অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসে ভিসা প্রসেসিংয়ে পনের হাজারটা টাকা স্রেফ গচ্ছা। আমরা ছয় বন্ধুর কাউকেই ভিসা দেয়নি। মনটা ভীষণ খারাপ।
বন্ধু রাসেল সবুরের মাথায় এলো নতুন বুদ্ধি, ধুত্তুরি অস্ট্রেলিয়া! যামুই না! বেড়ানোর জন্য দেশের অভাব আছে?
তা যে নেই, সে তো আমরাও জানি। কিন্তু সেটা কোথায়?
রাসেল সবুরের কঠিন সিদ্ধান্ত – দুবাই!
দুবাই! ওখানে তো বাংলাদেশীরা চাকরি করতে যায়।
আমরা যাবো বেড়াতে। ওরা আমাদের বলে ”মিসকিন” মানে ফকিন্নি। ব্যাটারা এবার দেখবে, বাংলাদেশের কাজ করে খায়, ভিক্ষা করে না। পয়সা খরচ করে দেশ-বিদেশে বেড়ায়ও।
কঠিন যুক্তি। আমরা সবাই রাজি হয়ে গেলাম।
কুরবানির ঈদের দিন রাতেই দিনক্ষণ ঠিক করে রাখা ছিল। জানা ছিল, বরাবরের মতোই সকাল সকাল গরু জবাই থেকে শুরু করে বিলিবন্টন শেষ করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাবে। এ দায়িত্বটুকু বরাবরই আমার ঘাড়ে চাপে।
এয়ার এ্যারাবিয়ার ফ্লাইটে ২৩ আগস্ট সকাল ৭টায় আমরা শারজাহ বিমানবন্দরে পা রাখলাম । ইমিগ্রেশনসহ আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে বের হতেই দেখি, আমাদের অপেক্ষায় আছেন ট্যুর কম্পানির পাকিস্তানী গাইড গুলাম মুস্তফা শরীফ।
আমাদের নিয়ে তার সুন্দর গাড়িটি ছুটে চললো। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন শহর। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বার দুবাই এডমিরাল প্লাজা হোটেলে পৌছে যাই। ফ্রেশ হয়ে হোটেল জিমে খানিক ব্যায়াম, গোসল এবং বুফেতে ৭২ রকমের নাস্তার আইটেম থেকে চেনাজানা কয়েক পদ নিয়ে নাস্তার পর্ব সেরে নিলাম। এ পর্বে বিশাল গ্রাউন্ডে পিনপতন নীরবতার মধ্যে বিশ্বের নানা দেশের শত লোকের সম্মিলন দেখে আমরা বিমোহিত হই।
বিকালে ট্যুর কম্পানির আধুনিক মার্সিডিস বেঞ্জ গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল মরুভূমিতে। উঁচুনিচু বালুময় পথে গাড়ি প্রায় উল্টে যাচ্ছে। এমনই পথে চালক কেবলিই গাড়ি ঘুরাচ্ছিলেন। আমাদের গাড়ীর ওপর এসে গড়িয়ে পড়ছিল মরুভূমির বালি। বুঝলাম এমন পথ ও চালনাকেই ডেজার্ট সাফারি বলা হয়।
সাফারির শুরুতেই আমাদের সহঅভিযাত্রী ঢাকার বাসিন্দা শরফরাজ ও তার স্ত্রী খুবই ভয় পেয়ে যান। তারা কেবলই সৃষ্টিকর্তাকে জোরে জোরে ডাকছিলেন। একপর্যায়ে তাদের অনুরোধে সাফারি খানিক সংক্ষিপ্ত করা হয়। প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার মরুভূমির ভেতর দিয়ে মসৃণ সড়কে গাড়ী চালিয়ে আরেক মরু অঞ্চলে পৌছে যাই আমরা। সেখানে ডিনার ও কালচারাল শো। অনুষ্ঠানে আরবীয় ঐতিহ্য ইতিহাস ম্যাজিক শো ইত্যাদি তুলে ধরা হলো । মাঝে রাত ১০টায় বুফে ডিনার বিরতি। নানা ধরনের পানীয়ের ব্যবস্থাও লক্ষ্য করলাম। তবে তা পেএ্যবল।
বিরতির পর শুরু হল আরবীয় নর্তকীদের বেলী ড্যান্স। একের পর এক ললনারা এসে সহস্র দর্শক-শ্রোতার মনদোলানো নৃত্য গানে মত্ত হচ্ছিল। রাত প্রায় ১টা বাজলে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
বুর্জ খলিফা টাওয়ারে
দুবাইয়ে ১৬৫তলা বুর্জ খলিফা টাওয়ারের নাম কতোই শুনেছি! এবার আমরা সেই টাওয়ারের সামনেই জ্বলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে!
টাওয়ারের শুরুর দিকে মার্কেট। আছে দুবাই এ্যাকুরিয়ামে শত শত লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রংয়ের মাছ। ২০১০ সালে উদ্বোধন হওয়া ২,৭১৭ ফুট উচ্চতার এ ভবনটি বিশ্বের সবচাইতে উঁচু ভবন। ৯০ কিলোমিটার দূর থেকেও একে দেখা যায়। এ ভবনের ৮০ থেকে ১৫০ তলায় থাকাকালীন মুসলিমগণ ইফতার ও নামাজ দুই মিনিট দেরীতে আদায় করবেন। কারণ, তারা দেরীতে সূর্য্য ডুবতে দেখেন। তার উপরের তলাগুলিতে আরও দুই মিনিট পর ইফতার ও নামাজের সময় হয়। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত চলাচলকারী লিফট রয়েছে এ ভবনে। ১২০ তলার উপরে উঠলে অক্সিজেন নিয়ে উঠতে হয়। তখন কানে তালা লেগে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ২০২০ সালে দুবাইতে অপর একটি সুউচ্চ ভবন খুলে দেয়া হবে। সেটি বুর্জ খলিফা টাওয়ারের চেয়ে আরও ১০০০ মিটার বেশি উঁচু।
দুবাইয়ে একটি বিষয় বেশ চোখে পড়ে। তা হলো, সরকারি উদ্যোগে অনাবরত সাগর ভরাট করা। নানা স্থানে সাগরের বেশ কিছু অংশ ভরাট করা হচ্ছে, আর তাতেই গড়ে উঠছে শত শত সু-উচ্চ অট্টালিকা – হোটেল,আবাসিক ভবন, দর্শনীয় স্থান, কলকারখানা। জাহাজযোগে দূরবর্তী কোথাও হতে বালু আর কংক্রিট এনে ভরাট করা হচ্ছে সাগর। পাম দুবাইয়ে এমন ভরাটকৃত স্থানে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল। আবাসিক এলাকা। নান্দনিক সব ঘরবাড়ি।
প্যাকেজ কম্পানির বদৌলতে জাহাজ ভ্রমণের মজা আরও ভিন্ন রকম। বিকেল সন্ধ্যা ফুল এয়ারকন্ডিশন্ড শত শত জাহাজ তীর ছেড়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে ডেরা দুবাই কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গভীর সমুদ্র পানে। নান্দনিক আলোকসজ্জায় সজ্জিত সেসব জাহাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষে্র উপস্থিতি দেখার মতো। আরবীয় পাকিস্থানী ও ইন্ডিয়ান শিল্পীরা জাহাজে সংগীত পরিবশেন করে সমুদ্র অভিযাত্রীদের মনোরঞ্জন করছে। পর্যটকদের কেউ কেউ গান আর বাদ্যযন্ত্র বাজনার সাথে নৃত্যে অংশ নিচ্ছে। চাইনিজ, ইন্ডিয়ান ও আরবীয় সংমিশ্রনে নানা প্রকারের বুফে খাবার দাবার ও হরেক রকমের মিষ্টান্ন ব্যবস্থা অবাক করার মতো। আমাদের জাহাজে পাকিস্থানী শিল্পী ইরফান খান হিন্দি,বাংলা ,উর্দু,আরবীসহ নানা ভাষায় সংগীত পরিবেশন করে যাত্রীদের মাতিয়ে তোলেন। তার গানের সাথে বেশ কিছু ইউরোপ ও আফ্রিকান ছেলেমেয়ে নাচতে শুরু করে। যাদু প্রদর্শন করেন আরবীয় যাদুশিল্পীরা।
আমীরাতের গ্রামে
দেশ-বিদেশ যেখানেই বেড়াতে যাই সেখানকার গ্রাম আমাকে কেবলই হাতছানি দেয়। দুবাইয়ের আশপাশে গ্রাম নেই জেনে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, তাদের কৃষিখামার দেখতে যাব। প্রস্তাব এলো শেখ পরিবারের সবজি বাগান দেখতে যাওয়ার। আমরা সংগে-সঙ্গে রাজি।
শেখদের গড়ে তোলা বাগানে গিয়ে আমাদের চোখ ছানাবড়া! এত ধরনের সবজি, কিভাবে সম্ভব? পরে চৈতন্য ফিরে আসে। আরবীয়রা পেট্রো ডলারের মালিক। তারা তো পারবেই। তাদের সবজি বাগানের ভেতর দিয়ে আইল বাতরের বদলে কংক্রিটের মসৃণ পথ। গ্রীণ হাউজ পদ্ধতিতে লেটুস পাতা, ক্যাপসিক্যাম, অনিয়ন, টমেটো, গাজর, সালাদ পাতা ইত্যাদি উৎপাদন হচ্ছে।
ওমানপ্রবাসী সাংবাদিক হুমায়ুন কবিরের বদৌলতে আমরা দুবাইয়ের পাশের প্রদেশ আল আইন ভ্রমণের সুযোগ পাই। সেখানে যেতে প্রায় ৩০০ কিলোমিলাটার পথ পাড়ি দিতে হয়, তবে খুব বেশি সময় লাগেনি। সেখানে প্রবাসী রাজনৈতিক বেশ কয়েকজন নেতার সাথে আমাদের পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে অত্যন্ত ভদ্রলোক ইঞ্জিনিয়ার মাহে আলম, তরিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন আমাদের স্বাগত জানান। তারা আমাদের জন্য রাতে ঐতিহ্যবাহী আরবীয় ডিসে ভু্রিভোজের আয়োজন করেন।
আল আইনের পাহাড়ে
আল আইনের একটি বড় আকর্ষণ জাবেল হাফিত পাহাড়। এ পাহাড় ১৭০০ ফুট উঁচু। উঠতে হয় আকাবাঁকা পথ বেয়ে। আঁকাবাঁকা, তবে মসৃণ পথ, চলতে গিয়ে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে। পাহাড়ে ওঠার পথে সাময়িকভাবে কান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই।
প্রশস্ত ও মসৃন পথ ধূলাবালিমুক্ত। এ পথে গড়ে তোলা হয়েছে কেবলই প্রাকৃতিক ও নান্দনিক সৌন্দর্য্য। ভ্রমণপিপাসুরা এখানে দলে দলে ভিড় জমিয়ে থাকেন। দিনে গরম থাকায় রাতে অনেকেই পরিবার নিয়ে আসেন। পাহাড়ের উচুতে দর্শকদের জন্য নির্মিত হয়েছে সুন্দর সুন্দর বেঞ্চি। রয়েছে কোমল পানীয়, চা কফি পানের সু-ব্যবস্থা সম্বলিত ক্যান্টিন। পাশেই আরবীয় শেখদের জন্য নির্মিত মনোরম কারুকার্যখচিত বাংলো। এ পাহাড় থেকে ওমান, আল আইন ও দুবাইয়ের রাতের সৌন্দর্য্য বেশ উপভোগ্য।
দুবাইয়ে রয়েছে বিদ্যুৎ,পানির সুব্যবস্থা। চওড়া রাস্তাঘাট। পরিচ্ছন্ন শহরটি দেখে আপনারও মনে হতে থাকবে এ যেন ইউরোপের উন্নত একটি দেশ। প্রশস্ত সড়কের পাশে সাইন বোর্ডে সর্বোচ্চ গতিসীমা লেখা রয়েছে। কোনো চালকই এ গতিসীমা অতিক্রম করছেন না। করলেই সড়কে স্থাপিত ক্যামেরা বা রাডার গাড়ীর ছবি তুলে রাখবে। জরিমানা সাথে সাথে মোবাইলে পৌছে যাবে।
পাঠক, আপনিও ঘুরে আসতে পারেন আধুনিক শহর দুবাই। খরচ সর্বসাকুল্যে এক লাখ টাকার মধ্যে সম্ভব। তবে অনেক ট্যুর কম্পানির ভেতর থেকে যাচাইবাছাই করে একটি বেছে নিলে ভাল হবে।
লেখক : নজমুল হুদা শাহীন