সুনসান নীরবতা, নিস্তব্ধতা আপনাকে আপন করতে চায়, কিন্তু আপনারই ফুসরত মিলছে না। হঠাৎ করে একদিন মনে হলো, আর পেরে উঠছি না! এবার একটু কোথাও ঘুরে আসা যাক। হাতে যে তালিকাটা আছে, তার প্রায় সবটুকুই দেখা শেষ। এখন নতুন কোনো জায়গার খোঁজে? পাহাড়ের কোলজুড়ে সবুজ গাছপালার ঘন রঙে আচ্ছাদিত হয়ে আছে সাজেক। এর সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। চারদিকে সবুজের সমারোহ আর প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যে পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য, আকাশ-পাহাড়ের মিতালি ও শুভ্র মেঘের খেলা দেখে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়বেন আপনি।
উচ্চতার বিচারে সাজেক সমতল থেকে মাত্র এক হাজার ৭০০ ফুট উঁচু হলেও প্রায় দুই হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় বান্দরবানের জনপ্রিয় হিলস্টেশন নীলগিরি থেকেও অনেকেই একে পছন্দের বিচারে এগিয়ে রাখেন কাসালং রেঞ্জের দুই পাশের দুটি উপত্যকা একই স্থান থেকে দেখা যায় বলে, বাংলাদেশে এ রকম স্থান পার্বত্য অঞ্চলে বিরল। কাসালং পাহাড় সারি দুই পাশেই গভীর উপত্যকা থাকায় ও উচ্চতা কম হওয়ায় প্রতিদিন ভোরে সাজেক ডুবে থাকে মেঘের রাজ্যে যেটি বান্দরবানের উঁচু পাহাড়ের ক্ষেত্রে মেঘের সারি থাকে পাহাড় চূড়া থেকেও অনেক নিচে।
সাজেক পর্যটন কেন্দ্র
সাজেক একটি ইউনিয়ন। এর অবস্থান রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায়। তবে রাঙামাটি জেলা সদরের সাথে সাজেকের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই, যেতে হয়ে খাগড়াছড়ি জেলা হয়ে, তাই অনেকেই একে খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত বলে ভুল করে ভেবে থাকেন।খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব ৬৭ কিলোমিটার, এরপুরোটাই সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। রাঙামাটি থেকেও সাজেক আসা যায়, তবে এ ক্ষেত্রে কাপ্তাই লেক পাড়ি দিতে হয় লঞ্চ বা নৌকায়, এরপর লংদু হয়ে মারিশ্যা হয়ে চান্দের গাড়িতে পৌঁছানো যায় সাজেকে। সাজেক ইউনিয়ন বাংলাদেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন, এর আয়তন বাংলাদেশের অনেক উপজেলা হতেও বড়। সাজেক পর্যটন কেন্দ্রটি মূলত সাজেক ইউনিয়নের রুইলুইপাড়াকে ঘিরে (সমতলে যা গ্রাম, পাহাড়ে তা পাড়া নামে পরিচিত)।
খাগড়াছড়ি সদর থেকে দীঘিনালা হয়ে সাজেক অবধি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর সড়কটির শেষ বিন্দু এই রুইলুই পাড়া। রুইলুই পাড়াটি পাহাড় সারির চূড়ায় এর দুই পাশে গভীর দুই উপত্যকা। রুইলুই এর উচ্চতা প্রায় এক হাজার ৭০০ ফুট সমতল থেকে, মেঘের সারির সাধারণ উচ্চতা এই উচ্চতায় হয় বলে সাজেক মেঘের রাজ্য হিসেবেই পরিচিত। খুব ভোরে ঘুম ভাঙলে দেখতে পাবেন আপনি ডুবে আছেন মেঘের সমুদ্রের মাঝে। সাজেক থেকে ভারতের মিজোরাম অঙ্গরাজ্যের উঁচু পাহাড় সারি দেখতে পাবেন খুব কাছ থেকে। এ ছাড়া সাজেক বিখ্যাত কমলালেবু চাষের জন্য। সাজেক আসলে কমলা বাগান আর বাগানের টাটকা কমলা লেবুর স্বাদ নিতে ভুলবেন না।
সাজেকের ইতিহাস
সাজেক পর্যটন কেন্দ্রটি রুইলুই পাড়াকে কেন্দ্র করে, যত দূর জানা যায় ১৮৮৫ সালের দিকে ভারতের মিজোরাম অঙ্গরাজ্য থেকে লুসাই জাতির কিছু মানুষ এখানে একটি পাড়ার গোড়াপত্তন করে, এরপর পাংখোয়া ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসীরাও এখানে বসবাস শুরু করে। তবে সাজেকে খাবার, পানি, চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে অনেকেই আবার ছেড়েও চলে যায়। এখন অবশ্য এখানে ত্রিপুরা পরিবারের সংখ্যাই বেশি, বর্তমানে পরিবারের সংখ্যা ৯৫টি। সাজেক অতীতে বাংলাদেশের দুর্গমতম স্থান হলেও পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে, সাজেক এখন আর কোনো দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল নয়।
কীভাবে যাবেন
সাজেক যেতে প্রথমেই আসতে হবে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে কিংবা দীঘিনালায়। ঢাকা থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে খাগড়াছড়ি এবং দীঘিনালা অবধি। ভাড়া ৫২০ টাকা (নন এসি) থেকে ৭০০ টাকা (এসি)। বাস ছেড়ে যায় সায়েদাবাদ ও কল্যাণপুর থেকে। সৌদিয়া, শ্যামলী, ইকোনো, এস আলম, শান্তি পরিবহনের বাস এই রুটে চলাচল করে। শুধু শান্তি পরিবহন দীঘিনালা পর্যন্ত যায়। চট্টগ্রাম কিংবা ফেনী পর্যন্ত ট্রেনে এসেও বাকিটা বাসে যেতে পারেন খাগড়াছড়িতে। এবার খাগড়াছড়ি থেকে রিজার্ভ জিপ/চান্দের গাড়ি নিতে হবে সাজেক পর্যন্ত। একদিন নিয়ে যাবে, রাতে থাকবে পরের দিন সেই গাড়ি আপনাদের নিয়ে খাগড়াছড়ি ফিরবে এমন চুক্তিতে ভাড়া নিবে সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত। বাসস্ট্যান্ডেই সাজেক যাওয়ার চান্দের গাড়ি পেয়ে যাবেন। এ ছাড়া লোকাল চান্দের গাড়ির সার্ভিসে যাওয়া যায় কিন্তু সরাসরি যাওয়া যায় না, আপনাকে যেতে হবে শুরুতে দীঘিনালা, সেখান থেকে গাড়ি পাল্টে মাসালং, মাসালং থেকে আরেক গাড়িতে সাজেক, ভাড়া এ ক্ষেত্রে কম পড়লেও গ্রুপ করে গেলে গাড়ি রিজার্ভ করেই যাওয়া ভালো।
সাজেকের আকর্ষণগুলো
সাজেক মূল পর্যটনকেন্দ্রে একেবারে খাদের কিনারায় বেশ দারুণ একটি পার্ক রয়েছে, বাচ্চাদেরসহ বড়দের বিনোদনের জন্য কিছু খেলাধুলা ও একান্তে বসে পাহাড় দেখার জন্যে ছোট ছোট খোলা ছাউনির মতো করা আছে, পুরো পর্যটনকেন্দ্রেই প্রিয়জনের সাথে বসে কিছু মুহূর্ত কাটানোর জন্য প্রচুর বসার ব্যবস্থা রয়েছে।
সাজেক পর্যটন কেন্দ্রটি পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় বলে আর গাড়ি ততটুক যায় পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের স্বাদ সাজেক ভ্রমণে পাবেন না। তবে সাজেক পর্যটনকেন্দ্র রুইলুই পাড়া থেকে দুই কিলোমিটার দূরে কংলাক পাড়া অবস্থিত। এইটুকু ট্রেকিং করার স্বাদ পেতেই পারেন আপনি। কংলাক পাড়াটি সিপ্পু পাহাড়ের চূড়ায়, এটিই সাজেকের সর্বোচ্চ বিন্দু, এখানে পাহাড়িদের জীবনধারা দেখার খুব ভালো সুযোগ পাবেন, সাথে সিপ্পুর চূড়া থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে ঘুরে কালাসং রেঞ্জের পুরোটা দেখতে পাবার মজা রয়েছে। সাজেকে এই একটি মাত্র জায়গা যেখান থেকে সাজেকের দুই পাশের ভ্যালি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন। কংলাক পাড়ায় কিছু বাড়িতে কফি চাষ হয়, চাইলে ঘরে রোস্ট করা কফির স্বাদ পেতে পারেন এই পাড়াতে বসেই।
সাজেকে দুটি হ্যালিপ্যাড রয়েছে সেনাবাহিনীর। এর একটায় বসে সকালে সূর্যোদয় দেখতে পাবেন আর আরেক পাশের হ্যালিপ্যাডে বসে দেখতে পাবেন সূর্যাস্ত। সাজেকে একটি ঝরনা রয়েছে স্থানীয় ভাবে কমলক ঝরনা নামে পরিচিত, তবে এটি দেখতে শারীরিক সক্ষমতা আর মানসিক শক্তি প্রয়োজন কারণ ঝরনাটি রুইলুইপাড়া পাহাড়ের নিচের দিকে নেমে যেতে হয়, ৪৫ মিনিট মতো পাহাড়ি পথে নেমে যাওয়ার পর আরো মিনিট দশেক ঝিরিপথ পারি দেওয়ার পর কমলক ঝরনা দেখতে পাবেন, এটিতে যেতে রুইলুই থেকে স্থানীয় গাইড নিয়ে যেতে হবে, গাইড ২০০-৩০০টাকা চাইতে পারে। এ ছাড়া সাজেক থেকে ফেরার পথে দীঘিনালায় একটু যাত্রা বিরতি দিয়ে ঘুরে আসতে পারেন হাজাছড়া ঝরনা। এখানে যেতে অবশ্য গাইড লাগবে না, জিপ ড্রাইভারই ঝরনা দেখিয়ে নিয়ে আসবে আপনাদের।
থাকার ব্যবস্থা
সাজেকে থাকার জন্য রুইলুই পাড়ায় সেনাবাহিনী পরিচালিত দুটি রিসোর্ট রয়েছে রক সাজেক আর রুন্ময় রিসোর্ট, রুন্ময়তে ভাড়া পড়বে চার হাজার ৫০০- পাঁচ হাজার টাকা, এ ছাড়া রুন্ময় রিসোর্টে তাবু রয়েছে এডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য, আটজন থাকার তাবুর ভাড়া দুই হাজার ৮৫০ টাকা। এ ছাড়া আলো রিসোর্ট রয়েছে, ভাড়া ৭০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা, এ ছাড়া আছে মারুতি রিসোর্ট, নিরিবিলি কটেজ, হানিমুন কটেজ, জীবনদাস কটেজ ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে বোর্ডিং ব্যবস্থায় শেয়ারিং সিস্টেমে পাহাড়িদের বাড়িতে কিংবা সাজেক ক্লাব হাউজে থাকার ব্যবস্থা, এ ক্ষেত্রে প্রতিরাতে ভাড়া গুনতে হবে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
খাবার : সাজেকে রুন্ময় রিসোর্টে কিংবা আলো রিসোর্টে থাকলে খাবার ব্যবস্থা ওরাই করবে, এর বাইরে দুই-তিনটা খাবার হোটেল রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে খাবার অন্তত দুই ঘণ্টা আগে অর্ডার দিতে হবে। এ ছাড়া চা, বিস্কিট, কলা, পেঁপে, আনারস আর সাজেকের ট্রেডমার্ক কমলা তো থাকছেই। এ ছাড়া ভারতের মিজোরাম খুব কাছে হওয়ায় ভারতীয় কিছু পণ্য এখানে পাবেন।
সম্ভাব্য খরচ : ঢাকা-খাগড়াছড়ি-ঢাকা বাস ভাড়া (পথে যাত্রাবিরতিতে রাতের খাওয়া আর বাসা থেকে বাস স্ট্যান্ড অবধি যাওয়া মিলিয়ে) এক হাজার ৩০০ টাকা। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক জিপ সাত হাজার টাকা (আমরা ১০ জন গিয়েছি, তাই জনপ্রতি ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে)। সাজেকে থেকেছি ক্লাব হাউজে, ভাড়া ১৫০। এ ছাডা দুই দিনে খাবার খরচ চা-নাশতাসহ ৭০০ এ ছাড়া টুকটাক ১৫০, সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকার মতো। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির আশপাশে রিসাং ঝরনা, আলুটিলা গুহা, ঝুলন্ত সেতু, এসব ঘুরে দেখতে চান্দের গাড়িতে অতিরিক্ত এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০টাকা দিতে হয়।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকেই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের শুরু। তবে খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের রাস্তাটি দেশের অন্যতম সেরা ও সুন্দরতম রাস্তা। তবে পুরো অঞ্চলেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছাড়াও দীঘিনালায় একটি ক্যান্টনমেন্ট রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ আনসার, বাংলাদেশ পুলিশ রয়েছে পুরো অঞ্চলেই। আর সাজেক পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ঘিরে, সাজেকের মূল ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সাথেই রয়েছে বিজিবি ক্যাম্প। সব মিলিয়ে সাজেক বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে নিরাপদ স্থান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পর্যটকবাহী গাড়িগুলোকে বাঘাইছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে সামরিক প্রহরায় সাজেক অবধি পৌঁছে দেয় আবার ফিরে আসার সময়ও একি সুবিধা রয়েছে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে।
টিপস
সাজেকে বিদ্যুৎ সুবিধা নেই, সোলার সিস্টেমে শুধু আলোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে পাহাড়ের অতো উঁচুতে গরম তেমন লাগে না, বরং হিম বাতাসে একটু ঠান্ডা ঠান্ডাই লাগবে।
সাজেকে শুধু রবি ও টেলিটকের নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায়, যাত্রার সময় এটি খেয়াল রাখবেন, সাথে অবশ্যই পাওয়ার ব্যাংক রাখবেন। সাজেকে অনেকেই নিজস্ব গাড়ি নিয়ে যায়, তবে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা- উঁচুনিচু রাস্তার সাথে পরিচিত চালক থাকলেই ভালো। সাজেকে যেই সিজনেই যান না কেন, রাতে হিম হিম বাতাস সামাল দিতে সাথে অবশ্যই এক সেট ফুলহাতা জামা রাখবেন।