বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মধুচন্দ্রিমার সুখকর অভিজ্ঞতা দিয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করতে চান সবাই। বাজেট, সময় আর ঘোরার মানসিকতা_ সব মিলিয়ে মধুচন্দ্রিমার গন্তব্য হতে পারে দুই ধরনের। দেশে আর দেশের বাইরে। এখানে দেশের ভেতরের খোঁজখবর জানানো হলো।
দেশের ভেতর যদি ঘুরতে যেতে চান, তাহলে মনস্থির করে ফেলুন ঠিক কোন ধরনের জায়গায় যেতে চান । যদি পাহাড় পছন্দ হয়, তাহলে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আর সিলেটের সবুজে ঘেরা পাহাড়গুলো; সমুদ্র চান, তাহলে কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও সেন্টমার্টিন। আর যদি চান জঙ্গল, তাহলে সুন্দরবন, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়াসহ দেশের গোটা বিশেক জঙ্গল। এ ছাড়া যেতে পারেন ময়মনসিংহের বিরিশিরি, বান্দরবানের বগা লেকের সিয়াম দিদিমণির পান্থশালা বা মিলনছড়ির বিলাসী অতিথিশালায়। রাঙ্গামাটির নগর দর্শন না করে পাবলাখালীর জঙ্গল। ভোলার শেষপ্রান্তের মনপুরা দ্বীপ বা ম্যানগ্রোভ জঙ্গল । কিংবা নিঝুম দ্বীপও খারাপ হয় না মধুচন্দ্রিমার জন্য।
নীলগিরি হিল রিসোর্ট : নীলগিরি হিল রিসোর্টটি বান্দরবান শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে। বান্দরবান শহরে পৌঁছানোর পর চাঁদের গাড়ি অথবা জিপে করে নীলগিরি যেতে হবে এবং খরচ পড়বে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা প্রতি গাড়ি। রিসোর্টটি থাকার খরচ আনুমানিক ৫০০০ থেকে ১০০০০ টাকা দিনপ্রতি। বাংলাদেশ আর্মি দ্বারা পরিচালিত।
সাজেক ভ্যালি : সাজেক রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও এর যাতায়াত সুবিধা খাগড়াছড়ি থেকে। এখানে ২৪ ঘণ্টায় প্রকৃতির তিনরূপ দেখা যায়। কখনো গরম, একটু পরই হঠাৎ বৃষ্টি এবং তার কিছু পরই হয়তো চারদিকে ঢেকে যায় মেঘের চাদরে। সাজেকের রুইলুই পাড়া থেকে ট্রেকিং করে কংলাক পাহাড়ে যাওয়া যায়। কংলাক হচ্ছে সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। এখানে বিভিন্ন পরিসরের রুমের ব্যবস্থা আছে। ৬০০ থেকে শুরু করে ১৫০০০ টাকা পর্যন্ত রুম পাওয়া যায়।
সেন্টমার্টিনস আর ছেঁড়াদ্বীপ : সেন্টমার্টিনে টেকনাফ থেকে জাহাজে করে যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। দিনে দিনে ঘুরে আসতে পারবেন ছেঁড়াদ্বীপ থেকে। এখানে পর্যটন করপোরেশনের নিজস্ব রিসোর্ট ছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন হোটেল-কটেজ গড়ে উঠেছে।
বান্দরবান কিংবা খাগড়াছড়ি : চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান। নীলগিরি ছাড়াও দেখতে পাবেন স্বর্ণমন্দির, মেঘালয়সহ অনেক কিছু। যেতে পারেন খাগড়াছড়ির নাফাখুম ঝরনা কিংবা বগা লেকেও। পর্যটন করপোরেশনের রিসোর্ট ছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন হোটেল-কটেজ গড়ে উঠেছে এখানে। যাওয়ার আগে অবশ্যই বুকিং দিয়ে যাবেন।
রাঙ্গামাটি : এখানকার কাপ্তাই লেক, ঝুলন্ত সেতু, ঝরনা আপনার হানিমুনকে আরও মধুর করবে। থাকার জন্য পর্যটন করপোরেশনের মোটেলসহ অনেক রিসোর্ট এবং হোটেল রয়েছে।
সুন্দরবন : সুন্দরবন মধুচন্দ্রিমায় গন্তব্য হিসেবে মন্দ নয়। নিসর্গ উপভোগ, লঞ্চ থেকে নেমে নৌকায় সূর্যোদয় দেখা, কুমির, বানর, হরিণ, সাপ, হাজারো পাখি দেখার আনন্দই আলাদা। সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জ আর বাগেরহাটের মোংলা এ জন্য আদর্শ। মোংলায় পর্যটনের পশুর হোটেলে রাত কাটিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন করমজল, হাড়বেড়িয়ার মতো জায়গাগুলো। খুলনা-মোংলা হয়ে সুন্দরবন যাওয়া যায়; মোংলা থেকে কিছুদূর গেলে কচিখালী হয়ে যাওয়া যায় কটকা পর্যন্ত। আবার সাতক্ষীরার বুড়ি গোয়ালিনী রেঞ্জ দিয়ে যাওয়া যায় সুন্দরবনের অনেক গভীরে জামতলা পর্যন্ত। দূরের গন্তব্য কটকা আর হিরণ পয়েন্ট। সাতক্ষীরায় বর্ষা রিসোর্ট আর এনজিওগুলোর রেস্ট হাউজে রাত কাটিয়ে গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন অনায়াসে। তবে এখানে বেড়াতে অবশ্যই কোনো ট্রাভেল এজেন্সির (ভ্রমণ সংস্থা) সঙ্গে যেতে হবে।
সিলেট : চায়ের দেশে সিলেটে-শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজারে ঘোরাঘুরির জন্য আদর্শ সময় বর্ষা হলেও শীতকাল এখানে উপভোগ্য। এ ছাড়া আছে মাধবকুণ্ডের ঝরনা, জাফলং, জৈন্তা ও খাসিয়াপল্লী। শীতের সময় সিলেটে এলে অন্যতম আকর্ষণ ভোলাহাট, রাতারগুল, বিছানাকান্দি, পানথুমাই, লক্ষণছড়া । শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ টি-রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রিসোর্ট বুকিং দিতে হয় বেশ আগে। আরো রয়েছে শ্রীমঙ্গলের গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্ট, মৌলভীবাজারে দুসাই রিসোর্ট, সিলেট লালা খালের পাশে নাজিমগড় রিসোর্টসহ ভালো মানের আরও অনেক হোটেল-মোটেল। চাইলে থাকতে পারেন শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হবিগঞ্জের রেমা কেলেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেস্ট হাউজেও। বন বিভাগের পাশাপাশি নিসর্গ কটেজও আছে বেশ কিছু। বিলে ঘোরাঘুরির মূল সময় হলেও শীতে অতিথি পাখিদের সঙ্গে ভ্রমণে পাবেন এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা।
কুয়াকাটা, পটুয়াখালী : সাগরকন্যা কুয়াকাটা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সৈকত অন্যতম নৈসর্গিক জায়গা। থাকা-খাওয়ার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের রিসোর্ট পর্যটন হলিডে হোমস রয়েছে। আছে পর্যটন ইয়ুথ ইন। এ ছাড়া বেসরকারি কিছু হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে।
উত্তরের আহ্বান : মন্দিরের শহর রাজশাহীর পুঠিয়া, বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির দেখে অনুমতি সাপেক্ষে থাকতে পারেন পঞ্চগড়ে চা বাগান কাজী টি স্টেটের বিলাসবহুল রেস্ট হাউজে। মাঝে অবশ্য দিনাজপুরের নওয়াবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান, আশুরার বিল, রামসাগর জাতীয় উদ্যান, বীরগঞ্জ জাতীয় উদ্যান, সিংড়া জাতীয় উদ্যান, নওগাঁর ধামুরহাট উপজেলার আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান ঘুরে নিতে পারেন। শীতকালেই ভোর আর সন্ধ্যাবেলায় দিগন্ত রাঙিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা হাজির হয় হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ের আকাশে। দিনাজপুর, বগুড়া, জয়পুরহাটে আবাসিক হোটেলগুলো ভালো। পঞ্চগড়ে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি রিসোর্ট রয়েছে। আগে থেকে অনুমতি নিয়ে রাখলে পঞ্চগড় সীমান্তে মহানন্দার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতে উঠতে পারেন ।
নেত্রকোনা : ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রকৃতির রানী নেত্রকোনা। সোমেশ্বরী নদীর পারে কিংবা চীনামাটি পাহাড়ের পাদদেশে, একান্তে দুজনে কাটিয়ে দিন সোনালি দিনকয়টি।
পরিকল্পনা আগেই
বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমার বিশেষ কয়েকটি দিন স্মরণীয় করে রাখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন সব দম্পতিই। তবে পরিকল্পনা তো আর বিয়ের পরের জন্য ফেলে রাখলে চলে না। প্রথম কারণ অবশ্যই ছুটি সীমিত। অফিস ও সংসার জীবনে পুরোপুরি সময় দেওয়ার আগে দুজনে একান্তে বেরিয়ে আসা চাই-ই। বিয়ের প্রস্তুতিতে যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, হানিমুন প্ল্যানিংটা দুজনে মিলে করলেই ভালো। ছক কষে নিন, আপনার হানিমুন পরিকল্পনা । হানিমুন প্ল্যান করার প্রথম শর্তই হলো মনের কথা শোনা। আপনার পাহাড় ভালো লাগে তাই ধুম করে পাহাড়ে হানিমুন ঠিক করে নিলেন_ এমনটা হলে চলবে না। তার চেয়ে দুজনের মনের কথায় সায় দিন। বেটার হাফের কাছে মতামত নিন। কোথায় যাওয়া যায়। দুজনের পছন্দ যদি মিলে যায়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আপনি রিলেক্সিং হলিডের পক্ষপাতী কিন্তু আপনার সঙ্গীর পছন্দ অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর, তাই এমন সমস্যা হলে দুজনে মিলে ভালোমতো বুঝে প্ল্যান করুন।
তবে এ ক্ষেত্রে নিজের মতামত জোর করে চাপিয়ে দিলে কিন্তু সারাজীবন কথা শুনে যেতে হবে। ইন্টারনেট ঘেঁটে অজানা জায়গায় সারপ্রাইজ ট্রিপে না যাওয়াই ভালো। জায়গাটা খুব পছন্দ হলেও আগে বিশ্বস্ত ট্রাভেল এজেন্টের কাছ থেকে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে তারপর যান। যদি একটু অন্য ধরনের হানিমুনের প্ল্যান করতে চান, তাহলে ক্রুজ খুব ভালো অপশন। নানা ধরনের বাজেটে ফিট করে যাওয়া ক্রুজ রয়েছে। ক্রুজে বেড়াতে গেলে জায়গা দেখার সঙ্গে সঙ্গে আরাম-বিলাসের প্রচুর সুযোগও থাকে। এ ছাড়া জঙ্গল, পাহাড় বা সমুদ্রের কাছাকাছি রিসোর্টেও আরাম এবং অ্যাডভেঞ্চারের অনেক সুযোগ পাবেন। স্পা, সুইমিং পুল, বোর্ড গেমসের সঙ্গে সঙ্গে মাউটেন হাইকিং, বিচ অ্যাক্টিভিটিজ বা সাফারিও এনজয় করতে পারেন। আর যা-ই হোক মধুর স্মৃতি ধরে রাখতে ক্যামেরা নিয়ে যেতে কখনো ভুলবেন না। জায়গা যখন ঠিক তখন টুক করে ছকে ফেলুন হানিমুন বাজেট। হানিমুনের জন্য যেখানে যাবেন সেই জায়গা সম্পর্কে একটু জেনে নিন। জেনে নিন দেশে এবং দেশের বাইরে নানা ধরনের হানিমুন প্যাকেজ সম্পর্কে।
দেশের সীমানা পেরিয়ে যদি যেতে চান হানিমুনে, তাহলে প্রথমেই চেক করে নিন দুজনের পাসপোর্ট আপডেট আছে কি না। তারপরই কেটে নিন পছন্দসই এয়ারলাইনসের টিকিট। হোটেল বুকিং টু টিকিট কেনা শেষ। লিস্ট বানিয়ে নিন কী কী নেবেন। কোন সুটকেস নিয়ে যাবেন, হানিমুনের জন্য কী কেনার আছে তা কিনুন। লাগেজ হতে হবে হালকা। সঙ্গে নেওয়ার জন্য পোশাক-আশাক আর দরকারি জিনিসের স্মার্ট একটা তালিকা করুন। কত দিন থাকবেন, কী কী করবেন, হানিমুন ডেস্টিনেশনের আবহাওয়ার হিসেবে জামাকাপড়, জুতা_ এসবের তালিকা বানান। সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসার কিছু ওষুধ নিতে ভুলবেন না।
ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে সবকিছু আরেকবার ঝালাই করে নিন। হোটেলগুলোর ঠিকানা, যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার কারও কনটাক্ট নম্বর_ এসব ফোনবুক ছাড়াও ডায়েরিতে আলাদাভাবে লিখে রাখুন। ব্যাংক এবং এয়ারলাইনসের যাবতীয় কাজ সেরে ফেলুন। দেশের কোনো লোকেশন হলে আর সেটা যদি বাসে অথবা ট্রেনে যাওয়ার হয়, তবে টিকিট করে ফেলুন। শেষ সময়ের কিছু কেনাকাটা দরকার হলে করে নিন। আর মনে রাখবেন, হানিমুন যেন ক্লান্তিকরভাবে শেষ না হয়। যথাসম্ভব সুস্থ থাকার চেষ্টা করুন। যেখানে যাচ্ছেন, সেখানকার ঘড়ির সঙ্গে চেষ্টা করবেন ঘুমের সময় মিলিয়ে নিতে।