আমাদের সামার ট্যুরের সর্বশেষ ভ্রমণ নিউ ইয়র্ক। আগেই বলেছি বোধ হয়, আমরা ভ্রমণ করছি প্রতিটা উইক এন্ড ধরে ধরে। কারণ এষার ল্যাব খোলা। আবার এক উইকেন্ডে উবারে করে রওনা হলাম গ্রীনভিল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। উবার চালক আমার মতই বয়স্ক। প্রথমে এষার সঙ্গে কিছুক্ষণ বক বক করল। তারপর আমাকে ধরল, আমি কি করি। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম আমি একজন কার্টুনিস্ট। এই প্রথম কারো চোখে মুখে একটু শ্রদ্ধার (!) ভাব দেখলাম বলে মনে হল। তার সাথে আমাার নিম্নরূপ কথা হল-
তুমি তাহলে কার্টুন আঁক?
– হু।
– কোথায় কার্টুন আঁক?
– তোমাদের দেশে একটা ম্যাগাজিন আছে, নাম ম্যাড। জানো?
– হ্যাঁ হ্যাঁ তরুণ বয়সে কত পড়েছি!
– আমরাও ছোটকালে ঐ ম্যাডের ভক্ত ছিলাম। তখন আমরা ঐ নামে “আনম্যাড” (উন্মাদ) একটা পত্রিকা করি। ওটা ম্যাডের মতই খুব জনপ্রিয় হয়, আমি ওটাতেই আঁকি। ওহ দারুন! আচ্ছা আমার একটা কার্টুন আঁকতে তুমি কত ডলার নিবে?
( হাসি) টাকা নিব না, এখনি আঁকছি। বলে কাগজ কলম নিয়ে তার একটা ক্যারিকেচার আঁকতে শুরু করলাম। গাড়ি তখন চলছে, ওর মধ্যেই মোটামোটি খারাপ আঁকলাম না। কারণ তার চেহারাটা কার্টুন ক্যারিকেচার আঁকার জন্য বেশ সহায়কই ছিল। তাকে দিলাম। সে মনে হল শিহরিত হল (নাকি অভিনয় করছে কে জানে! তাহলে অস্কার দিতে হবে)। গম্ভীর হয়ে বলল “তোমার এই কার্টুন একদিন আমি ৫০, ০০০ ডলারে বিক্রি করব।“ ততক্ষণে পিছনে এষা আর তার মা ফিক ফিক করে হাসতে শুরু করেছে। আমিও গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম “অবশ্যই” ।
মনে মনে ভাবলাম দেশে পুরো ৪৮ পাতা কার্টুন ভর্তি উন্মাদ ৩০ টাকায় কিনতে পাবলিক চিন্তা ভাবনা করে আর ইনি আমার একটা কার্টুন ৫০,০০০ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে… উফ!!যাহোক সে আমাদের এয়ারপোর্টে নামিয়ে জানাল, তার গাড়ীতে একবার এক বিখ্যাত কোম্পানীর মালিক উঠেছিল আর দ্বিতীয় ফেমাস এই আমি উঠলাম। কি জ্বালা! আমরা এয়ারপোর্টে ঢুকে গেলাম। তবে এবার আর আমরা প্রি চেকড নেই। নরমাল বোর্ডিং পাস। আগের মত জটিল চেক আপ সেরে ভিতরে ঢুকে এক সময় প্লেনে চড়ে বসলাম। প্লেনের নাম ডেলটা। দু ঘন্টার জার্নি। এই কদিনে প্রায় আট ন’বার প্লেনে চড়লাম। আমার বেশ প্লেন ভীতি ছিল এখন মনে হচ্ছে সেটা আর নেই, মন্দ কি।
নিউইয়র্কের লাগোয়ারডিয়া (Laguardia) নামে একটা এয়ারপোর্টে নামলাম। আমাদের নিতে আসল জাহাঙ্গির লেনিন, বহুদিন ধরে নিউইয়র্ক আছে। তার জীবনটা বেশ ইন্টারেস্টিং। তার বাংলাদেশী জীবনের কয়েকটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা নিয়ে আমি একবার একটা লেখা লিখেছিলাম। অবশ্য তার আমেরিকান জীবন সম্পর্কে খুব বেশী জানি না। তবে সে ইউএস আর্মিতে ছিল, তার স্নাইপার ট্রেনিং আছে। এখন সে আইটি বিষয়ক অন্য একটি পেশায় আছে। এই পেশাও বেশ জটিল। তবে শেষ কথা সে উন্মাদের সঙ্গেও আছে বহুদিন ধরে। যাহোক তার গাড়িতে আমার জন্য বেশ একটা চমক ছিল। গাড়ির নাম্বার প্লেটে লেখা “উন্মাদ”! এটাই তার গাড়ীর নাম্বার প্লেট। পরে জেনেছি এটাকে বলে কাস্টমাইজড নাম্বারপ্লেট। এর জন্য আলাদা টাকা দিতে হয়। সে বলল এখানে প্রায়ই তাকে লোকজন রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করে “এটা কি বাংলাদেশের সেই উন্মাদ?” সে মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ সেই উন্মাদ”।
যাহোক তার গাড়িতে করে নিউইয়র্কের রাস্তা ঘাট দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। অসম্ভব ব্যস্ত এক শহর। প্রচুর গাড়ি তবে জ্যামে পড়ছিলাম না। একসময় এসে থামলাম উডসাইড নামে এক জায়গায়। পথে জ্যাকসন হাইটসের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় বাংলা সাইনবোর্ড দেখে আমার স্ত্রী কন্যা উত্তেজিত হয়ে গেল। এক সময় আমাদের জন্য যে বাড়ি নির্ধারিত তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দোতলা টাউন হাউজ টাইপের বাড়ি। তিনটা বেড রুম, ড্রইংরুম, দুটো বাথরুম, রান্নাঘর কি নেই বাড়িতে! খুবই গোছানো। আমাদের দিয়েই নাকি এই বাড়ি উদ্বোধন করা হল। তখনও রেনভেশনের কিছু কাজ চলছিল।
টুরিস্টদের জন্য এ ধরনের বাড়িকে বলে “এয়ার বি. এন. বি.”। যাহোক ঐ বাড়িতে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা আবার বেরুলাম। প্রথমে গেলাম জ্যাকসন হাইটসে, ওখানে আজ বইমেলা শুরু হচ্ছে। কিন্তু নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে গাড়ি পার্কিং (ওয়াশিংটনেও, মানে বড় সব শহরে আরকি)। দেশে আমরা যেমন ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকি, এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে পার্কিং খোঁজা হয়! আমরাও খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পার্কিং পেলাম। গাড়ি রেখে বইমেলায় এলাম। পরিচিত অনেককেই পেলাম। অপরিচিত অনেকেই সালাম দিল, দু একজন ছবিও তুললো। আমার বেশ ভালই লাগল। মন্দ কি, এই বিদেশ-বিভুইয়ে মানুষজন আমাকে কার্টুনিস্ট হিসেবে চিনতে পারছে। প্রথম আলোর পরিচিত কয়েকজনকে দেখলাম। তারা অবশ্য বেশ ভাব নিল, আমাকে চিনতে পারল বলে মনে হল না কিংবা চিনতে চাইল না!!! এই মেলার উদ্যোক্তা বিশ্বজিতকেও পাওয়া গেল না। অথচ সে নাকি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! হলি কাউ, মতান্তরে পবিত্র গাভী!
বই মেলা থেকে বের হয়ে গেলাম টাইম স্কয়ারে। অনেক শুনেছি এই টাইম স্কয়ারের কথা। অসাধারণ এক জায়গা। না দেখলে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। বিশাল বিশাল সব জীবন্ত বিল বোর্ড, ঢেউয়ের মত বিল বোর্ডের লেখালেখি, ছবি ছুটে বেড়াচ্ছে। পথে এখানে সেখানে মিউজিক বাজিয়ে নাচানাচি হচ্ছে। এক জায়গায় দেখলাম স্যাক্সোফোন আর ড্রাম বাজিয়ে যাচ্ছে তিনজন তরুণ, অসাধারণ সুর! পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে পথচারীরা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে একটু নেচে নিচ্ছে। আরেক জায়গায় শুধু কিছু প্লাস্টিকের ডিব্বার উপর কাঠি দিয়ে দারুণ ড্রাম বাজাচ্ছে দুজন তরুণ। এ সমস্ত কান্ডকারখানা করছে কিন্তু বেশির ভাগই আফ্রিকান আমেরিকানরা। একটু পর পর রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে ছুটে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর দর্শন সব বাইক। কেউ এক চাকায় ছুটছে, কেউ দু চাকায়, কেউবা তিন চাকায়, চার চাকার বাইকও দেখলাম একটা। দেখার মত দৃশ্য বটে। হঠাৎ দেখি জন্মদিনের পোষাকে (!) দুই তরুণী (তাদের শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় আমেরিকান ফ্ল্যাগ আঁকা। মনে হবে আমেরিকান ফ্ল্যাগ দিয়ে কোন পোষাক পরে আছে, আসলে তা নয়!)। তাদের শরীরে কাপড় বলতে হাফ প্যান্ট এবং মাথায় গোঁজা শুধু একটা পালক। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কিছু মনে করছে না। কেউ কেউ তাদের সঙ্গে সেলফি তুলছে। তারাও হাসি মুখে পোজ দিচ্ছে। তবে তারা কোন কিছুর জন্য ডলার সংগ্রহ করছিল এবং টুরিস্টরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে ডলার দিচ্ছিল বলে মনে হল।
সত্যি অদ্ভুত এক শহর, যে শহর রাতে কখনো ঘুমায় না। The city that never sleeps! সব বিল্ডিংয়ে সারা রাত লাইট জ্বলে এটাই শহরের নিয়ম। ট্যুরিস্টরা দেখে অবাক হবে। ট্যুরিস্টদেরকে মুগ্ধ করার জন্যই নাকি এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া কিছু কিছু অফিস সারা রাত খোলা থাকে। ঘুরে টুরে অনেক রাতে আমরা ফিরে এলাম লেনিনের বাসায়, ওখানেই আমাদের রাতের খাবার। লেনিনের স্ত্রী স্বর্ণা আর দুই বাচ্চা প্রথমা আর রোদ কে এই প্রথম দেখলাম, তারা সবাই খুবই ভালো মানুষ। দারুণ সব দেশী খাওয়া দাওয়া হল। কিছুক্ষণ আড্ডা হল। লেনিনের মেয়ে প্রথমা দেখলাম ভাল শিল্পী। তার আঁকা বেশ কিছু ছবি দেখলাম আমরা। অনেক রাতে লেনিন আমাদেরকে আমাদের উডসাইডের বাসায় পৌঁছে দিয়ে এল।
পরদিন সকালে লেনিনের বাসায় নাস্তা করে আমাদের যাত্রা শুরু হল স্ট্যাচু অফ লিবার্টির উদ্দেশ্যে। যেতে হবে সাবওয়েতে। এষার শখ ছিল সাবওয়ে দেখার। সেই শখ এই বেলা পুরণ হল। এবার দলে আমরা ভারি, আমরা ছাড়াও ছিল লেনিন এবং তার দুই পুত্র-কন্যা। তাদের মা অবশ্য আসতে পারলেন না। কারণ তিনি উইকেন্ডে একটা জব করেন। দু তিনবার সাব ওয়ের ট্রেন পাল্টে আমরা পৌঁছালাম স্ট্যাচু অফ লিবার্টির দ্বার প্রান্তে। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখার বেশ কিছু ওয়ে আছে। এক নম্বর হচ্ছে ফেরিতে করে একদম ঐ দ্বীপেই নামিয়ে দিবে। একবারে হাত দিয়ে ছুয়ে ভাস্কর্যের গায়ে উঠে পড়া যাবে (ভিতর দিয়ে)। কিন্তু এটা কঠিন, কারণ এর জন্য অনেক আগে থেকেই অন লাইনে বুকিং দিতে হয়। এটা এই মুহূর্তে সম্ভব না। দ্বিতীয়টা হেলিকপ্টার সার্ভিস। আর তৃতীয়টা হচ্ছে একটা ফেরিতে করে আমরা একবারে দ্বীপের কাছাকাছি গিয়ে ঘুরে আসব। একদম কাছ থেকে দেখা, ছবি তোলা আরকি। আমরা তৃতীয়টাই বেছে নিলাম। ফেরিতে করে যেতে ঘন্টা খানেক লাগে। ফেরির নিচে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমি নিচে বসে রইলাম লেনিনের সঙ্গে। সময় হলে উপরে গেলেই হবে। বাকিরা উপরে। বেশির ভাগই উপরে কারণ স্ট্যাচু অফ লিবার্টি কাছে চলে এলে ছবি তুলতে হবে না?
একসময় আমরাও উপরে উঠে এলাম। খুব কাছ থেকে দেখলাম স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, আসলেই একটা বিস্ময়! এত জায়গায় এর এত ছবি দেখেছি এখন সামনা সামনি দেখা অবশ্যই অন্যরকম এক অনুভূতি। সবাই পাগলের মত ছবি তুলছে। সেলফি তুলছে। আমার হয়েছে মুশকিল, এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছি আমার সামনে দুই ফরাসী। তাদের দুজনের সাইজও ঐ স্ট্যাচু অফ লিবার্টির মতই, তাদের জন্য কিছু দেখতে পাই না। পরে ঐ জায়গা ছেড়ে এষারা যেখানে দাঁড়িয়েছে ওখানে গেলাম ঠেলেঠুলে। ওখান থেকে দিব্যি দেখা গেল।
খুব শীঘ্রই ফিরে এলাম। যাওয়ার সময় আমরা গিয়েছিলাম ছাদ খোলা দোতলা বাসে চড়ে। ফেরার পথে হেঁটেই আমরা অন্য একটা সাবওয়ে স্টেশনে গেলাম। আবার দু একটা ট্রেন এদিক ওদিক করে আমরা এলাম বিখ্যাত সেন্ট্রাল পার্কে। এত বড় পার্ক চিন্তা করাই মুশকিল। পার্কের ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা আছে যেখান দিয়ে শুধু সাইকেল চলে। কত ধরনের সাইকেল, স্কেটিং, রোলার বোর্ড যে দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। বসে বসে অনেকক্ষণ দেখলাম। তিন চার চাকার সাইকেলও দেখলাম, এক সঙ্গে পুরো পরিবার প্যাডেল মারছে (চারকোনা চাকার সাইকেল অবশ্য দেখলাম না)। সত্যি দেখার মত দৃশ্য! ইতোমধ্যে আমাদের ক্ষিধে লেগেছে। লেনিনের বাচ্চারা চলে গেছে আগেই। আমরা চারজন আছি। রাস্তার ফুডকার্ট থেকে খাবার কেনা হল, তারপর পার্কে বসে মিনি পিকনিক। বেশ মজাই হল, অনেকেই দেখলাম আমাদের মত মিনি পিকনিক করছে।
খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা উবার নিয়ে গেলাম একটা মিউজিয়ামে, সংক্ষেপে যার নাম “মেট” ( মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট)। Ticket পঁচিশ ডলার করে। কিন্তু লেনিন যেহেতু নিউইয়র্কবাসি তাই তার ticket লাগে না, তার গেস্টদেরও লাগে না। তবে ভদ্রতা করে যদি কেউ কিছু ডোনেট করে। দারুণ মিউজিয়াম। কিছুক্ষণ ঘুরে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। আমি আর লেনিন বসে গল্প করতে লাগলাম। এষা এবং রীতা ঘুরতে লাগল চরকির মত। একদম শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা দেখল। তাদের দুজনেরই তখন মাথা পুরোপুরি নষ্ট। ন’টা পর্যন্ত দেখেও শেষ করা গেল না। ন’টায় বন্ধ হয়ে গেল মিউজিয়াম। আমরাও বেড়িয়ে এসে আবার সাব ওয়ে দিয়ে দু তিনটা ট্রেন বদলে লেনিনের বাসায় এসে পৌঁছলাম। সেখানে আবার ১৪-১৫টা বাঙালি পদ দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে বাসার জন্য রওনা হলাম। সেদিনের মত বিশ্রাম।
লেখকঃ কার্টুনিস্ট/ সম্পাদকউম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা