রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৯ পূর্বাহ্ন

দুবাইয়ের ‘মিউজিয়াম অব দ্য ফিউচার’

  • আপডেট সময় সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৩

নান্দনিক সব নকশা আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে বিশালাকার অট্টালিকা নির্মাণে দুবাই সারা বিশ্বে অনন্য আর সুপরিচিত। দুবাইতে এমন সব অত্যাধুনিক মানের ভবন রয়েছে যা পুরো বিশ্বেই বিখ্যাত। এবার দুবাইয়ে নির্মাণ হলো ‘মিউজিয়াম অব দ্য ফিউচার’ নামে ভিন্ন নকশার এক নান্দনিক ভবন। ভবনটির নকশাতে যেমন নান্দিকতা, এর ভেতরটাও তেমনি অনন্য। পুরো ভবনটি তৈরি করা আরবি ক্যালিগ্রাফিক ডিজাইনে। আরবি ক্যালিগ্রাফিতে মূলত দুবাই শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের ভবিষ্যত সম্পর্কিত পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে রেখে যাওয়া তিনটি বাণীর সংমিশ্রণ।

দৃষ্টিনন্দন, গোলাকার, উজ্জ্বল এবং আরবি ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপি দিয়ে সজ্জিত, সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই নতুন সাংস্কৃতিক গন্তব্যটি যাদুঘরের ধারণাকেই বদলে দিয়েছে। ‘মিউজিয়াম অব দ্য ফিউচার’ তৈরি হয়েছে মানুষের চোখের আকৃতি অনুসরণ করে। আমরা চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখি আর নতুনত্বের স্বপ্ন দেখি। এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে চোখের আকৃতির নকশায় বানানো হয়েছে ভবনটি। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো এই ভবনে কোনো কলাম এবং কোণা নেই। গোলাকৃতির কলামবিহীন এই ভবনটির নকশা করেছেন দুবাই ফিউচার ফাউন্ডেশনের ব্রেইনইল্ড এবং কিলা ডিজাইনের স্থপতি শন কিলা।

দুবাইয়ের শাসক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৫ সালে ভবিষ্যত সুবিধার জন্য পরিকল্পনার ঘোষণা করেছিলেন। অভিভাবক সংস্থা এবং সরকারি প্রযুক্তি ইনকিউবেটর দুবাই ফিউচার ফাউন্ডেশন পরের বছর কার্যক্রম চালু করে।

ভবন নির্মাণের এই প্রকল্পটি আধুনিক প্রযুক্তি এবং সৃজনশীল চিন্তার একটি স্থায়ী প্রদর্শনী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে এরই মধ্যে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় ‘মিউজিয়াম অব দ্য ফিউচার।’

৭৭ মিটার উঁচু সাত তলা বিশিষ্ট টরয়েডেল কাঠামো অনুসরণ করে নির্মিত কলামবিহীন এই স্থাপনাটি। প্রায় তিন লাখ ২৩ হাজার বর্গফুট বিস্তৃত, উপবৃত্তাকার শূন্যতা সমৃদ্ধ হাল্কিং স্টেইনলেস স্টিলের কাঠামোটি ব্রিটিশ প্রধান দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম বিউরো এইচএপিপি (Happ)-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় শন কিলার নেতৃত্বে দুবাই-ভিত্তিক স্থাপত্য স্টুডিও কিলা দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল নতুন এই স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক আইকন।

মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে সাজানো হয়েছে ‘মিউজিয়াম অব দ্য ফিউচার’। এতে রয়েছে ধ্বংসের সম্মুখীন সবুজ বন-পাহাড়ের নির্মল পরিবেশ, মহাকাশ এবং স্পেস স্টেশনের আদলে তৈরি মহাকাশ ও মহাশূণ্য এবং রেস্টুরেন্ট ও লবি। মিউজিয়ামের অভ্যন্তরে মনোমুগ্ধকর ক্যালিগ্রাফির পাশাপাশি দর্শকরা বিস্তৃত, বহুমুখী হল দেখতে পাবেন যেখানে ১০০০ জন লোক একসাথে বসতে পারবে।

বিল্ডিংয়ের সাতটি তলার মধ্যে পাঁচটি জুড়ে বিস্তৃত বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিয়েন্টাল ডিসপ্লে এবং নিমজ্জিত ইনস্টলেশন, যার মধ্যে রয়েছে তিন অংশের স্থায়ী প্রদর্শনী, ডাবড জার্নি অফ দ্য পাইওনিয়ার্স, স্টুটগার্ট ইত্যাদি। প্রযুক্তিগুলো জার্মানি-ভিত্তিক প্রদর্শনী ডিজাইন স্টুডিও দ্বারা ধারণ করা এবং সম্পাদিত।

‘জার্নি অফ দ্য পাইওনিয়ারস’ ওএসএস হোপের সমন্বয়ে গঠিত মহাকাশ স্টেশনের প্রতিলিপি। এই প্রতিলিপিকে মহাকাশে মানবতার বসতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। স্থাপনাটির ভেতরে থাকা লিফট এবং পরিবেশ এমনভাবে নকশা করা হয়েছে মনে হবে যেন আপনি মহাকাশে ভ্রমণ করছেন।

উদ্ভোধনের পর জাদুঘরের টিকিট (তিন বছরের বেশি বয়সী দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি প্রায় ৩৯.৫০ ডলার) মার্চ মাসের শুরুতেই সম্পূর্ণ বিক্রি হয়ে গেছে।

বিজ্ঞানের ধারণা মতে, এক সময় হয়তো মানবজাতি নিজেদের তৈরি বিপর্যয়েই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই পরবর্তী প্রজন্ম যেন তাদের অতিত সম্পর্কে জানতে পারে সেই আদলেই তৈরি করা হয়েছে স্থাপনাটি। ভবনে থাকা সবুজ স্থান, সময় এবং ইতিহাসে দৃঢ়তা, স্থায়িত্ব এবং মূলের সাথে পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে পৃথবীতে থাকা পুরো বাস্তু সংস্থানের সংক্ষিপ্ত ধারণা উপস্থাপিত হয়েছে।

এই স্থাপত্যটিকে শুধু একটি ভবন হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এর মাধ্যমে শুধু শৈল্পিক আলোকবর্তিতাই উপস্থাপিত হয়নি, সৃজনশীলতার এক নতুন মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে। স্টেইনলেস স্টিল পরিহিত রোবট দ্বারা নির্মিত ভবনটি ৭৮মিটার টরাস-আকৃতির বিল্ডিং হিসাবে লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভাইরনমেন্টাল ডিজাইন (এলইইডি) প্ল্যাটিনাম স্ট্যাটাস অর্জন করেছে। এর প্রতিটি অংশ বিল্ডিং ইনফরমেশন (বিআইএম) এর মাধ্যমে সর্বজনীনভাবে নকশা করা হয়েছে।

শ্রমসাধ্য ১৬টি ধাপে লেয়ারিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি ১,০২৪টি অনন্য যৌগিক প্যানেলের সমন্বয়ে, বিশেষায়িত রোবোটিক অস্ত্রের সাহায্যে সম্মুখভাগটি তৈরি করতে ১৮ মাস সময় নিয়েছে। স্থাপনাটির সামনের দিক রাতে প্রায় ৪৬ হাজার ফুট এলইডি আলোর রেখার জন্য জীবন্ত হয়ে ওঠে যা আরবি ক্যালিগ্রাফিকে আলোকিত করে পুরো ভবনটিকে ফুটিয়ে তোলে।

জাদুঘরটি দুটি সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত প্রতিবেশী জুমেইরাহ এমিরেটস টাওয়ার থেকে বিস্তৃত ৫৬তলা বিলাসবহুল হোটেল এবং অন্যটি কাছাকাছি থাকা এমিরেটস টাওয়ারস মেট্রো স্টেশনের সাথে সংযুক্ত করেছে।

৭৮ মিটার উচ্চ ভবনটিতে তিন তলা পডিয়ামের ওপরে ছয়টি প্রদর্শনী এবং একটি প্রশাসনিক অংশ এবং একটি এফ+বি ডেক, অডিটোরিয়াম, শপিং মল, পার্কিং এবং সাধারণ সবরকমের পরিষেবা রয়েছে।

ভবনটির ভিতরে একটি মাল্টিপারপাস হল বিল্ডিংয়ের মূল অংশ জুড়ে আছে যার চারপাশে একটি লেকচার হল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্মার্ট সিটি, শক্তি এবং পরিবহন এবং স্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য উদ্ভাবন পরীক্ষাগার সহ আরও জায়গা রয়েছে।

২২ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনের আগে ১৩৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত জাদুঘরটিকে স্থানীয়ভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ভবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আরবি ক্যালিগ্রাফির লাইনগুলো মুলত দুবাই এর শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম এর তিনটি ভবিষ্যতবাণীর উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে। বাণী তিনটি- ‘আমরা হয়তো কয়েকশ বছর বাঁচব না, কিন্তু আমাদের সৃজনশীলতার পণ্যগুলি চলে যাওয়ার অনেক পরে একটি উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারে।’

‘এমন কিছু নয় যার জন্য আপনি অপেক্ষা করছেন, বরং তৈরি করুন।’

‘উদ্ভাবন চিন্তা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা নয়। এটি জাতি এবং জনগণের বিবর্তন এবং পুনর্জীবনের পিছনের রহস্য’।

ভবনটি উদ্ভাবনী নকশা নীতি, বাস্তবায়ন এবং নির্মাণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করে। নকশাটি নিম্ন কার্বন নাগরিক বিল্ডিং যা অনেকগুলো নকশা উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে। বিশেষ করে বলতে গেলে প্যারামেট্রিক ডিজাইন, প্যাসিভ সোলার আর্কিটেকচার, কম-শক্তি এবং কম-পানি প্রকৌশল সমাধান, শক্তি এবং জল উভয়ের জন্য পুনরুদ্ধারের কৌশল এবং সমন্বিত নবায়নযোগ্য নির্মাণ।

জাদুঘরটি ভবিষ্যতবাদী, চিন্তাবিদ, উদ্ভাবক এবং জনসাধারণকে এমন ধারণার পরীক্ষায় একত্রিত করে যা ভবিষ্যতের বিশ্বকে সংজ্ঞায়িত করে এবং আমাদের আগামী বিশ্বের সাথে আমাদের যোগাযোগের উপায়কে রূপ দেয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com