ভোর বেলায় বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো বোমা। মূহুর্তেই ঝড়ে গেলো সাতটি প্রাণ। আহত কয়েকজনকে নেয়া হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও তিন প্রাণ নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। পিতা-মাতা, স্বজনদের আর্তনাদে ভারি হয়ে গেলো রাজধানী ঢাকার আকাশ। বাতাসে বারুদের গন্ধ। এ যেন যুদ্ধ নগরীতে পতিত হলো রাজধানী ঢাকা। নাকে-মুখে-চোখে বাতাসে বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ আর ধোঁয়ায় কলরব-কোলাহলে খালি হয়ে গেলো রমনা পার্ক। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি এবং ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর আরেকটি, রিমোট কন্ট্রোলের চাপে পরপর পুতে রাখা দুটি বোমা বিস্ফোরিত হয় সেদিন। বলছিলাম, ২০০১ সালের পহেলা বৈশাখের দিন ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের কথা।
সেই থেকেই শুরু বাঙালির সংস্কৃতিতে আঘাত হানার সশস্ত্র ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। যে ষড়যন্ত্র এখনও চলমান, বাঙালির সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে বাংলার মানচিত্র গিলে খাওয়ার ষড়যন্ত্র এখনও চলমান। এখনও মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের জন্য আইনি নোটিশ দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দেওয়া হয় বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে র্যালি বন্ধের পায়তারায়। তবুও পালিত হচ্ছে বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎসব পহেলা বৈশাখ!
আজ শুক্রবার। পহেলা বৈশাখ-নতুন বাংলা বর্ষ। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’ এভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে এ আহ্বান জানায় বাঙালি। পহেলা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা, কুপমুন্ডকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।
এবারের পহেলা বৈশাখ বরণের আনন্দে মেতে ওঠেছে পুরো জাতি। মনে কোনো শঙ্কা না রেখে বাঙালির প্রাণের এই উৎসব উদযাপনে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন। বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল ভাষাভাষী সম্প্রদায় নানান আয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন নামে উৎসবমুখর দিনটি পালন করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা, হালখাতা, বৈশাখী গ্রামীণ মেলা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের পানি খেলা, ফুলবিজু পালনসহ নানা আয়োজন ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বাংলা নতুন বছরকে।
বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আজ সকল অন্ধকার ও বাধা বিপত্তি দূর করে আগামী বছরগুলোতে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কামনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই শুভ নববর্ষের প্রাক্কালে আমাদের প্রার্থনা এই যে, আমরা যেন সমস্ত অন্ধকার ও বাধা বিপত্তি দূর করে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পারি।’
তিনি বলেন, ‘নানা ধরনের বাধা বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে দেশ আরও একটি বছর পার করেছে। দেশ-বিদেশে বসবাসরত সকল বাংলাদেশিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘শুভ নববর্ষ’।
পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতেছে দেশ। ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩০’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। ছায়ানট ভোরে রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করছে। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন করছে। বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান আবশ্যিকভাবে জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গান পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ও ইউনেস্কো কর্তৃক এটিকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে এদিন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। বাংলা নববর্ষে সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার ও ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন গণনার শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন।
এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।
মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এসময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
আনেক বাঁধা-বিপত্তি আর তাজা প্রাণের বিনিময়ে আজ বাঙালির সংস্কৃতির পহেলা বৈশাখ উৎসব বিকশিত। আজও পালিত হচ্ছে অকুতোভয় বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ মঙ্গল শেভাযাত্রা নামে র্যালি বের করেছে। আজও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বৈশাখের বর্ণাঢ্য আয়োজনে পহেলা বৈশাখের র্যালিতে অংশগ্রহণ করেছে। বৈশাখ মমত্ববোধের, বৈশাখ ভালোবাসার, অম্লান থাকুক এই প্রত্যাশা এবং প্রাণের দাবি আজ প্রতিটি বাঙালি সত্তার। এতো বাঁধা-বিপত্তি; তবুও আজ পালিত হচ্ছে বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎসব পহেলা বৈশাখ!