বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৫ অপরাহ্ন
Uncategorized

দার্জিলিংয়ের সেকাল এবং একাল

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০২২

চা বাগান, লেবক ঘোড়দৌড়ের মাঠ, তেনজিং সাহেবের জুতোর সাইজ, হলিউডের নায়িকার মতো দেখতে ঘোড়াউলির দার্জিলিং
আজও মুগ্ধ করে। কেভেন্টার্স নস্ট্যালজিয়ায় মজলেন দেবাশীষ দেব। চারশো মিটার গভীর! কালিঝার পৌছঁলাম দুপুর দু’টো নাগাদ। প্রবল হাওয়া বইছে তখন থেকেই। কোনওরকমে দুপুরের খাওয়া সেরে গিয়ে ঢুকলাম টেন্টে। তারা-খসা রাত অতিক্রম করে পরদিন ভোর চারটে নাগাদ শুরু হল সামিট পর্ব। উঠতে হবে তিন-চারশো ফুট মতো। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে সেই যে কতটা দুর্গম,বলে বোঝানো কঠিন। ফোকতে দারা টপে পৌঁছে সূর্যোদয়ের জন্য যখন আমরা অপেক্ষা করছি, সেই সময়টুকু যেন কাটতেই চাইছে না! সূর্যের প্রথম লাল আভা এসে পড়ল বুদ্ধের পেটে।

তারপর ক্রমশ তা ছাড়িয়ে পড়ল বুদ্ধের নাকে পায়ে বুকে … সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য! আমাদের ঠিক নীচে ভেসে বেড়াচ্ছে শত সহ¯্র মেঘের ভেলা, তার উপরেও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে কমলা রং… ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব! সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডা! ক্যামেরায় শাটার টিপতে গিয়ে কয়েক মূহূর্তের জন্য খুলেছিলাম , পরবর্তী দশ মিনিট সাড় ছিল না হাতে! সকাল সাতটা নাগাদ কালিঝার মেসে ফিরে গরম-গরম রুটি আর তরকারি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরের ক্যাম্প, মানে ফালুট-এর উদ্দেশ্যে। ১২ কিলোমিটার পথ। কিন্তু অনেক চড়াই- উতরাই। ফালুটে আর টেন্ট নয়, আছে ট্রের্কাস হাট। মাঝে পড়বে সিংগালিলা টপ। ফালুটে ক্যাম্পে যখন পৌঁছলাম, তখন কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে চারিদিক। ঝকঝকে সিংগালিলা টপ থেকে নেমে এভাবে মেঘের চাদরে

নিজেদের মুড়ে, ফেলা… এ-ও এক অদ্ভুত অনুভ‚তি। পাহাড়ে প্রকৃতির রূপ বদলায় ঘনঘন, এই প্রথম দেখলাম আকাশের মুখ ভার করতে। বৃষ্টি আসবে নাকি? ফালুট থেকে গোরখে, পাহাড়ের কোলে আঁকা ছবির মতো গ্রাম। এই দিনই অতিক্রম করতে হয় সর্বাধিক পথ, প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তবে সময় লাগে মাত্র ঘন্টা তিনেক। কারণ এই ট্রিপে এটিই সহজতম যাত্রাপথ পাইন গাছের জঙ্গল, পাহাড়ি বাশেঁর সারি, রডোডেনড্রনের মেলা, হাজারো পাখির ঐকতান… অবসন্ন শরীর নিয়েও এগিয়ে চলতে তাই কষ্ট হবে না মোটেই।

গোরখেতে যে হোম স্টে-তে আমরা ছিলাম, তাদের নিজস্ব ক্যান্টিন যেন সব পেয়েছিল আসর! রোস্টেড চিকেন থেকে বিদেশি সুরা, কী নেই সেখানে?

ট্রেক শেষের দিনে এমন একটি ‘আসর’ কি একটুও বাড়তি মোটিভেশন জোগাবে না? রাতে খেতে বসে হল বিনা মেঘে
বজ্রপাত! শুনলাম ট্রেক শেষ নয় এখানেই, কাল সকালে গাড়ি ধরার জন্য হেঁটে নামতে হবে ভারেং পর্যন্ত, সময় লাগবে ঘন্টা তিনেক! চার দিনে প্রায় ৪০ কিলোমিটার হেঁটে কারও শরীর-ই-আর সেভাবে সঙ্গ দিচ্ছে না। অগত্য, নিজেদের নতুন করে মোটিভেট করার পালা। তার সহজ উপায়? চোখের সামনে ঝুলিয়ে নেওয়া দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত রেস্তরাঁর রোস্টেড চিলি পর্ক, মিক্সড গ্রিল, বিফ স্টেক! ট্রেক শেষ, কিন্তু আমাদের ঘোরা তো এবার শুরু! পরবর্তী ডেস্টিনেশন, ‘খাদেও ধারের রেলিং…’।

ভ্রমনবিলাসী বাঙালির কাছে দার্জিলিঙের মতো প্রিয় শৈলশহর বোধহয় সারা দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। কেভেন্টার্সেও ছাদে বসে সসেজ আর বেকন ভাজা সহযোগে ধোঁয়া ওঠা কফি পান, ম্যাল রোডের উত্তর দিকে লোহার কারুকাজ করা ছাউনির নিচে কাঠের বেঞ্চে বসে সামনে কাঞ্চনজঙঘার দৃশ্য দেখা, কিংবা রাত থাকতে উঠে ঠান্ডায় কাঁপতে কাপঁতে টাইগার হিলে গিয়ে সূর্যোদয়ের মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করা, এগুলো আমাদরে সবার স্মৃতিমেদুরতার সঙ্গে যেন জড়িয়ে গিয়েছে সেই কবে থেকে।
শিলিগুড়ি যাত্রাটা ছিল তুলনায় অনেক মসৃণ। তারপর ওখান থেকে একটা অ্যাম্বাসেডর গাড়ি সোজা তুলে দিয়েছিল দার্জিলিঙে।
ল্যান্ডরোভারের যুগ তখনও পর্যন্ত শুরু হয়নি। বাবাদের অফিসের হলিডে হোমে গিয়ে উঠেছিলাম। দোতলা কাঠের বাড়ি, পেল্লায় ঘর, পশ্চিমমুখো বিশাল তিনটে জানালা, সামনেই বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙঘা ঝলমল করছে।

রান্নাঘরে সব রকম সরঞ্জাম মজুত, কেভেন্টর্স থেকে টাটকা খাসির মাংস কিনে আনা হত, মা জমিয়ে রান্না করতেন, সারা বাড়ি গন্ধে ম ম করত। সে কালে দ্রষ্টব্য বলতে ছিল চা বাগান, লেবং ঘোড়দৌড়ের মাঠ, ঘুম-এর বৌদ্ধমঠ এবং অবশ্যই হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট। সেই ছেলেবেলার পর প্রায় বছর তিরিশ ওদিকে আর যাওয়া হয়নি। নতুন করে দার্জিলিং ভ্রমন শুরু হল চুল দাড়িতে কিছুটা পাক ধরিয়ে।

সেই থেকে এখনও শহরটার টানে বছরে একবার করে না গিয়ে পারি না। হয়তো আশপাশে সিকিমের কোথাও গিয়েছি কিংবা ট্রেক করে সান্দাকফু বা জংরি। ফিরতি পথে নিয়ম করে দু-চার দিন দাজিলিঙে একটু জিরিয়ে নিতেই হবে। গোড়ার দিকে সোজা গিয়ে উঠতাম শ্যামল পালের গোল্ডেন অর্কিড-এ। বন্ধুদেরও ওটাই তখন দার্জিলিঙের পাকাপাকি আস্তানা ছিল। মাথাপিছু থাকা খাওয়া একেবারে জলের দাম, দু’বেলা খাবার বাঙালি রান্না, চাইলেই রানিং সার্ভেন্ট গরম জল এনে দিচ্ছে। তাছাড়া চলে আসার আগের রাতে পোলাও- মাংস ইত্যাদির এলাহি ব্যবস্থা থাকত। মনে হত, যেন কোনও আপনজনের বাড়ি এসেছি।

ফেরার সময় শ্যামল- বৌদি নিয়ম করে বড় বড় চায়ের প্যাকেট হাতে তুলে দিতেন আমার আর কলকাতার সকলের নাম করে। চিরকাল পাহাড়ে যাই অফ সিজনে, বাড়তি ভিড়ভাট্টা এড়াতে।

দার্জিলিঙের নিরিবিলি পাহাড় রোড ধরে হাটঁতে হাটঁতে কখনও লালকুঠি ছাড়িয়ে জাপানি মন্দির , বা কখনও পৌঁছে যাই একেবারে টঙে, সেন্ট পলস স্কুলে অবধি। এই অভ্যাসটা এখনও বজায় রেখেছি, তবে রাস্তার দুপাশে ইট-কাঠের সমারোহ যে হারে বেড়ে চলেছে, ক্রমশ হাফিঁয়ে উঠি। কত রাত এখানে রেলিং ধরে দাড়িঁয়ে সামনে তারা ভরা আকাশ আর আলো ঝলমলে দার্জিলিং শহরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছি, কান মাথা ঢেকে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঢাল বেয়ে ওটানামা করছি আধো-অন্ধকার রাস্তা ধরে। ইদানিং সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি পাহাড়ের রাস্তাটা যেখানে টাইগার হিলের দিকে
উঠেছে, সেই বাঁকের ধারে একটা ছাউনে বা ‘রেস্ট-আ-হোয়াইল প্লেস’- এর উদ্দেশে। এখানে বসে কাঞ্চনজঙঘা ছাড়াও অনেক নীচে ভোঁ বাজিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে টয় ট্রেনের যাওয়া আসা দেখতে দারুন লাগে। অনেকবার খাতা আর রং-তুলি বের করে জমিয়ে ছবিও একেঁছি।

শুরুর দিন থেকেই দার্জিলিঙের দুটো জিনিস আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল- এক, কেভেন্টার্সের ছাদে বসে খাওয়া আর ম্যাল রোডে চক্কর মারা। দার্জিলিঙের ম্যাল চিরকাল বেশ জমজমাট একটা জায়গা, দিনভর হরেক রকমের লোকজন এসে এখানে ভিড় জমায় আর একপাশে কাঠের বেঞ্চে বসে এদের সব কীর্তিকলাপ দেখতে দেখতে কখনও একঘেয়ে লাগে না। যেমন আপাদমস্তক সুন্দর সাজগোজ করা, মস্ত হিল জুতো পায়ে পাহাড়ি মেয়ের দল। বউয়ের নকশাদার শাল জড়ানো বাঁদুরে টুপি মাথায় কিম্ভূত বাঙালি টুরিস্ট অথবা হানিমুন করতে আসা দম্পতির ঘোড়ায় চেপে ‘খুলে আম’ আদিখ্যেতা!

বহুকাল আগে এখানে একজন ঘোড়াওয়ালির মুম্বই- ফিল্মস্টারসুলভ চেহারা আর হাবভাব আমাদের বেশ অবাক করেছিল। ওর নাম দেওয়া হয়েছিল, রিনা রায়। গতবছর গিয়েও দেখলাম, মহিলা এখনও নিজেকে বেশ ঝকঝকে রেখেছেন। যদিও ব্যবসায় মনে হল মন্দা যাচ্ছে। ভাল লাগে দেখে সেই কত বছর ধরে দুই ভাই বিহার থেকে এসে এখানে সবার হাতে হাতে গরমগরম চা আর কফি দিয়ে বেড়াচ্ছে। একবার অন্তত নিয়ম করে ম্যালের উপর প্রায় আদ্যিকালের অক্সফোর্ড বুক স্টোর্স- এ ঢুঁ মারতেই হয়।

আহা, পাহাড়- পর্বত নিয়ে কত দুষ্প্রাপ্য বই যে এরা রাখে! বন্ধুদের ফরমায়েশ মত বহুবার বই ওখান থেকে আমায় কিনে আনতে হয়েছে। এতকিছুর পরেও মন ছটফট করে ম্যাল রোড ধরে হাটঁতে যেতে। দিনে দিনে এ অঞ্চলের লোকসংখ্যা বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এখানে বয়স্কদের সকালে পাক দেওয়া , স্কুল-পড়য়াদের যাতায়াত কিংবা ছেলে ছোকরাদের হই হুল্লোড়। তবু আজও আঁকাবাঁকা এই পাহাড়ি পথ চলতে গিয়ে কেমন যেন অতীতের অনেক কিছু ঘিরে ধরে আমাকে।

হাল আমলের শক্তপোক্ত ছাউনিওলা কাঠের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেও চোখের সামনে ভেসে ওঠা ‘কাঞ্চনজঙঘা’ ছবিতে একাকিত্বের প্রতীক সেই রায়বাহাদুর গিন্নির গান গেয়ে ওঠার মরমি দৃশ্যটা।

সবচেয়ে বড় কথা পরিস্কার দিনে ম্যাল রোডের এই উত্তর দিক থেকে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গটি অজ¯্র বার দেখার পরেও প্রতিবার কেন যে একই রকম ভাল লাগে কে জানে। এই ‘কাঞ্চনজঙঘা’ ছবির কারণেই কেভেন্টার্স নিয়েও আমাদের একটা অদ্ভুত মোহ রয়ে গিয়েছে।

তাই বহুবার এমনও হয়েছে, হোটেলে মালপত্র নামিয়ে রেখেই ছুটে গিয়ে ছাদের টেবিল দখল করে খাবারের ফরমায়েশ করেছি। ওখানে বসে প্লেট ভর্তি অতি সুস্বাদু পর্ক খেতে খেতে কাঞ্চনজঙঘা দেখার অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। বেশ কিছুকাল যাবৎ অবশ্য এখানকার খাবারের মান ক্রমেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে, যেটা সত্যি আফশোসের কথা। যদিও এসব নিয়ে দেখেছি বেশির ভাগ লোকই তেমন মাথা ঘামাতে রাজি নন।

দরকার পড়লে এঁরা লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেন খালি টেবিলের জন্য আর খেতে বসে ‘আহা! আহা!’ করতে করতে মোবাইলের ছবি তুলে তৎক্ষনাৎ ফেসবুকে দিয়ে দেন। দার্জিলিঙের আর-এক সেরা খানদানি রেস্তেরাঁ গেনারিজ সম্পর্কেও সেই একই কথা বলতে হয়। যদিও কনকনে শীতের রাতে হ্যাট-কোট চাপিয়ে খাঁটি বঙ্গসন্তানেরা সপরিবার এখানে ‘কন্টিনেন্টাল ডিনার’ সারতে এসে এখনও বেশ একটা সাহেবিয়ানার মেজাজ উপভোগ করে থাকেন। বড়দিনের সময় অবশ্য আলো ঝলমলে, সান্টা দাদুর পেল্লায় পুতুল দিয়ে সাজানো বাড়িটায় নানাবিধ চকোলেটের পসরা সাজানো কাউন্টারগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে বেশ ভালই লাগে। দার্জিলিঙে তিব্বতি ও চিনে খাবারের দোকানও গজিয়েছে প্রচুর, তাছাড়া ম্যালের মুখেই তিব্বতি উদ্বাস্তরা মোমো, থুকপা আর বার্গারের অস্থায়ী স্টল সাজিয়ে বসেছে বহুকাল ধরেই। টাটকা খাবার,মেয়ে-পুরুষদের মিষ্টি ব্যবহার আর যথেষ্ট সস্তা বলে সকলে এখানে ভিড় জমায়।

অন্য হোটেলে থাকতে আমরা কর্তা গিন্নি ঠান্ডায় না বেরিয়ে অনেক সময় আগে থেকে একটা করে ধুমসো চিকেন হটডগ নিয়ে এসে দিব্যি রাতের খাওয়া সেরেছি। দার্জিলিঙের এক সাবেক চিনে রেস্তোরাঁর সন্ধান পেয়েছিলাম আজ থেকে সতেরো বছর আগে কিছুটা হঠাৎ করেই। সেবার কেভেন্টর্সেও ছাদে বসে ছবি আকঁছি, পাশের টেবিল থেকে খাওয়া শেষ করে এক কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক তাঁর ছোট মেয়েকে নিয়ে উঠে এলেন আমার ছবি দেখতে। আলাপ হল।

উনি নিজের পরিচয় দিলেন প্লান্টার বলে। এখানেই পড়াশুনো, তারপর চা বাগানের শাঁসালো চাকরি, ফলে পুরো দার্জিলিং শহরকে চষে ফেলেছেন। সোল্টি-র কথা উনিই তুললেন, সামনেই লাডেন লা রোড।

ছাত্রবস্থায় নিয়মিত আড্ডা ছিল ওখানে, খাঁটি চিনে খাবারের সেই মান ওরা এখনও বজায় রেখেছে। পরের দিনই গেলাম ওঁর কথা মতো রাস্তার উপর হলেও আমাদের আগে চোখে পড়েনি সোল্টি-কে। ঢুকে দেখলাম ভেতরে ছোট্ট সরু জায়গা, একপাশে গোটা চারেক মাত্র পরদাওলা খুপরি, একটু চাপা গোছের। টেবিলের কাচের তলায় মেনু কার্ড গোঁজা, অবাক হলাম দেখে যে মাটন দিয়েও সব রকম খাবার বানায়। মাটন চাউমিন আর মটন মোমোর স্বাদ জীবনে সেই প্রথম পেলাম।

পরে আরও এটা ওটা চেখে দেখেছি এদের সব রান্নাই চমৎকার। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার সেই পিপিং আর ওয়াল্ডর্ফ-এর কথা। সেই থেকে দার্জিলিং গেলে আমরা সোল্টি-তে একবার না একবার ঢুঁ মারবই। দার্জিলিঙে নাথমুলস-এর চায়ের খুব নাম, ওদের লাডেন লা রোডের দোকানটায় ভিড় লেগেই থাকে। বহু বছর আগে একবার ওর কাছেই আরেকটা দোকানে চোখ পড়েছিল। টি এম্পোরিয়াম লেখা সাইনবোড, কাউন্টারে এক দাড়িওয়ালা, লম্বা, সুপুরুষ ভদ্রলোককে দেখে ঢুকে পড়েছিলাম। পরিচয় হল, দেখলাম উনি বাঙালি। মিত্তির। তিন পুরুষ ধরে এখানে চা বেচছেন এবং চায়ের যাবতীয় হাল-হকিকত ওরঁ একেবাওে নখদর্পণে। আমাদের পছন্দ জেনে নিয়ে উনি নিজে একটা প্যাকেট বেছে দিলেন। কলকাতায় এসে খেয়ে দেখেছি, দিব্যি ভুরভুরে সুগন্ধ।

এরপর নিয়মিত যেতাম চা কিনতে, জমিয়ে আড্ডা হত। মাঝে নানা কারণে বছর পাচেঁক আর দার্জিলিং যাওয়া হয়নি। পরে যখন গেলাম, শুনলাম উনি মারা গিয়েছেন। এখন ওঁর ঝকঝকে স্মার্ট দুই ছেলে দোকানটা চালায়, দার্জিলিং গেলে আজও পুরনো
অভ্যাস অনুযায়ী ওখান থেকেই চা কিনি, সেই সঙ্গে ভদ্রলোকের কথাও খুব মনে পড়ে। তাছাড়া ইদানীং একটু ছিমছাম ভাবে কাটাতে ইচ্ছে হয়, তাই ম্যালের ঠিক উপরেই হোটেল শ্যালে বেছে নিই।

ওখানে খাবার পাওয়া যায় না বলে একটু সমস্যা, তবে জায়গাটা খুব সুবিধাজনক। প্রকৃতির নিয়মে সবকিছুই ধীরে ধীরে পাল্টায়।
দার্জিলিং শহরটাও যে আর আগের মতো থাকবে না, এতে আশ্চার্য হওয়ার কিছু নেই। ব্রিটিশ শাসকদেও স্মৃতি আকঁড়ে পড়ে থাকতে নারাজ এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। তাই ওদের কথা ভেবে ম্যালের একটা ধারে বাধাঁনো গ্যালারি তৈরি হয়েছে। বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য, অন্যদিকে স্টেজ বানিয়ে প্রায়ই ব্যান্ডের গানবাজনার উত্তাল আসর জমে ওঠে।

মোড়ে মোড়ে গজিয়ে উঠেছে আধুনিক কফি শপ আর আলো-ঝলমলে শপিং মল। অথচ এদিকে দেখি শতাব্দীপ্রাচীন মাউন্ট
এভারেস্ট হোটেলের ওই আলিশান পাথুরে ইমারতটিকে ভেঙে চলছে জোর কদমে। একদা তারুণ্যের মিলন মেলা জোয়ি’জ পাব আজকাল তালা বন্ধই পড়ে থাকে, গিটার বাজিয়ে গানের কলিও ভেসে আসে না। বহু বিলিত কটেজগুলোরও দেখি রীতিমতো পোড়োবাড়ির অবস্থা। তবু বলব, দার্জিলিং আছে দার্জিলিঙেই , যে রাস্তা দিয়েই হাঁটি না কেন, কত পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। সেখানে নাকি বিখ্যাত হলিউডি

নায়িকা ভিভিয়ান লে জন্মেছিলেন। আজও পাহাড়ের ধারে ছোট্ট বাগানওলা কাঠের নড়বড়ে দোতলা বাড়ি দেখলেই দাড়িঁয়ে পড়ে জোরে নাক টেনে দেখি মাংস রান্নার কোনও গন্ধ আসছে কি না।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com