শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৬ অপরাহ্ন
Uncategorized

নাগাল্যান্ড

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১

বছর দুই-তিন আগের কথা। জিওলজিতে মাস্টার্স করছি তখন। এমনিতেই আমাদের প্রতিবছর দূর-দূরান্তে ফিল্ড করতে যেতে হত। কিন্তু সে বছর যখন শুনলাম আমাদের ফিল্ড লোকেশন, নিজেদের কানকেই বিশ্বাস করতে পারিনি! নাগাল্যান্ড যাব আমরা? কেমন হবে জায়গাটা? লোকজন কেমন সেখানকার? ওখানে নাকি কুকুরের মাংস খায়? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরছিল মাথায়। তারপর এক শীতের দুপুরে প্রচুর এক্সাইটমেন্ট আর পিঠে বিশাল রুকস্যাক নিয়ে শুরু হল আমাদের যাত্রা। স্টুডেন্ট, প্রফেসার, কুক মিলিয়ে ৩০-৩৫ জনের দল, যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় ১৫ দিনের ফিল্ড।

আমরা যেখানে যাব সেই জায়গাটার নাম ওয়াজ়িহো, ফেক জেলার অন্তর্গত। ট্রেনে ডিমাপুর পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে যেতে হবে। হাও়ড়া থেকে ট্রেনে ডিমাপুর যেতে সময় লাগে প্রায় ২৮ ঘণ্টা। দু’রাত ট্রেনে কাটানোর পর যখন ডিমাপুর স্টেশনে নামলাম তখন রাত হয়ে গিয়েছে। নেমেই অনুভব করলাম, বেশ ঠান্ডা। আজকের রাতটা আমরা ডিমাপুরেই স্টেশনের কাছে একটা হোটেলে থাকব। ডিমাপুর ছোট শহর হলেও গাড়ি, বড় দোকান, হোটেল, কিছুরই অভাব নেই। পরের দিন সকালে শুরু হবে ওয়াজ়িহোর উদ্দেশ্যে যাত্রা। তখনও জানি না কী অ্যাডভেঞ্চার অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য! পরের দিন তিনটে গাড়িতে ভাগ করে আমরা রওনা দিলাম। ডিমাপুর থেকে ওয়াজ়িহো ২৯৬ কিমি, গাড়িতে সময় লাগার কথা প্রায় ১২.৩০ ঘণ্টা। এতটাই দূর এবং অপরিচিত ছোট্ট একটা গ্রাম যে ডিমাপুরের প্রায় কোনও মানুষ নাম শুনে চিনতেই পারলেন না জায়গাটা!

তাহলে পৌঁছব কী করে? আমাদের একজন প্রফেসার আগে গিয়েছিলেন সেখানে। তিনিই তিনটে গাড়ির ড্রাইভারকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিলেন। আমরা সঙ্গে বেশ ভাল মতোই গরম জামা রেখেছিলাম, কারণ নাগাল্যান্ডের পাহাড়ের উপরে প্রবল ঠান্ডা পড়ে। এন এইচ ২৯ এবং ২০২ হয়ে পাহাড়ের উপর দিকে উঠতে লাগল গাড়ি। পথে পেরিয়ে এলাম নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা ও নাগাল্যান্ড-মণিপুরের বর্ডারে ছবির মতো গ্রাম মেলুরি।কোহিমাতেদেখলাম বেশ বড় একটা বাজার। পথে পেরিয়ে এলাম মিলিটারি চেক পোস্টও। নাগাল্যান্ডে ঢুকতে হলে এখানে আই ডি প্রুফ ও পারমিট দেখিয়ে যেতে হয়।বিকেলবেলা এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা খাওয়া হল। নির্জন পাহাড়ি রাস্তার মাঝে ওই একটাই ছোট্ট দোকান। চা খাওয়ার জন্য গাড়ি থেকে নেমে ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাওয়ার অবস্থা! আমাদের পুরো ট্রিপেই এরপর সঙ্গী ছিল সেই হাড়-কাঁপানো ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

পাহাড়ি পথে এরপর অন্ধকার নামতে শুরু করল কিছুক্ষণের মধ্যেই। রাত ১০টা, ১১টা… পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে কিছুই বুঝতে পারছি না। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, গাড়ির হেডলাইটে সামনে কিছুটা দেখা যাচ্ছে কেবল। সরু রাস্তার একদিকে পাহাড়ের দেওয়াল, অন্যদিকে গভীর খাদ। দু’পাশ থেকে উঁচু গাছের সারি ঢেকে রেখেছে আকাশ। পুরো রাস্তায় আমাদের তিনটে গাড়ি ছাড়া আর কোথাও কোনও মানুষের চিহ্ন নেই। সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন গভীর রাত। হোটেল বলতে একতলা টিনের চাল দেওয়া ফিল্ড হোস্টেল। পাশাপাশি টানা ঘর, পিছনে রান্নার জায়গা। ঘরগুলোর সামনে বেশ কিছুটা খোলা জায়গা, সেখান থেকে আশপাশের পাহাড়ের দৃশ্য অপূর্ব। ফিল্ড হোস্টেলটি আগে থেকে বুক করে আসতে হয়, সাধারণত স্টুডেন্টদের বড় দলই এসে থাকে এখানে।

নাগাল্যান্ডে প্রকৃতির আশির্বাদ যেন উপচে পড়ছে! চারদিকের পাহাড়ে সবুজের গালিচা়। মাঝেমাঝে কোনও কোনও গাছের পাতা লাল বা কমলা। পাহাড়ের গায়ে স্টেপ কালটিভেশন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট বাড়ি নিয়ে কয়েকটা গ্রাম। তবে এই গ্রামগুলো অত্যন্তই গরিব। সেখানকার মানুষের জীবনসংগ্রামের শুধুমাত্র কিছুটা অংশ আমরা অনুভব করতে পেরেছিলাম ওই ক’দিনেই। খাবার থেকে জ্বালানি, যে কোনও কিছু আনতেই যেতে হয় সমতলের কোনও গ্রামে। তবেদেখতে খুব মজার লাগে, প্রায় প্রতিটা বাড়ির ছাদেই কুমরো গাছ!এছাড়াও উল্লেখযোগ্য, এখানকার চার্চের সংখ্যা। কিছুদূর পরপরই পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট একটা করে চার্চ। কিছু তুলনায় বড় চার্চও রয়েছে। তেমনই একটি, ওয়াজ়িহো ব্যাপটিস্ট চার্চ, ছিল আমাদের হোটেলের একেবারে পাশে, কয়েক পা নেমে গেলেই। চারপাশ গাছে ঘেরা ছোট চার্চটির পরিবেশ মন ভাল করে দেয় সহজেই।সেখানকার ফাদারের সঙ্গে আলাপ হল আমাদের। সঙ্গীতপ্রিয় মানুষটি গিটার বাজিয়ে ইংরেজি ও নাগা ভাষায় গান শোনালেন। সন্ধেয় স্থানীয় গ্রামের শিশুরা গান শিখতে আসে চার্চে। আমরাও তখন ফিরে আসি হোটেলে। প্রবল ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে গাছের ডাল, পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে আমরা বসতাম সেটা ঘিরে, রোজই।

মাঝে একদিন আমরা নেমে এসেছিলাম ওয়াজ়িহো থেকে কিছুটা নীচে একটা গ্রামে। ফেরার পথে আমাদের তিনটে গাড়ির একটা গেল বিগড়ে! কতক্ষণে সেটা ঠিক হয়ে ফিরবে কেউ জানি না। সেই সময় আমাদের আশ্রয় দেয় ইউনিয়ন ব্যাপটিস্ট চার্চ, ফেক জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চার্চগুলোর একটা। এই চার্চটা বেশ বড়, মূল বিল্ডিং ছাড়াও রয়েছে গেস্ট হাউজ় ও সামনে অনেকটা লন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা আমাদের সকলের জন্য চা ও ফলের ব্যবস্থা করে দিলেন। ফেরার পথে আমাদের তিন বন্ধুর মাথায় খেলে যায় একটা বুদ্ধি। পাহাড়ি রাস্তায় টাটা সুমোর ছাদে বসে ফেরাটা আমরা ভুলব না কোনওদিন!

আমাদের পরের দিনের গন্তব্য মোকি ভিলেজ, ওয়াজ়িহো থেকে প্রায় ২৫ কিমি পূর্বে। গাড়িতে লাগবে আন্দাজ ১ ঘণ্টা। পাহাড়ের গায়ে সবুজে ঘেরা ছোট্ট গ্রামটি যেমন সুন্দর, তেমনই মিশুকে সেখানকার মানুষজন। সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন এক স্থানীয় গাইড। তাঁর কাধে ঝোলানো লম্বা বন্দুক! আমাদের সামনেই গাছে বসে থাকা তিনটে ছোট পাখি তিনি শিকার করলেন সেই বন্দুক দিয়ে। কারণ জানতে পারলাম রাতে। আমাদের তিন নাগা ড্রাইভার ও তাঁর রাতের ডিনার ছিল ওগুলো! তিনটে পাখি আর একটা ইঁদুর ধরে আগুনে ঝলসে তাঁরা খেয়ে ফেললেন সটান! শুনতে ভয়ঙ্কর লাগলেও ওই দুর্গম এলাকার মানুষদের খাবারের অন্য অপশন নেই বললেই চলে। শেষের কিছুদিন সঙ্গে নিয়ে যাওয়া গ্যাস সিলিন্ডার শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ঠিক কতটা কষ্ট করে ওই পাহাড়ের উপরে মানুষ থাকে। কাঠের আগুনে রান্না করা খিচুড়িই ছিল তখন আমাদের ভরসা।

জিওলজি না পড়লে সত্যিই হয়তো কখনও যাওয়া হত না ওয়াজ়িহো। না গেলে সারা জীবনের মতো একটা অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে পারতাম না কোনওদিন। যদি কোনওদিন ওয়াজ়িহো, মোকিতে যান, দেখবেন কেমন আপন করে নিয়েছে সেখানকার পাহাড়, গাছ, মানুষজন…

কীভাবে যাবেন:

হাওড়া থেকে ট্রেনে ডিমাপুর গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে ওয়াজ়িহো যেতে হবে।

জেনে রাখুন:

নাগাল্যান্ড যাওয়ার আগে অবশ্যই সরকারি পারমিট করিয়ে নিয়ে যাবেন।

কোথায় থাকবেন:

ডিমাপুর
হোটেল সেব টাওয়ার
ডবল বেডের ভাড়া ১৪০০ টাকা থেকে শুরু
যোগাযোগ: ০৩৮৬২২৩৭০০১

হোটেল আকাশিয়া
ডবল বেডের ভাড়া ৬৯০০ টাকা থেকে শুরু
যোগাযোগ: ০৩৮৬২২৩৭১০২

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

Like Us On Facebook

Facebook Pagelike Widget
© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com