বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২০ পূর্বাহ্ন

দেশে দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপনের ভিন্ন সংস্কৃতি

  • আপডেট সময় সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলিম জাতি পালন করে ঈদুল ফিতর। মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান এটি। ‘ফেস্টিভ্যাল অব ব্রেকিং দ্য ফাস্ট’ হিসেবে ঈদুল ফিতরকে আখ্যা দেওয়া বিশ্বব্যাপী। শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার পর ঈদ পালন করেন মুসলিমরা। পুরো বিশ্বই যেন ঈদের খুশি ও আনন্দে মেতে ওঠে।

সুবহে সাদিকের পর মিষ্টি খেয়ে ঈদের নামাজ আদায়, অন্য মুসলিমকে আলিঙ্গন করা ঈদের সংস্কৃতি। মজার মজার খাবার, আত্মীয়-প্রতিবেশীর বাড়িতে যাওয়া, অন্যদের দাওয়াত করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও ইবাদতের মধ্য দিয়েই পালন করা হয় ঈদুল ফিতর। তবে বিশ্বের একেক দেশের ঈদ পালনের সংস্কৃতিতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এটি মূলত স্থানভেদের কারণেই হয়েছে।

আসুন এমন কয়েকটি মুসলিম দেশের ঈদুল ফিতর পালনের সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-

সৌদি আরব

সৌদি আরবের জাতীয় উৎসব হল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। তিন দিন সরকারি ছুটি থাকে। তাদের একটি প্রচলিত রীতি হলো পুরুষরা তাদের ছেলেমেয়ে, স্ত্রী নিয়ে বাবার বাসায় ঈদ পালন করবে। ঈদ উপলক্ষে খাবার ও উপহার দেয়া হয়। এমনকি অমুসলিমদেরও উপহার দেওয়া হয়। গরিবদের খাবার বিতরণ করা হয়। ঘরে ঘরে মিষ্টিজাতীয় খাবার বানানো হয়। এ সময় আত্মীয়-প্রতিবেশীরা বেড়াতে আসেন। অনেকে আবার বাইরে বিভিন্ন পার্কে বেড়াতে যান ও একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন।

তুরস্ক

তুরস্কের ঈদ উদযাপন সম্পর্কে জানলে আপনি রীতিমতো অবাক হয়ে যাবেন। তুর্কিবাসীরা ঈদ উদযাপন করেন সমুদ্র সৈকতে। তপ্ত রোদে সমুদ্র সৈকতে এসে ভিড় জমান সবাই। ঈদের ছুটি কাটাতে তুরস্কের বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতে পরিবারসহ সময় কাটান তুর্কিবাসীরা। তুরস্কের জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশই ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সেখানকার বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণ করে।

দেশে দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপনের ভিন্ন সংস্কৃতি

এছাড়া অনেকে ঈদুল ফিতরের প্রথম দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন এবং ২য় ও ৩য় দিন তারা সমুদ্রে কাটান। এ সময় তারা মাছ ধরা, সাঁতার কাটাসহ এবং আনন্দ হুল্লোড়ে মেতে ওঠেন। বালুকাময় উপকূলে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখেই পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে থাকেন তুর্কিবাসীরা। ঈদ মানে তাদের কাছে বিশ্রাম, আনন্দ, আবার বিশ্রাম!

মিশর

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে পার্ক, সিনেমা, থিয়েটার কিংবা সমুদ্রতটে ভ্রমণ করতে পছন্দ করে অধিকাংশ মিশরীয়। এছাড়া এ দিনটিতে মিশরের বিখ্যাত অবকাশযাপন কেন্দ্র ‘শারম আল শেখ’-এ উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা যায়। ঈদের দিনটিতে মিশরে বিশেষ খাবারের আইটেমে চিনি ও বাদামের ব্যবহার বেশি লক্ষ করা যায়। ঈদের বিশেষ খাবার হিসেবে মিশরে ‘কাহক’ নামের এক ধরনের বিশেষ কুকি বা পিঠা বেশ জনপ্রিয়। সেই দশম শতাব্দীতে মিশর রাজপ্রাসাদ থেকে আবির্ভাব হয়েছে এই বিশেষ পিঠার, যার ভেতর খেজুরভর্তা, বাদাম বা টার্কিশ ডিলাইটের পুর দেওয়া হয়। এমনই আরেকটি মিষ্টিজাতীয় পদের নাম ‘কাতায়েফ’, যা মিশরজুড়ে জনপ্রিয়।

মিশরে ঈদুল ফিতর আনুষ্ঠানিকভাবে তিন দিনের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বন্ধুবান্ধব, নিকটজন, পাড়া-প্রতিবেশী একে অপরকে ঈদ মোবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। ঈদের প্রথম দিনটি সবাই কাটায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে, বাকি দিনগুলো তারা কাটায় সিনেমা হলে, পার্কে বা সমুদ্রসৈকতে। ‘হারম আল শেখ’ জায়গাটি ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য অন্যতম জনপ্রিয় স্থান। শিশুরা বড়দের কাছ থেকে নতুন জামা এবং ঈদ সালামি পেয়ে থাকে।

দেশে দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপনের ভিন্ন সংস্কৃতি

বিভিন্ন রকম খাবার রান্না করা হয়, যার মধ্যে ‘ফাতা’ ঈদের বিশেষ একটি খাবার। এটি বাদাম এবং চিনি দিয়ে তৈরি। ‘কাহক’ নামক আরও একটি খাবার আছে যার কারণে মিশরের বেকারিগুলো ঈদের সময় কোলাহলপূর্ণ থাকে। টেলিভিশনেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে ঈদ উদযাপিত হয়। শিশুরা রাতে সবাই একসঙ্গে হয়ে গল্পগুজব করে অথবা বড়দের কাছ থেকে গল্প শোনে, গানের আসর বসে। শিশুদের জন্য মোটরসাইকেল ভাড়া করে শহর ঘুরে বেড়ানো অপরিহার্য বলা যায় মিশরে। মিশরের মানুষ সবাই মিলে একসঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে বলে তাদের রাস্তাগুলো এ সময় অনেক বেশি কোলাহলপূর্ণ থাকে।

আফগানিস্তান

আফগানিস্তানের ৯৯.৭ শতাংশই মুসলিম! ঈদ উৎসব বিশেষভাবে পালিত হওয়াই স্বাভাবিক। আফগানরা নতুন পোশাক পরিধান করে, ঈদের নামাজ আদায় করে, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়ে, বাড়ি পরিষ্কার করে, মজার সব খাদ্য রান্না করে ঈদকে স্বাগতম জানায় অন্য যে কোনো দেশের মতোই। তবে তাদের ভীষণ মজার একটি ঈদ ঐতিহ্য আছে যার নাম টখম-জ্যান্গি অথবা ডিম যুদ্ধ! এই উৎসবে সব বয়সের মানুষ খোলা জায়াগায় মিলিত হয় সেদ্ধ ডিম নিয়ে এবং একে অপরের ডিম ভাঙার চেষ্টা করে!

সোমালিয়া

সোমালিয়ার ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলিম। ঐতিহ্যবাহী নাচের মাধ্যমে ঈদকে স্বাগতম জানাচ্ছেন এক সোমালি পুরুষ। ঈদ উপলক্ষ্যে এক নারী হাতে মেহেদি দিয়েছেন। অন্যান্য দেশের মতোই, ঈদের দিনে নতুন পোশাক পরিধান করেন সোমালিরা। পরিবার পরিজনের সঙ্গে মুখোরচক ট্রাডিশনাল খাদ্য উপভোগ করে থাকেন।

মরক্কো

দেশটির ৯৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মালম্বী। জাকাত আল ফিতর মরক্কোর গুরুত্বপূর্ণ ঈদ ট্রাডিশন। এদেশে জাকাত আল ফিতার শোধ করার আগে পরিবারগুলো পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করতে পারেনা! জাকাত আল ফিতর পরিশোধের শেষ সময়সীমা ঈদের নামাজের আগ পর্যন্ত। তারপরে যদি কেউ দেয় তবে সেটা দান হিসেবে গণ্য হলেও জাকাত হিসেবে গণ্য হবে না। এটা অপশনাল না, প্রতিটি পরিবারকে যাকাত আল ফিতর আদায় করতেই হবে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে। দেশটির ইসলামিক আইন বাধ্যতামূলক করেছে জাকাত আল ফিতরকে। বেশিরভাগ পরিবারই ঈদের কদিন আগেই জাকাত আল ফিতর আদায় করে দেয়। পরিবারের প্রধানকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সাধারণত যাকাত আল ফিতর হিসেবে প্রধান খাদ্য দ্রব্য গম ও ময়দা নেওয়া হয়, তাছাড়া টাকা, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যও গ্রহণ করা হয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এক ব্যাগ গমের সমান দান করতে হবে পরিবারের প্রতি সদস্যের পক্ষ থেকে। পুদিনার চা এবং প্যানকেক, পেস্ট্রি সহ নানা ধরনের খাবার মরোক্কানরা পরিবারের সঙ্গে উপভোগ করেন ঈদের দিনে।

দেশে দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপনের ভিন্ন সংস্কৃতি

সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুরে ঈদ উদযাপিত হয় বেশ জাকজমকতার সঙ্গে। গিলং সেরাই এলাকায় ঈদুল ফিতরের দিন রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। গিলং সেরাইয়ের রাস্তাগুলো ঈদ উপলক্ষ্যে সাজানো হয় বেশ ঘটা করে। ৫০টিরও বেশি আলোক এবং ভিজ্যুয়াল ইনস্টলেশনের মাধ্যমে আলোকসজ্জা করা হয় সেখানে।

গিলং সেরাইকে কেন্দ্র করেই সিঙ্গাপুরের ঈদুল ফিতরের উৎসব পরিপূর্ণতা পায়। সেখানেই সব মুসলিমরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ভিড় জমায়। ১০০ এরও বেশি খাবারের দোকান বসে। যেখানে ঐতিহ্যবাহী মালয় খাবার পরিবেশন পাওয়া যায়। চোখ ও পেট ভরাতে সিঙ্গাপুরে একবার হলেও ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে পারেন।

আইসল্যান্ড

আইসল্যান্ডবাসী ঈদের দিনও রোজা থাকেন। কারণ গ্রীষ্মের শুরুতে সূর্য স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকায় মধ্যরাতে সূর্যাস্ত যায় সেখানে। আইসল্যান্ডে বসবাসরত মুসলমানরা প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা রোজা রাখে। যদিও এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তবে ইসলামিক নির্দেশনা অনুযায়ী, তারা নিকটতম দেশের সূর্যাস্তের সময়কালের ভিত্তিতে রোজা ভাঙেন।

আইসল্যান্ডের রাজধানী রেকজাভাকের কয়েকটি মসজিদে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। মসজিদের আশেপাশের এলাকাতেই অতিথিদের সমাগম ঘটে। সেখানেই তারা পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন। এ সময় তারা ইন্দোনেশিয়ান, মিশরীয় এবং এরিটরিয়ানে বিভিন্ন খাবার ও পানীয় খেয়ে থাকেন। শিশুরা নতুন পোশাক পরে ছোটাছুটি করে। এভাবেই আইসল্যান্ডবাসীরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com