রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৩ অপরাহ্ন

নারায়ণগঞ্জ থেকে উধাও ওসমান পরিবার

  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪

এম ওসমান আলী জনহিতকর কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘খান সাহেব’ উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের দমন-নীতির প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধিও বর্জন করেন। ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলনেও ছিল তার বড় ভূমিকা। ওসমান আলী সম্পাদিত পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসিমউদ্দীন প্রমুখ। ওসমান আলীর ছেলে একেএম সামসুজ্জোহাও ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সুপরিচিত সমাজপতিদের একজন। এমন দুই পূর্বপুরুষের হাত ধরে নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের মানমর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যাপক পরিচিতি পায় এবং আপামর মানুষের সমীহ আদায় করে নেয়। কিন্তু সামসুজ্জোহার পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ তার ছেলে নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমানের আমলে নানা সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয় ওসমান পরিবার। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিপত্তি এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, নির্যাতন-নিপীড়ন, বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনসহ নানা গুরুতর অভিযোগ উঠে আসে। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক হয়ে পড়ে যে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এই ওসমান পরিবার। শুধু তাই নয়। এই পরিবারের বিরুদ্ধে এতটাই জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে যে, তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে রীতিমতো ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চলেছে।

একাধিক সূত্রের খবর, শামীম ওসমানকে সর্বশেষ দুবাইয়ে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সেলিম ওসমান এবং প্রয়াত নাসিম ওসমানের পরিবারকেও আর নারায়ণগঞ্জে দেখা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জে স্কুলছাত্র ত্বকী হত্যা, চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডারসহ আরও একাধিক হত্যাকাণ্ডে বারবার ওসমান পরিবারের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে। কিন্তু এর পরও এ পরিবারের সদস্যরা আইনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। অবশেষে হাসিনা সরকারের পতনের পর শামীম ওসমান, সেলিম ওসমানসহ তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে এখন একের পর এক মামলা হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমান সরকার পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বলে একাধিক সূত্রের খবর। সরকার পতনের কয়েক দিন পর তাকে দিল্লির একটি মাজারে দেখা গিয়েছে বলেও সংবাদ আসে গণমাধ্যমে। সাবেক এমপি নাসিম ওসমান ও সেলিম ওসমানের পরিবার কোথায় পালিয়ে গেছে, সে সম্পর্কে এখনো কোথাও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া প্রয়াত নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানকে হন্যে হয়ে খুঁজছে র‌্যাব। নারায়ণগঞ্জের মেধাবী শিক্ষার্থী ত্বকী হত্যা মামলার প্রধান আসামি তিনি। অথচ হাসিনা সরকারের পতনের কদিন আগেও নারায়ণগঞ্জ শহর চলত ওসমান পরিবারের কথায়। আজমেরী ওসমানও তখন ছিলেন প্রকাশ্যে। কিন্তু সরকার পতনের পর এসব দৃশ্যপটও উধাও হয়ে গেছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য, ১৯৯৬ সালে শামীম ওসমান এমপি হওয়ার পর থেকে নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের ঐতিহ্য ও খ্যাতির পতন শুরু হয়। শামীম ওসমান লালিত ক্যাডার বাহিনীর কাছে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পুরো নারায়ণগঞ্জ ছিল জিম্মি। তখনই লোকমুখে শামীম ওসমান হয়ে ওঠেন ‘গডফাদার’। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর শামীম ওসমান আইনি বেড়াজাল থেকে দূরে থাকতে ভারত হয়ে কানাডায় পালিয়ে যান। সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে ২০০৬ সালের শেষদিকে ফের দেশে আসেন। কিন্তু ২০০৭ সালে ‘ওয়ান ইলেভেনের’ একদিন আগে তিনি আবার দেশ ছাড়েন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হলে এপ্রিলে তিনি আবার দেশে ফেরেন। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করে হেরে যান সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে। এরপর ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি হয়ে নারায়ণগঞ্জে ফের নিজের ক্ষমতাকে আরও শক্ত করেন শামীম ওসমান।

এদিকে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর সংবাদে প্রথমেই হামলা চালানো হয় নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের বাড়িতে। ক্ষুব্ধ জনতা বাড়িটি ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেয়। ৫ আগস্ট বিকালের দিকে তোলারাম কলেজ সড়ক এলাকায় নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের বাড়িতে হামলা চালায় ক্ষুব্ধ জনতা, তার টর্চারসেল হিসেবে পরিচিত অফিসেও চলে ভাঙচুর। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আজমেরীর বাড়িতে হামলাকালে কোটি টাকা মূল্যের ৩টি গাড়ি ভেঙে যন্ত্রাংশ ও অনেক মূল্যবান আসবাব লুট করা হয়। এ সময় ওই বাড়ি থেকে বিদেশি কুকুর, মদ, বিয়ারও নিয়ে যেতে দেখা যায় অনেককে। পরে বঙ্গবন্ধু সড়কের নাসিম ওসমান প্লাজাতেও চলে ভাঙচুর। চাষাঢ়ায় সেলিম ওসমানের বাড়ি, জামতলায় শামীম ওসমানের বাড়ি, চাষাঢ়ার হিরা মহল ও বায়তুল আমান ভবনও ভাঙচুর করে ক্ষুব্ধ জনতা। নারায়ণগঞ্জের জামতলার এমপি গলি এলাকায় শামীম ওসমানের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে। সরকার পতনের দিন বিকালে সেই বাড়িটিতেও হামলা, লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

সরকার পতনের পর শামীম ওসমানের ওই বাড়িটিতে গিয়ে দেখা গেছে এক ভিন্ন চিত্র। যে বাড়িতে বসে একসময় দোর্দণ্ড প্রতাপে নারায়ণগঞ্জবাসীর ওপর ছড়ি ঘোরাতেন শামীম, বিশাল সেই আলিশান বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত; ইটের দেয়াল ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। খুলে নেওয়া হয়েছে সদর দরজাও। শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের ব্যবসায়িক কার্যালয় রুপায়ণের বহুতল ভবনেও ভাঙচুর হয়।

ওসমান পরিবারের আরেক সদস্য নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ফতুল্লায়। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তিনি ছিলেন ব্যবসায়িক নেতা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই তিনি নিট ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি ছিলেন। সরকার পতনের পর থেকে তিনিও সপরিবারে উধাও হয়ে গেছেন।

নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবার ছিল ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের কাছে এক আতংকের নাম। শুধু শামীম ওসমানই নন, তার পরিবার ও অনুসারীরাও ছিলেন ত্রাস সৃষ্টিকারী। তাদের ছিল বেশ কয়েকটি টর্চার সেল, যেখানে লোকজন ধরে এনে বর্বর নির্যাতন চালানো হতো। এসব টর্চার সেলের হোতা ছিলেন শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, ঘনিষ্ঠ অনুসারী শাহ নিজাম ও ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান রিয়াদসহ অনেকেই। আওয়ামী লীগপন্থি অনেকেও তাদের অনুসারী না হওয়ার কারণে ওসমান পরিবারের রোষানলে পড়েন।

নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া রাইফেলস ক্লাব ছিল শামীম ওসমান ও তার অনুসারীদের আখড়া। রাইফেলস ক্লাবকে ব্যবহার করা হতো শামীম ওসমানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মতো। বিভিন্ন বিচার সালিশ, বৈঠক, সভা সবই হতো এখানে। পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে দমনে এ ক্লাবে নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হতো। নানা অপকর্মের নির্দেশও দেওয়া হতো এখান থেকেই।

নারায়ণগঞ্জ থেকে বিলুপ্ত নসিব পরিবহনের মালিকরা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘রাইফেলস ক্লাবে ডেকে নিয়ে নসিব পরিবহনে নতুন এমডি বসানোর জন্য চাপ দিয়েছিলেন শামীম ওসমান এমপি হওয়ার আগেই। আর এমপি হওয়ার পর এই বাসের পুরো ব্যবসাই দখল করে নেয় শামীম ওসমানের লোকজন।’ এমন অসংখ্য অত্যাচার-নির্যাতনের কাণ্ডের জেরে এই ক্লাবের প্রতিও সৃষ্টি হয় জনক্ষোভ। তাই সরকার পতনের একদিন আগে আগুন দেওয়া হয় ক্লাবটিতে।

সরকারি তোলারাম কলেজের ছাত্র সংসদও ছিল শামীম ওসমানের মদদপুষ্ট টর্চার সেল। সাধারণ শিক্ষার্থী, ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী তো বটেই, সাংবাদিকদেরও এ টর্চার সেলে এনে নির্যাতন করা হতো। ছাত্র সংসদের কক্ষ দখল করে সেখানে নির্যাতন চালাত স্বঘোষিত ভিপি ও মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শামীম-অনুসারী হাবিবুর রহমান রিয়াদ। সংবাদ প্রকাশের জের ধরে এখানে মারধর করা হয় একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি সৌরভ হোসেন সিয়ামকেও। ৫ আগস্ট এই টর্চার সেলও গুঁড়িয়ে দেয় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। আল্লামা ইকবাল রোডে শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলের কথা বিভিন্ন সময় উঠে আসে গণমাধ্যমে। উইনার ফ্যাশন নামক একটি কারখানায় ছিল তার টর্চার সেল। অভিযোগ আছে, এখানে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ত্বকীকে। টর্চার সেল থেকে ত্বকীর রক্তমাখা প্যান্ট উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ঘটনার পর আজমেরী তার টর্চার সেল সরিয়ে নেয় নিজ বাসার নিচতলায়।

ওসমান পরিবারের রোষাণলে মারাত্মক মাশুল দিতে হয়েছে ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বীকে। বিভিন্ন সময় ওসমান পরিবারের সদস্যদের চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তিনি। এর জেরেই খুন হতে হয়েছে ত্বকীকে। ২০১৩ সালে অপহরণের পর বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে ত্বকীর লাশ ফেলা হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।

রফিউর রাব্বি আমাদের সময়কে বলেন, ওসমান পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সময় নানা রকম জুলুম নির্যাতন করেছে। হত্যা, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যেখানে ওসমান পরিবার ছিল না। তাদের সরাসরি আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। তিনি সংসদে দাঁড়িয়েও সরাসরি ওসমান পরিবারের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তারই প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত পর্যন্ত বন্ধ ছিল। তিনি বলেন, আমরা চাই না ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের মতো আর কোনো মাফিয়া তৈরি হোক।

নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম আমাদের সময়কে বলেন, ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলায় আমার বাসায় গভীর রাতে বোমা হামলা করা হয়। তারা নারায়ণগঞ্জ শহরে এমন কোনো খাত নেই যেখানে চাঁদাবাজি করেনি। নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সাবেক সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল ছিল এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক। রাইফেলস ক্লাব ছিল চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র। এখানে বসেই নারায়ণগঞ্জের পরিবহন, সুতা ব্যবসা, ফুটপাতের চাঁদাবাজি, গার্মেন্টস সেক্টরে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা হতো। আর জমি দখলের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করত শামীমের আরেক সেনাপতি শাহ নিজাম। তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, প্রশাসন কখনো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নারায়ণগঞ্জে নতুন করে আর কোনো গডফাদারের উদয় হোকÑ এটা চান না বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com