়ে ফেলার কৌতূহল। তাই এগিয়ে গিয়ে সুপীনকে জিজ্ঞেস করি; বলো তো বৌদ্ধধর্ম কেন পৃথিবীর অন্য ধর্ম থেকে আলাদা? পরক্ষণেই ওর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনে হতবাক। সে জানায়, আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা এবং মহৎ জীবন ব্যবস্থা, যা সূক্ষ্মনীতিবোধের উপর তৈরি। বুদ্ধ তাঁর ধর্ম গ্রহণের ভিত্তি হিসেবে যাবতীয় বিশ্বাসকে বর্জন করেছেন, তাই বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে জগতের একমাত্র যুক্তিনির্ভর ধর্ম।’
বিদেশ বেড়াতে যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা সবসময়ই কম। আবার বাঙালিদের ভ্রমণ পরিসংখ্যানে তাকালে দেখবেন দেশের অন্দরেই সবাই ভ্রমণপর্ব সারতে ওস্তাদ। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশিরা ভ্রমণপ্রেমী জাতি হলেও পকেটের দিকে কিন্তু সবাই সাবধান! তবে বাংলাদেশিদের ব্যাংকক ভ্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখানেই পরিচয় হলো সিলেটের বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা নাজমুল আলবাব ভাইয়ের সঙ্গে। জানালেন, সপরিবারে বেড়াতে এসেছেন। উঠেছেন এখানকার ‘অ্যাম্বাসেডর’ হোটেলে।
বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল কাছে, তাই আশপাশের হোটেলেও ব্যাপক সংখ্যক বাংলাদেশিরা অবস্থান করছেন। এখানে অবৈধভাবে থাকা যায় না, তবে সংখ্যায় অন্য দেশের চেয়ে স্বল্প হলেও অনেকেই ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে কাজ করছেন। আবার বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সংখ্যাও নগণ্য নয়, এক সুকুম্ভিট এলাকটাতেই ৭ থেকে ৮টি বাংলাদেশি রেঁস্তোরা। দোকান খোলতে এসে থাই নারীদের ভালোবাসায় অনেকেই আবার সংসারও খুলে বসেছেন! ‘অ্যাম্বাসেডর স্কোয়ার’ এর সামনেই রয়েছে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার ভেতরেই স্যুট ডেলিভারি দিতে সক্ষম বাংলাদেশি ‘স্কয়ার ইন্টারন্যাশনাল টেইলার’।
প্রতিষ্ঠানের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন, পুরো ব্যাংককে দশটির মতো টেইলার শপ রয়েছে।ব্যাংকক এক ব্যস্ত মহানগর। মানুষ এখানে হাঁটে না, ছুটে। এই যেমন রাত গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ, অথচ সন্ধ্যা সাতটা আর বারোটার মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে না পাওয়া! এখানকার প্রসিদ্ধ নাইট ক্লাবের উত্তেজনা ছুঁতে, টিকিট কেটে একটি ক্লাবে ঢুকলাম। গ্রাউন্ড ফ্লোরের পুরোটাই চকমকে আভিজাত্যে মোড়া। সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা ঝাড়বাতিটার আলো পৌঁছে ঘরটার প্রতিটি কোণায় কোণায় আর সর্পিল সুন্দরীদের শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে। সঙ্গে হালকা ভলিউমে চলছে থাই গান। চোখমুখের গড়ন আর গায়ের রঙ বলে দিচ্ছে কেউ কেউ রাশিয়ান, কেউ কেউ ভূমিকন্যা।
ছাদের উপরে উঁকি দিয়ে দেখি, মহা হুলুস্থুল, চলছে লাইভ মিউজিক। অ্যালকোহলের মাতোয়ারা গন্ধ, শরীরের শিরশিরানিতে একটা লোক টলছে। লাল হয়ে যাওয়া চোখ চোখ দুটো যেন ঝিমিয়ে পড়লো কিছুটা। ভাবলাম, লোকটা আবার উল্টে পড়ে যাবে নাতো! এর মধ্যেই দেখি, হড়হড় করে বমি করে ফেললো লোকটা!
সকালটা ঝকঝকে স্বচ্ছ। কয়েক ঘণ্টা শপিংমল হাতড়ে বাংলাদেশ থেকে বয়ে আনা ঝোলাটা ইতোমধ্যে অর্জন করেছে পূর্ণতা। হোটেল চেক আউট, গুছিয়ে নিচ্ছি জরুরি মালপত্তরগুলো। শেষবারের মতো আমাকে বিদায় জানাতে এসেছে সুপীন। কিন্তু একি! উচ্ছ্বলতায় ভরপুর এতো মিষ্টি একটি মেয়ে আজ এতো বিমর্ষ কেন? শিরদাঁড়া বেয়ে আমাকে গ্রাস করে ঠাণ্ডা স্রোত। নিস্পলক দৃষ্টিমেলে কাঁপা কাঁপা হাতে হ্যান্ডশেক!
এর অন্তর্নিহিত কারণ একটাই, গতরাতে মারা গেছেন থাই জনগণের প্রাণের রাজা ভূমিবল। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা এই রাজার জন্য পান খাওয়া লাল ঠোঁটের শ্যামদেশের লোকেরা আজ শোকের অশ্রুতে মুহ্যমান। সেই শোকে সমব্যথী হলাম আমিও।