শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:০১ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

নাফাখুম ঝর্না

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০২১

পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলাগুলোর মধ্যে বান্দরবান অন্যতম। চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে পাহাড়ী শহর বান্দরবানের অবস্থান। এ জেলার আয়তন ৪৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার। বান্দরবান জেলার উত্তরে রাঙ্গামাটি জেলা, দক্ষিণে আরাকান, মায়ানমার, পূর্বে, ভারতের মিজোরাম ও মায়ানমার, পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা।

বান্দরবন জেলার থানচি একটি উপজেলার নাম। এই উপজেলার একটি এলাকার নাম রেমাক্রি। এটি একটি মারমা অধ্যুষিত এলাকা। বান্দরবান জেলার যে স্থানগুলোর কারণে এই জেলাটি পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকা জেলাগুলোর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে তার একটি হচ্ছে ‘নাফাখুম ঝর্না’। আর এই রেমাক্রি গ্রামটিকে কেন্দ্র করেই এই নাফাখুম ঝর্নাটি অবস্থিত।

রেমাক্রি থেকে প্রায় ২:৪৫-৩ ঘন্টার হাটা দূরত্বে এই ঝর্নাটি অবস্থিত। রেমাক্রি খালের পানি প্রবাহ এই স্থানে এসে বাক খেয়ে প্রায় ৩০ ফুট নিচে পতিত হয়ে প্রকৃতির অপরূপ ছোয়ায় সৃষ্টি হয়ে অসাধারণ এই ঝর্নাটি।

ইতিহাস ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা যায়, স্থানীয় মারমা ভাষায় ‘খুম; শব্দের অর্থ ঝর্না। এছাড়া রেমাক্রী নদীতে এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়, যার নাম নাফা মাছ। এই মাছ সবসময় স্রোতের ঠিক বিপরীত দিকে চলে। বিপরীত দিকে চলতে চলতে মাছগুলো যখন লাফিয়ে ঝর্না পার হতে যায় ঠিক তখনই উপজাতীয়রা লাফিয়ে ওঠা মাছগুলোকে জাল বা কাপড় দিয়ে ধরে ফেলে। এ থেকে এই ঝর্নার নাম দেওয়া হয়েছে নাফাখুম ঝর্না।

নাফাখুম ঝর্নার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

  • উপরে খোলা আকাশে রৌদ্র-মেঘের লুকোচুরি আর নিচে খরস্রোতা নদীর ধেয়ে আসা ছল ছল শব্দ। সব মিলিয়ে এ যেনো স্রষ্টার এক অপরূপ সৃষ্টি।
  • চারিদিকে পাহাড়-পর্বত, নদী ও পাথুরে খাল দেখে যে কারো মনে হতে পারে যেনো শিল্পীর আকা কোনো ছবি চোখের সামনে ভাসছে।
  • বর্ষাকালে ঝর্না দিয়ে তীব্র গতীতে বড় হয়ে পানি নিচের দিকে পতিত হয় এবং গ্রীষ্মকালে তীব্রতা কমে যায় ও ঝরনার আকার ছোট হয়ে আসে।
  • তবে যারা নাফাখুম ঝর্নার প্রকৃত সৌন্দর্য দেখতে চান তারা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের মধ্যে ভ্রমণ করলে তা দেখতে পারবেন। এই সময় উপর থেকে আছড়ে পড়া পানির প্রচন্ড আঘাতে ঝর্নার চারপাশে অনেকটা স্থান জুড়ে সৃষ্টি হয় ঘন কুয়াশার সেই সাথে উপর থেকে নিচে পানি পতিত হওয়ার আওয়াজ তো রয়েছেই।
  • বাতাসের সাথে উড়ে যাওয়া পানির বিন্দু পর্যটকদের দেহ মন সব আনন্দে ভিজিয়ে দেয়। যা কিনা মুহুর্তের মধ্যে যে কারো মন ভালো করতে সক্ষম।
  • এই স্থানের কিছু কিছু পাহাড় বেশ উচু। দেখে মনে হবে সেই সেই পাহাড়গুলোর চুড়া মেঘের আবরণে ঢাকা পড়েছে।
  • পাহাড়ের ঢালে মাঝে মাঝে রয়েছে টিনের ঘরবাড়ি।
  • এই এলাকার নদীগুলোর গভীরতা খুব কম। কোনো কোনো স্থানে পানির নিচের মাটি দেখা যায়। তবে নদীগুলো সবসময় প্রচন্ড স্রোত থাকে। তাই পথ চলতে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

তিন্দু ও বড় পাথর

  • বান্দরবান থেকে নাফাখুম যাওয়ার পথে পর্যটকদের তিন্দু ও বড় পাথর নামক দুটি স্থান পাড়ি দিতে হয়।
  • অসাধারণ সুন্দর এই তিন্দুতে একটি বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে।
  • তিন্দুতে পর্যটকদের জন্য রাতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
  • তিন্দু থেকে কিছুটা পথ সামনে এগোলেই বড় পাথর। স্থানীয়দের বিশ্বাস চলতি পথে এই পাথরকে সম্মান প্রদর্শন করতে হয় নতুবা যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। স্থানীয় লোকজন এই পাথরকে রাজা পাথর বলে সম্বোধন করেন।
  • বড় পাথর একটি বিশাল আকারের পাথর এবং এর আশে পাশে আরও বেশ কিছু ছোট ছোট পাথর নদীর সোজা চলতি পথকে কয়েকটি বাকে ভাগ করে রেখেছে। যে কারণে এই স্থানে এলে পর্যটকদের নৌকা থেকে নেমে হেটে পাড়ি দিতে হয়।
  • স্থানীয়দের মতে, বহু বছর আগে ভূকম্পের ফলে পাশের পাহাড় হতে বিশাল বিশাল আকারের এই পাথরগুলো নদীতে এসে পড়েছে।
  • বড় পাথর থেকে ঘন্টা খানেকের পথ পাড়ি দিলেই রেমাক্রী বাজারের দেখা মিলবে। পর্যটকদের মতে, তিন্দু ও বড় পাথর স্থান দুটো পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা নাফাখুম ঝর্না দেখার সবচাইতে বড় আনন্দ।

রেমাক্রী বাজার

রেমাক্রী বাজার আসলে খুব ছোট একটা বাজার। আমাদের গ্রামদেশের বাড়ির মতো মাঝখানে বড় উঠোন ও চারপাশে ঘর এমনভাবে এই বাজারের গঠন। উল্লেখ্য এই বাজারে যাদের দোকান রয়েছে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দোকানের পেছনের অন্য আরেকটি ঘরেই বসবাস করেন। রেমাক্রী বাজারের পাশেই পর্যটকদের জন্য একটি রেষ্ট হাউজ রয়েছে। আর রেষ্ট হাউজের পাশেই রয়েছে বিজিবি-র একটি ক্যাম্প। রেমাক্রী বাজার হতে ২.৩০/৩ ঘন্টার মতো হাটা দুরত্বে নাফাখুম ঝর্না অবস্থিত। রেমাক্রী বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কুল ধরে হেটে নাফাখুম ঝর্নায় যেতে হয়। এই পথের দু পাশের মনোরম দৃশ্যের কারণে পায়ের নিচের পাথুরে ও বালুকাময় পথটিও পর্যটকদের নিকট অনেক ভালো মনে হয়। এই পথ ধরে নাফাখুম ঝর্নার কাছে যেতে পর্যটকদের বার কয়েক কোমড় থেকে বুক সমান পানি পাড়ি দিতে হয়। পানিতে স্রোত থাকায় এই পথ পাড়ি দেওয়ার সময় পর্যটকদের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। পথে যেতে যেতে পর্যটকদের টারজানের মতো গাছের লতা-পাতায় ঝুলেও পথ পাড়ি দিতে হয়। এভাবে যেতে যেতে পথে ছোট ছোট আরও ১০টির মতো ঝর্না চোখে পড়বে। শীতল ঝর্নার পানি গায়ে পড়তেই সমস্ত ক্লান্তি ঝর্নার পানির সাথে মিশে রেমাক্রী খালে গিয়ে পতিত হবে। আমাদের অনেকেরই আমাজান নদী দেখা বা পাড়ি দেওয়ার সৌভাগ্য হয় নি। তবে বলে রাখতে পারি এই পথ পাড়ি দেওয়ার সময় টিভিতে দেখা আমাজন নদীর দৃশ্যের সাথে অনেকটাই মিল পাবেন। যার ফলে ভ্রমণ আরও রোমাঞ্চকর হতে বাধ্য। এভাবে একের পর এক রোমাঞ্চকর বাধা পেরিয়ে অবশেষে দেখা মিলবে সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত নাফাখুম ঝর্না।

যাতায়াত ব্যবস্থা

ঢাকা থেকে বান্দরবান যেতে আপনি ২/৩ টি রুট ব্যবহার করতে পারেন। ঢাকা থেকে ট্রেনে, বাসে বা প্লেনে প্রথমে চট্টগ্রাম তারপর চট্টগ্রাম থেকে সোজা বান্দরবান। বান্দরবন হতে ৭৯ কিমি. দুরে অবস্থিত থানচি। বান্দরবন হতে পাবলিক বাস অথবা জীপ অথবা চান্দের গাড়িতে করে থানচি যেতে হয়। তবে পাবলিক বাসের চাইতে জীপ অথবা চান্দের গাড়িতে করে গেলে পথের সুন্দর সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। সাঙ্গু নদীর পাড়ে অবস্থিত থানচি বাজার। থানচি পৌছানোর পর সেখান থেকে যেতে হবে ক্রেমাক্রী বাজার। রেমাক্রী বাজার হতে নাফাখুম ঝর্নার কাছে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন সাঙ্গু নদীর নৌকা। এখানে আপ-ডাউন ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাওয়া যায়। এই নৌকা ভাড়া করার জন্য পর্যটকদের থানচি ঘাটে অবস্থিত নৌকাচালক সমিতির সাথে কথা বলতে হয় এবং সেখান থেকে বিজিবি-র তালিকাভুক্ত একজন গাইড নিতে হয়। এই পথে ভ্রমণে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয় নৌকাচালক সমিতির অফিসে পর্যটকদের নাম, ঠিকানা, পিতার নাম, মোবাইল নম্বর, নৌকার মাঝির নাম প্রভৃতি রেজিস্টার করে ভ্রমণের অনুমতি নিতে হয়। রেমাক্রী থেকে নাফাখুম ঝর্নায় যাওয়ার কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। অবশিষ্ট পথটুকু পর্যটকদের পায়ে হেটে পাড়ি দিতে হয়। রেমাক্রী পৌছার পর থানচি বাজার থেকে সাথে নেওয়া গাইডকে রেখে রেমাক্রী থেকে নতুন আরেকজন গাইড সাথে নিতে হয় এবং বিজিবি ক্যাম্পে পর্যটকদের নাম, ঠিকানা রেজিস্ট্রার করে ভ্রমণের অনুমতি নিতে হয়। উল্লেখ্য দিনে গিয়ে দিনেই নাফাখুম ঝর্না থেকে থানচি ফিরে আসাটা খুবই কষ্টকর। তাই আপনি চাইলে রেমাক্রীতে রাত্রি যাপন করে চারপাশটা ভালোভাবে ঘুরে ফিরে দেখে আসতে পারেন। আর যারা দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে চান তাদেরকে ভোর ৬/৭ টার মধ্যে থানচি থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে। রেমাক্রী বাজার হতে জোরে হাটলে ২ ঘন্টা এবং ধীর পায়ে হাটার ক্ষেত্রে নাফাখুম ঝর্নায় পৌছতে ৩ ঘন্টার মতো সময় লেগে যায়।

সাঙ্গু নদীর বর্ণনা

থানচি বাজারের পাশে সাঙ্গু নদী অবস্থিত। এই সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রীর দিকে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে হয় নৌকা বেঁয়ে। উপরে উঠতে হয় এই কারনে যে বস্তুত নদীটা রেমাক্রী হতে থানচির দিকে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে এসেছে আর এই কারনে এখানে সবসময় স্রোত থাকে। নদীর কিছুদূর পর পর ১-২ ফুট এমন কি কোথাও কোথাও ৪/৫ ফুট পর্যন্ত ঢালু হয়ে নিচে নেমেছে।

থাকার ব্যবস্থা

  • পর্যটকদের থাকার জন্য থানচিতে একটি রাষ্ট্রীয় রেষ্ট হাউজ রয়েছে। এছাড়া থানচি নৌকা ঘাটে পর্যটকদের থাকার জন্য স্থানীয় লোকজন কিছু ঘর বানিয়ে রেখেছে। এসব ঘরে থাকার জন্য অতিরিক্ত কোনো টাকা দিতে হয় না। ঐই ঘরের মালিকের দোকানে তিনবেলা খাওয়া-দাওয়া করলেই থাকা ফ্রি।
  • তিন্দুতে পর্যটকদের থাকার জন্য উপজাতীয়দের ঘর রয়েছে। নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে উপজাতীয়রা এসব ঘর পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেয়।
  • রেমাক্রী বাজারেও একটি রেষ্ট হাউজ রয়েছে। এছাড়া থানচির মতো উপজাতীয়দের দোকানে তিন বেলা খাবার খেলে থাকা ফ্রি।

ভ্রমণে করণীয় ও পালনীয়

  • ঢাকা বা বান্দরবান থেকে যাত্রা শুরু করার আগে পর্যটকদের নিজ নিজ নাম, ঠিকানা, পিতার নাম, মোবাইল নাম্বার প্রভৃতি একটি কাগজে লিখে সেই কাগজটি ১০/১২টি ফটোকপি করে সাথে নিতে হবে। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে এই কাগজ জমা দিতে হয়।
  • বান্দরবান থেকে নাফাখুম যেহেতু অনেকটা পথ এবং পথিমধ্যে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয় তাই সাথে ভারী কোনো জিনিস না নেওয়াই ভালো।
  • যতটা কম সম্ভব কাপড়-চোপড় নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
  • মশা হতে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ওডোমস ক্রিম সাথে করে নিতে হবে।
  • যেহেতু বেশ কিছুটা পথ নদীপথে হাটতে হবে তাই পিছলে যায় না এমন রাবার বা প্লাস্টিকের পায়ের সাথে সাইজ অনুযায়ী স্যান্ডেল পরতে হবে। ছোট/বড় হলে তা আরও বিপত্তি বয়ে নিয়ে আসতে পারে।
  • ভ্রমণে আনন্দদায়ক করতে যাত্রাপথে টি-শার্ট ও থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়তে হবে।
  • রেমাক্রী বাজার হতে নাফাখুম এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার আগে রেমাক্রী হতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ শুকনো খাবার ও খাবার পানি সাথে করে নিতে হবে।
  • ফাস্ট এইড বক্স ও টর্চ লাইট সাথে রাখতে হবে।
  • সবশেষে আপনাদের ভ্রমণ আনন্দ, নিরাপদ ও সুন্দর হোক এই কামনা করছি।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com