টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার আনেহলা ইউনিয়নের সবুজ শ্যামল এক গ্রাম ডাকিয়া পটল। এ গ্রামের বুকচিরে বয়ে গেছে বিশাল এক জলাধার। নাম তার মলাদহ। এ ছাড়া রয়েছে ১৮টি ছোট-বড় বিল। এ বিলগুলোতে প্রতিবছরের মতো এবারও এসেছে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। প্রচন্ড এই শীতে নিত্যদিন ভোরের কুয়াশার আঁচল চিরে দলবেঁধে আসা পাখির ডানার শোঁ শোঁ শব্দ আর কলতানে ঘুম ভাঙে স্থানীয়দের। সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত বিলে যেন শীতের অতিথিদের বরণ করে নিচ্ছে। বিলের কচুরিপানার মাঝে জলকেলিতে মেতে উঠছে পাখিরা। একটু থেমেই এক ঝাঁক পাখি পানিতে অবতরণ করছে তো আর এক ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। মনে হবে যেন এটা পাখিদের আপন নীড়।
ঘাটাইল উপজেলার পশ্চিম প্রান্তে আনেহলা ইউনিয়ন অবস্থিত। এই ইউনিয়নে ছোট-বড় প্রায় ১৮টি বিল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মলাদহ, ঝাইতলা, বরকম, পুঁইটা, ধোপারকম, খৈইলাকুড়ি ও আদমবুইড়া। এর মধ্যে মলাদহ হচ্ছে ঘাটাইল উপজেলার সর্ববৃহৎ বিল। এ বিলগুলো পুরো শীত মৌসুম অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। মলাদহ ও পুঁইটা বিলে পরিযায়ী পাখিসহ দেশীয় পাখি বেশি দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য পাখিগুলো হচ্ছে- বালিহাঁস, পাতিহাঁস, সারস, পানকৌড়ি, নারিলা ও ডাহুক।
বিলগুলোর চারদিকে সবুজ শ্যামলের সমারোহ। মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিলবেষ্টিত ডাকিয়া পটল গ্রাম। সকালে এ গ্রামের বিলের কচুরিপানার মাঝে জলকেলিতে মাতে অতিথি পাখি। আর বিকেলের সোনালি রোদে গ্রামের গাছের ডালে ডালে পানকৌড়িসহ বিভিন্ন পাখির পালক জ¦ল জ¦ল করে। এ গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে শত ব্যস্ততার মাঝেও পাখি দেখে অনেক পথচারী একটু দাঁড়িয়ে চোখ জুড়িয়ে নেন।
সরেজমিন দেখা যায়, মলাদহসহ ডাকিয়া পটলের সবকটি বিল অতিথি পাখির কল কাকলিতে মুখর। আর এই দৃশ্য দেখতে আসে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ আগে আরও বেশি পাখি আসত। পাখি শিকারীদের দৌরাত্ম্যের কারণে এখন অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। ডাকিয়া পটল গ্রামের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক বাবর হোসেন জানান, পাখিদের সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। এখানে পাখি আসে বলেই প্রতিদিন অনেক পাখি প্রেমী দেখতে আসেন। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে শীতের মৌসুম চলে গেলে পাখি যখন চলে যায় তখন বুকটা ফাঁকা লাগে। আবার যখন শীতে ফিরে আসে তখন বুক ভরে যায়। পাখিপ্রেমী আব্দুল মোতাকাব্বির স্বাধীন বলেন, পাখি আমাদের পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তাই আমাদের দেশে আসা অতিথি পাখি যাতে নিরাপদে থাকতে পারে সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
আনেহলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তালুকদার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখে। তাই পাখিদের প্রতি সকলকে সহনশীল হতে হবে। আমার ইউনিয়নের যেসব স্থানে অতিথি পাখি আসছে। সেখানে যাতে তারা নিরাপদে থাকতে পারে সেজন্য পরিষদের পক্ষ থেকে নজরদারি রয়েছে।
এদিকে অবাধে গাছপালা কেটে উজাড় করা হচ্ছে বন জঙ্গল। এক সময় টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার বিভিন্ন বাড়ির পিছনের বাঁশঝাড় বা জঙ্গলে পাখির ঝাঁকের কলতানে কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে ফেরা মানুষের মনে প্রশান্তি ফিরত। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙত গ্রামের মানুষের। খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবের কারণে পাখির ঝাঁকের সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য এখন আর চোখেই পড়ে না।
মাঘ মাসের শুরুতেই কৃষকরা বোরো ধানের চারা লাগানোর প্রস্তুতি শুরু করে। জমিতে হালচাষের জন্য দেওয়া নতুন সেচের পানি পেয়ে ধান কাটা জমি থেকে উঠে আসছে কীট পতঙ্গ। এগুলো খাওয়ার জন্য দল বেঁধে উৎসবমুখরভাবে জমিতে অবস্থান নিচ্ছে বক, কালো ফিঙে, শালিক, দোয়েলসহ বিভিন্ন পাখি। উপজেলার জমিগুলোতে এখন এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
বনমালী গ্রামের কৃষক হারুন মিয়া বলেন, অনেক দিন পর এ রকম ঝাঁক ঝাঁক পাখি দেখে ভালোই লাগছে। সেচে পানি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাখিরা ক্ষেতে এসে বসে। জমি হাল বাওয়া শেষ হলে পাখিগুলো অন্য জমিতে গিয়ে বসে। জমিতে হাল চাষের টিলারের মালিক আলমগীর মিয়া বলেন, পাখিরা হাল বাওনের সময় খেতে আসে, আমরা ওদের কোনো ক্ষতি করি না। স্থানীয় বাসিন্দা প্রকৃতিপ্রেমী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে দেশীয় পাখি দিন দিন কমে আসছে। আগের মতো সকাল-সন্ধ্যা পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে ব্যক্তি উদ্যোগে বেশি বেশি পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করা উচিত। এ ছাড়া পাখি শিকারিদের আইনের আওতায় এনে পাখিদের অবাধ বিচরণের জন্য পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা প্রয়োজন।