ভারতের নাগাল্যান্ডে এমন একটি ট্রাইবের অস্তিত্ব আছে, যারা নিজের মা বৃদ্ধ হলে তাকে কেটে তার মাংস খেয়ে নেন – কলকাতার একজন বাঙালি লেখক তার গল্পে এমন কথা লেখার পর নাগা সুশীল সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে এবং তারা ওই লেখকের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছেন।
দেবারতি মুখোপাধ্যায় নামে ওই লেখক অবশ্য বিবিসিকে বলেছেন, তার গল্পের চরিত্রগুলি ছিল সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং তিনি কারও অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।
কিন্তু নাগাল্যান্ডের শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা মনে করছেন গল্পে যেভাবে তাদের রাজ্যের নাম ব্যবহার করা হয়েছে তা বাকি দেশে নাগাদের সম্পর্কে অত্যন্ত ভুল বার্তা দেবে – এবং এই ধরনের আপত্তিকর লেখালেখি কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
বস্তুত ভারতের প্রত্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে একটা দীর্ঘদিনের অভিযোগ হল, বাকি দেশে তাদের সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা ও প্রচার আছে।
তারা অনেকেই মনে করেন, সেখানকার বিভিন্ন উপজাতীয় রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতি নিয়েও বেশির ভাগ ভারতীয়র কোনও স্পষ্ট ধারণা বা সম্মান নেই।
সম্প্রতি প্রকাশিত কলকাতার জনপ্রিয় লেখক দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের ‘সেরা থ্রিলার’ বইয়ে ‘ভোজ’ নামে একটি গল্পে নাগাল্যান্ডের একটি উপজাতি বয়স হলে নিজের মাকে কেটে ফেলে তার মাংস খেয়ে নেন – এই ধরনের কথা লেখার পর সেই বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে নাগাল্যান্ডের শত শত মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
লেখক নিজে অবশ্য বিবিসির কাছে দাবি করেছেন, এক পরিচিতজনের কাছ থেকে শোনা কথার ভিত্তিতে এটি নিছকই একটি কাল্পনিক রচনা।
দেবারতি মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “আসলে এটা লিখেছিলাম পাঁচ বছর আগে, ২০১৭ সালে। এটা কোনও উপন্যাসও নয়, একটা গল্প – যেখানে পুরো জিনিসটাই কল্পনার ভিত্তিতে লেখা।”
“ওখানে জেসুমি নামে একটা ট্রাইব, খোয়াং নামে গ্রাম – সবটাই ছিল আমার বানানো, নাগাল্যান্ডের পটভূমিতে।”
রবিনসন ক্রুসোর মতো অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীতে কিংবা বাংলা সাহিত্যেও শিবরাম চক্রবর্তীর ‘নরখাদকের কবলে’ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’র মতো উপন্যাসে লেখকরা যে স্বাধীনতা নিয়েছেন – দেবারতি মুখোপাধ্যায় এখানেও ঠিক সেটাই করেছেন বলে যুক্তি দিচ্ছেন।
তাঁর কথায়, “সুনীল গাঙ্গুলিও তো আন্দামানের জারোয়াদের নিয়ে কত কী লিখেছেন, কই তা নিয়ে তো কেউ আপত্তি তোলেনি?”
ওই লেখক আরও জানাচ্ছেন, তার পরিচিত একজন ব্যক্তি বহুদিন নাগাল্যান্ডে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন, তার কাছ থেকে একটা কথা শুনেই তিনি এই ‘ভোজ’ নামে গল্পটা লেখার আইডিয়া পান।
“ওই মানুষটি আমায় বলেছিলেন, দীর্ঘদিন আগে – সত্তর বা আশির দশকে – নাকি নাগাল্যান্ডে একটি ট্রাইব ছিল যাদের মধ্যে নিজের মাকে কেটে খেয়ে ফেলার প্রথা চালু ছিল।”
“এই রিচুয়ালটার অর্থ এরকম – যেহেতু আমি মাতৃজঠর থেকেই বেরিয়েছি, তাই বয়স হয়ে গেলে সেই মাকেই আবার নিজের পেটের ভেতরে ঢুকিয়ে নিলাম।”
“এটার ওপর ভিত্তি করে আমি নিছকই একটি অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার লিখেছিলাম – ব্যাস, এটুকুই!”, বলছিলেন দেবারতি মুখোপাধ্যায়।
নাগাল্যান্ডের সুপরিচিত শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী আমেন জামির কিন্তু মনে করছেন, লেখকের এই যুক্তি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
মিস জামির বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “তিনি তার গল্পে পরিষ্কার নাগাল্যান্ডের কথা লিখেছেন – ফলে আমাদের পক্ষে এটাকে তো ফিকশন বলে ধরে নেওয়া সম্ভব নয়। এমন কী লিখেছেন ফেক জেলার কথাও, যে নামে সত্যিই একটি জেলা আছে।”
“আর নাগারা মায়ের মাংস কেটে খায় – এটা কী ভয়াবহ নৃশংস কথা – আর লেখিকা এর জন্য অনুতপ্ত তো ননই, উল্টে স্বামীর সঙ্গে মিলে ফেসবুকে এসে আমাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার হুমকি দিচ্ছেন!”
আমেন জামির আরও মনে করছেন এমনিতেই ভারতে নাগাদের নামে অনেক অপপ্রচার আছে, তারা নাকি হেডহান্টার, নরখাদক – ফলে এসব লিখলে তো সেই ভুল ধারণা আরও বাড়বে।
গোটা বিষয়টাই আসলে নাগাল্যান্ডের জন্য ‘খুব যন্ত্রণাদায়ক ও অপমানজনক’ বলেও মন্তব্য করছেন তিনি।
ইমলিবেনলা ওয়াতি নামে রাজ্যের একজন অ্যক্টিভিস্ট ওই লেখককে নিষিদ্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও আর্জি জানিয়েছেন।
আর ব্যবসা বা কাজের সূত্রে ভারতের অন্যান্য অংশের যারা নাগাল্যান্ডে থাকেন, তারাও এই লেখায় বিপদসংকেত দেখছেন।
কোহিমার ব্যবসায়ী প্রদীপ পারিখ যেমন বিবিসিকে বলছিলেন, “বাইরে থেকে এখানে দুদিনের জন্য এসে তারপর আজগুবি গল্প লিখে পরিবেশ বিষিয়ে দেওয়ার ঘটনা কিন্তু আগেও ঘটেছে।”
“আমার জন্ম নাগাল্যান্ডে, প্রায় ষাট বছর বয়স হতে চলল – কোনওদিন এসব অবাস্তব প্র্যাকটিসের কথা শুনিনি।”
“এনারা তো লিখেই খালাস, কিন্তু এসব বেরোলে স্থানীয় নাগারা তখন আমাদের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে, সমাজে খুব খারাপ প্রভাব পড়ে”, হতাশার সুরেই বলছিলেন মি পারিখ।
দেবারতি মুখোপাধ্যায় অবশ্য আজ সকালে নিজের ফেসবুকে ‘নাগা বন্ধুদের’ কাছে একরকম ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন – তবে লেখকের স্বাধীনতার যুক্তি থেকেও তিনি পুরোপুরি সরে আসছেন না।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, “আমার শুধু নাগাল্যান্ড শব্দটার ব্যবহারে এত সমস্যা কেন সেটা কিন্তু সত্যিই মাথায় ঢুকছে না। ধরা যাক, রাজস্থানে ‘এক্স’ নামে একটা ট্রাইব অমুক জিনিস করে, লেখকরা কি এটুকুও স্বাধীনভাবে লিখতে পারবেন না?”
“আজকাল যেসব ওয়েব সিরিজ বা সিনেমা হচ্ছে – ধরা যাক ‘স্ত্রী’ বা ‘মির্জাপুর’ – সেগুলো যে বিশেষ ভৌগোলিক এলাকার পটভূমিতে, ওখানেও এরকম আপত্তি উঠলে এগুলো তো বানানোই যাবে না। অ্যাসটেরিক্সের মতো কাল্পনিক রাজ্য বানিয়ে সব গল্প ওখানেই লিখতে হবে!”
কারও সেন্টিমেন্টে আঘাত করার জন্য বা কারও সম্মানহানি করার জন্য তিনি ‘ভোজ’ গল্পটি লেখেননি বলেও বারবার দাবি করছেন ওই লেখক।
সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করছেন, “নাগাল্যান্ডের প্রেক্ষাপটে আমার শুধু একটা থ্রিলার আছে, যেখানে একটা খুব প্রাচীন প্রথার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে আজকের নাগাল্যান্ডের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।”
“তারপরেও আমার নাগাল্যান্ড শব্দটার উচ্চারণে কেউ আহত হয়ে থাকলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সকালে সেটা ফেসবুকে লিখেও দিয়েছি”, বলছিলেন তিনি।
তবে এই ইস্যুতে নাগাল্যান্ডে যেভাবে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দানা বাঁধছে তাতে এই বিতর্ক অত সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না।
বিবিসি বাংলা