শুধুমাত্র কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটানোই নয়, ফেনিল সাগরের মাঝে কোনো দ্বীপ ভ্রমণ করা শরীর ও মন দুটোর জন্যই স্বাস্থ্যকর। দ্বীপের সৈকতে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ যে কোনো মনের অস্থিরতাকে শান্ত করতে সক্ষম। তাছাড়া দ্বীপের সুস্থ কোলাহল অতি বার্ধক্যে পীড়িত মানুষের ভেতর থেকেও বের করে আনতে পারে শিশুসুলভ চঞ্চলতা। দ্বীপদেশ না হলেও নদীমাতৃক বাংলাদেশের আঙ্গিনার চরগুলো এই অভিজ্ঞতার ষোল আনাই পূরণ করতে পারে। আজকের আয়োজনে থাকছে সেরকম একটি অকৃত্রিম জায়গা- নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের নানা দিক।
নিঝুম দ্বীপ: সাগরের মাঝে এক টুকরো স্বর্গ
বাংলাদেশের দক্ষিণের বিভাগ চট্টগ্রামের নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হাতিয়া উপজেলার ছোট একটি দ্বীপ এই নিঝুম দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এই চরটি হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। চর ওসমান, বাউল্লারচর, কামলার চর, ও মৌলভির চর- এই চার চর নিয়ে পুরো নিঝুম দ্বীপ।
প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একরের এই দ্বীপটি সাগরের মাঝখানে জেগে ওঠে ১৯৪০ সালে। তারও প্রায় এক দশক পড় গড়ে ওঠে জনবসতি। দ্বীপটিকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল। ২০১৩ সালে হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র একটি ইউনিয়নের মর্যাদা পায় নিঝুম দ্বীপ।
নিঝুম দ্বীপের নামকরণ
জনবসতি গড়ে ওঠার একদম শুরুর দিকে এই দ্বীপের নাম ছিল চর ওসমান ও বাউল্লার চর। লোকমুখে শোনা যায়, এখানে বসতি গড়া প্রথম মানুষটির নাম ওসমান। তিনি ছিলেন একজন বাথানিয়া; আর তখন তার নামানুসারেই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছিল। শুধু সৈকতই নয়, দ্বীপের মাটিও বালুতে চিকচিক করতো। দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে দেখা যেতো বালুর ঢিবি বা টিলার মতো জায়গা। আর এই কারণেই বাইল্যার ডেইল বা বাউল্লার চর শব্দগুলো এই দ্বীপের নামের সঙ্গে জুড়ে যায়। এমনকি এখনও নিঝুম দ্বীপের অবস্থান জানার জন্য স্থানীয়দেরকে বাইল্যার ডেইল বা বাউল্লার চরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে হয়।
প্রথম বসতি গড়ের ওঠার সময় চরে প্রচুর চিংড়ি পাওয়া যেতো। চিংড়ির স্থানীয় নাম ইছা; তাই স্থানীয়দের কেউ কেউ একে ইছামতির চরও বলতো। ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটি একদম জনমানব শূন্য হয়ে যায়। ঝড় শেষে হাতিয়ার তৎকালীন সংসদ সদস্য আমিরুল ইসলাম কালাম দ্বীপটিতে পরিদর্শনে গিয়ে নাম বদলে দ্বীপের নাম নিঝুম রাখেন।
নিঝুম দ্বীপের দর্শনীয় স্থানসমূহ
নিঝুম দ্বীপের বিশেষত্ব হচ্ছে চিত্রা হরিণ ও শীতকালের অতিথি পাখি। একসঙ্গে এতো চিত্রা হরিণ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। আর সন্ধ্যা নামলেই শিয়ালের ডাক শিরদাঁড়া দিয়ে রোমাঞ্চের ঢেউ তোলে।
পাখি, হরিণ দেখতে হলে খুব ভোরে উঠতে হবে। আগে থেকেই কোনো স্থানীয় গাইডকে বলে রাখা যেতে পারে। তাহলে সঠিক জায়গায় যেতে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। স্থানীয় ছোট ছোট ছেলেরাই গাইডের কাজ করে। ওরাই সাধারণত পর্যটকদের ম্যানগ্রোভ বনের হরিণ দেখিয়ে নিয়ে আসে।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য এখানকার সেরা জায়গা নামা বাজার সৈকত। নামা বাজার থেকে পায়ে হেটে ১০ মিনিটের মধ্যেই সৈকতে পৌঁছা যায়। বারবিকিউয়ের জন্যও এ জায়গাটি বেশ জনপ্রিয়।
নিঝুম দ্বীপ ছাড়া পাখিদের মেলা বসে পাশের দ্বীপ কবিরাজের চর ও দমার চরে। পড়ন্ত বিকেলে কবিরাজের চরের কাছে চৌধুরীর খাল দিয়ে নৌকা করে কিছু দূর গেলেই চোখে পড়বে চিত্রা হরিণ। ট্রলার রিজার্ভ করা হলে মাঝিই হরিণ দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। ১০ থেকে ১৫ জনের জন্য ট্রলার ভাড়া পড়তে পারে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা।
তাজা ইলিশ খাওয়ার জন্য কমলার দ্বীপ সেরা জায়গা। জাতীয় উদ্যান এলাকা থেকে সাগর ঘোরার জন্য ৪০ জন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফাইবার বোট ভাড়া দেয়া হয়।
শীতের অতিথি পাখি দেখার জন্য এখানকার আরো একটি দর্শনীয় জায়গা হচ্ছে ভার্জিন আইল্যান্ড। দমার চরের দক্ষিণে নতুন সৈকতটিই ভার্জিন আইল্যান্ড। দমার চর ঘুরে আসতে হলে ট্রলার ভাড়া পড়বে প্রায় তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা। নিঝুম দ্বীপ থেকে একটু দূরের পথে দেখা মিলবে ভোলার ঢালচর আর চর কুকরি-মুকরি।
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময়
নিঝুম দ্বীপের সৌন্দর্য্যে আপাদমস্তক অবগাহন করার জন্য শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে শীত ও বসন্তকাল। হেমন্তের শেষলগ্নে তথা অক্টোবর থেকে এপ্রিলের ঠিক মাঝামাঝি সময়টাই উপযুক্ত সময়। এ সময় রাস্তাঘাট শুকনো থাকায় আশেপাশের যে কোনো জায়গায় যাওয়া যাবে। এছাড়া হরিণ দেখার জন্য বনের পথে হাটতে সুবিধা হবে।
বর্ষাকালে গেলে হাটু সমান কাদায় পুরো দ্বীপ হেটে ঘুরতে হবে। যানবাহন নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হবে। তবে ভোসন রসিকদের জন্য সুখবর হল যে এ সময়টাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় সেখানে। এছাড়া বছরের বাকিটা সময় মেঘনা নদী ও সাগর অনেক উত্তাল থাকে।
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার উপায়
সাগরের মাঝখানে হওয়ায় নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রার শুরুটা সড়ক পথে হলেও শেষব্দি জলপথ ব্যবহার করতেই হবে। বাসে চড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল অথবা ধানমন্ডির জিগাতলা বাস স্ট্যান্ড থেকে নোয়াখালীর সোনাপুর পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বাসের ধরণের উপর ভিত্তি করে এসব বাসে ভাড়া পড়তে পারে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা