বর্তমানে করোনা আতঙ্কে দিন কাটছে বিশ্ববাসীর। ভ্রমণপ্রিয় মানুষগুলোও গৃহবন্দি রয়েছেন। এমন অবস্থায় সবারই দম বন্ধ অবস্থা। তাই অনেকেই ভাবছেন করোনাকাল শেষ হলে বা এই ভাইরাসের আতঙ্ককে জয় করতে পারলেই আবার বেড়িয়ে পড়বেন ভ্রমণে। ঘুরে দেখবেন নিজের পছন্দের জায়গাগুলো।
অনেকেই চাইবেন দেশের বাইরে কয়েকটাদিন কাটিয়ে আসতে। আর সাধ্যের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হতে পারে থাইল্যান্ডের দ্বীপ ফুকেট। ভ্রমণপিপাসু সবাই কমবেশি জানেন কিংবা গিয়েছেন অদ্ভূত সুন্দর এই জায়গাটিতে। ফুকেটের ট্যুর স্পটগুলো বেশ জনপ্রিয়।
থাইল্যান্ডের সরকারি হিসেবে প্রতিদিন এখানে দেশ-বিদেশের পর্যটকের সংখ্যা পঁচিশ হাজারেরও বেশি। দ্বীপটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৮ কিলোমিটার আর প্রস্থ ২১ কিলোমিটার। এর আশপাশ জুড়ে রয়েছে আরো ৩২টি ছোট ছোট দ্বীপ। আর এদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমুদ্র সৈকতগুলো বৈশিষ্টের কারণে একেকটি থেকে আলাদা। একবার গেলেই বুঝতে পারবেন যেকোনো পর্যটককে সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট স্বপ্নের এ লীলাভূমি।
আবহাওয়াঃ
ভ্রমণের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার প্রয়োজন এবং পছন্দের সাথে মিল রেখে সেখানকার আবহাওয়ার সাথে পরিচিতি রাখা ভালো। প্রায় সারা বছরই ফুকেটের আবহাওয়া কিছুটা গরম ও আদ্র থাকে। তবে গরমের প্রভাব বেশি থাকে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত। মে’র শেষ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গরমের সাথে কিছুটা বৃষ্টিও হয়। এ সময় সকাল-দুপুর পুরোটা সময় সূর্যের আলো পাওয়া যায় এবং পানি স্বচ্ছ থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টির ফলে পানির স্বচ্ছতা কমে আসে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোটামোটি শীতকাল ধরা হয়। তবে শীতের কাপড় পড়ার মতো ঠাণ্ডা আবহাওয়া নয়, সহনীয় তাপমাত্রা থাকে; প্রায় ২৫-৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ফুকেটের জনপ্রিয় ১২টি ট্যুর স্পট:
ফুকেট শহর (Phuket city):
ফুকেট দ্বীপের সবচেয়ে জমজমাট স্থান হলো ফুকেট সিটি। কেনাকাটার জন্য উপযুক্ত জায়গা এটি। শহরের চিকন রাস্তাজুড়েই পাবেন পছন্দসই রেস্টুরেন্ট, বুটিক শপ আর অসাধারণ সব গিফটের দোকান। প্রচুর লোকাল মার্কেট রয়েছে এখানে; বিশেষ করে ছুটির দিন স্পেশাল কিছু লোকাল দোকান বসে। এমনকি হাজার বছরের ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নকশাখচিত বস্তুসামগ্রীর মাধ্যমে। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে অহরহ এবং কম খরচে ফ্লাইটের ব্যবস্থা আছে ফুকেট ও এর আশপাশের দ্বীপগুলোতে। এখানকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আপনি যখনই যান না কেন পর্যাপ্ত পরিমাণ হোটেলের ব্যবস্থা সেখানে আছে। অতএব, বাড়িতে বসে ইন্টারনেটেই নিজের পছন্দ ও সুবিধা অনুযায়ী হোটেল বুকিং দিতে পারবেন। আর যারা এখনো যাননি তারা একবার সময় করে ঘুরে আসতে পারেন স্বপ্নের এই শহরে।
ফুকেট ত্রিকাই মিউজিয়াম (Phuket Trickeye museum):
সব বয়সীরাই এই যাদুঘরটি পছন্দ করবে। এখানে রয়েছে প্রচুর ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি সম্পন্ন ছবির গ্যালারি যা দেখলে কোনো বর্ণনার প্রয়োজন হয় না। ছবিগুলো নিঃসন্দেহে যেকারো সৃজনশীলতা এবং কল্পনাকে অনুপ্রাণিত করবে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই মিউজিয়াম।
ফুকেট অ্যাকুরিয়াম (Phuket Aquarium):
সমুদ্রের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন এখানে। সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও যে কত ধরনের জলজ প্রাণীদের বসবাস তা এখানে আসলে কিছুটা দেখার সুযোগ মেলে। যেমন- ক্যাটল ফিশ, ইল্স, কাকড়া, গলদা চিংড়ি, হাঙর ইত্যাদি। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
বাংলা রোড (Bangla Road):
ফুকেটের জনপ্রিয় ব্যস্ততম জায়গাগুলোর মধ্যে এটি একটি। সূর্যাস্তের পর থেকে এখানে শুরু হয় বিভিন্ন ব্যস্ততা, ক্লাব আর পার্টি। খাবারো বেশ ভালো। সেজন্য সন্ধ্যা নামলেই এখানে যাওয়ার প্ল্যান করবেন। এখানে অবশ্য বাচ্চাদের নিয়ে না যাওয়াটাই উত্তম।
দ্য কিডস ক্লাব ফুকেট (The Kids Club Phuket):
এটি বাচ্চাদের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ জায়গা; যেখানে আপনি আপনার শিশুকে খেলতে দিয়ে নিজের মতো পেছনে বসে কফি খেতে পারবেন। এছাড়াও শিশু এবং বড়দের জন্য খুব সুন্দর পরিবেশ এবং খুবই ভালো খাবারের ব্যবস্থা আছে এখানে। এমনকি বেবিসিটিং এর ব্যবস্থাও আছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আপনার শিশুদের এখানে রেখে আপনি কয়েক ঘণ্টার শপিং সেরে আসতে পারেন।
কোকচাং সাফারি এলিফ্যান্ট ট্রেকিং (Kok Chang Safari Elephant Trekking):
কাতা বিচের খুব কাছেই এর অবস্থান। হাতি থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাতির হিংস্রতার কথা চিন্তা করে অনেকে এখানে আসতে চান না। তবে এখানকার হাতিদের খুব যত্নে রাখা হয় এবং প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যেন তারা পর্যটকদের আনন্দ দিতে পারে। বাচ্চারা অবশ্য ট্রেকিংটি বেশি পছন্দ করবে।
ফুকেট ফান্টাসি (Phuket FantaSea):
পুরো পরিবার নিয়ে এখানে মজার কিছু সময় কাটাতে পারবেন। বিশেষ করে যারা বিনোদন পার্ক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পছন্দ করেন এটি তাদের জন্য উপযুক্ত জায়গা। এছাড়াও রয়েছে সাংস্কৃতিক থিম পার্ক, থিয়েটার পারফর্মেন্স, অদ্ভুত প্রানীদের সার্কাস, ইত্যাদি। তবে মনে করে সাদা বাঘ দেখতে ভুলবেন না। আর সম্ভব হলে পুরো জায়গাটা ঘুরে আসবেন। তবে সাথে কোনো ধরনের রেকর্ডিং ইকুইপমেন্ট নেবেন না। এসব নিয়ে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ।
ওয়াটার পার্ক (Water park):
ফুকেটে ২টি দারুন ওয়াটার পার্ক আছে- একটি কাতা বীচে পাবেন; নাম- সার্ফ হাউজ (Surf House), আরেকটি স্প্ল্যাশ জাংগাল ওয়াটার পার্ক (Splash Jungle Water park) কাতা বীচে রয়েছে সার্ফ হাউজ। এখানে হাই প্রেশারের পানির ঢেউ উপভোগ করতে পারবেন। ভয়ের কিছু নেই, আপনি চাইলেও ডুবে যাবেন না। পরিবারের ছোট বড় সবাই এটি উপভোগ করতে পারেন। আর স্প্ল্যাশ জাংগাল ওয়াটার পার্ক রয়েছে মাই খাও বীচে। বিভিন্ন ধরনের ওয়াটার রাইড পাবেন এখানে। অবশ্য এখানে নিজস্ব খাবার কিংবা পানীয় নিয়ে প্রবেশ নিষেধ।
বিগ বুদ্ধ ফুকেট (Big Buddha):
সকালে উঠেই চলে যেতে পারেন অসম্ভব সুন্দর দর্শনীয় স্থান বিগ বুদ্ধ ফুকেটে। সুবিশাল এই মূর্তিটি ৪৫ মিটার/ ১৪৮ ফুট উচুঁ। সাদা মার্বেল পাথরে আবৃত এই বিগ বুদ্ধটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ মিটার ওপরে অবস্থান করছে। ফুকেট সফরে গেলে এই দর্শনীয় স্থান কিছুতেই না দেখে ফিরবেন না।
ফ্লাইং হনুমান (Flying Hanuman):
যাদের উচ্চতা নিয়ে সমস্যা নেই অর্থাৎ হাইট ফোবিয়া নেই তারা এখানে অবশ্যই যাবেন। এখানকার গাইড আপনাকে উৎসাহিত করবে যেন আপনি কোনোভাবে ভয় না পান। একবার মজা পেয়ে গেলে বারবারই এর স্বাদ নিতে চাইবে।
ফাং এনগা বে (Phang Nga Bay):
কয়েকটি সারিবন্ধ ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত অত্যন্ত সুন্দর এই জায়গাটি। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। এখানে আছে বেশ কয়েকটি গুহা। যার ভেতর হিম শীতল আবহাওয়া, আছে স্কুবি ডু রক; যা দেখতে কার্টুনের কুকুরটির মতো, রয়েছে আইসক্রিম গুহাও। সবমিলে ভালো কিছু সময় কাটাতে পারবেন পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে।
জেমস বন্ড আইল্যান্ড (James Bond Island):
এটি অতন্ত্য জনপ্রিয় একটি জায়গা। বেশিরভাগ পর্যটকই এখানে একবার ঘুরে দেখে যান। ফাং এনগা বে’র পাশেই এটি অবস্থিত। মূলত হলিউড অভিনেতা জেমস বন্ডের “দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গান” সিনেমার কিছু শুটিং এখানে করায় এর নামকরণ করা হয়েছে। নৌকা নিয়েও ঘুরে আসতে পারবেন এর চারপাশে। এখানে আসলে উপভোগ করতে পারবেন সেইলিং এবং কায়াকিং।
ফুকেট ভ্রমণের আগে কিছু তথ্য জেনে নেয়া প্রয়োজন। যেমন-
• অবশ্যই স্ট্রিট ফুড চেখে দেখবেন
• চেষ্টা করবেন বাইক ভাড়া করে জায়গাটি ঘুরে দেখতে। এতে সময়ও বাঁচবে, খরচও কমে আসবে।
• যেকোনো ক্ষেত্রে দর কষাকষি করবেন। কেননা ট্যুরিস্টদের কাছে এমনিতেই দাম বাড়িয়ে চায়।
• ভুলেও ট্যাক্সি কিংবা টুক টুক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করবেন না “How much”। আগে থেকেই বিশ্বাসযোগ্য গাইডে কিংবা হোটেলের লোকজনের কাছ থেকে শুনে আসতে পারেন পার কিলোর খরচ কত। কিংবা মিটারে গেলেও ড্রাইভার আগে থেকে মিটার অন করে রেখেছে কিনা তা দেখে নেবেন।
• এক দশকে থাইল্যান্ডে সবকিছু যে পরিমান সস্তা ছিল, পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সব কিছুর দাম। এজন্য ভুলেও মনে করবেন না অল্প টাকায় থাইল্যান্ড ঘুরতে পারবেন। যদি পারেনও হাতে বাড়তি কিছু টাকা রেখে দেয়া ভালো।
• শুধু বীচের স্পোর্টস কিংবা ক্লাবগুলোতে না গিয়ে আশপাশের যেমন আং থং ন্যাশনাল মেরিন পার্কে বেশ কম খরচে সবকিছুই উপভোগ করতে পারেন।
• ভিড় এড়াতে চাইলে থাইল্যান্ডের অফ সিজনে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
• ইংরেজি জানা না থাকলে চলতে ফিরতে টুকটাক শব্দগুলো জেনে যান অথবা লিখে নিয়ে যান।